somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ংকর ঠগী (প্রথম পর্ব)

৩১ শে মার্চ, ২০১১ রাত ২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগের ভারতবর্ষ। পথের ক্লান্তিতে অবসন্ন এক পথিক হাঁটছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটু পরে পায়ে চলা রাস্তা পেরিয়ে আর একটু চওড়া একটা রাস্তায় পড়তেই দেখল অন্তত, শ’খানেক লোকের একটা দল কোথায় যেন যাচ্ছে। দলে বেশির ভাগই পুরুষ হলেও, মেয়ে আর বাচ্চারাও আছে। খুবই আলাপী মনে হল তাদের। বিশেষ করে দলের সর্দার সৌম্যদর্শন দেহাতি মানুষটি পথিককে দেখেই এগিয়ে এসে আলাপ জমাল। গন্তব্যের কথা শুনে বলল, তারাও ঐদিকেই যাচ্ছে। পথিককেও তাদের দলে ভিড়ে যাবার পরামর্শ দিল সর্দার। আজ রাতটা কাটিয়ে কাল পৌছে যাবে গন্তব্যে।

দলটাকে বেশ ভাল লাগল পথিকের। রাজস্থানি পোশাক পরা পুরুষেরা, মাথায় পাগড়ি,বাচ্চাদের সাথে নিয়ে মেয়েরা আছে দলের পিছনদিকে। একেবারেই সাদামাটা চেহারা, দেহাতি মানুষ। শান্ত চোখ, খাড়া নাক, গায়ে কামিজ। সবাই হাঁটছে, হাতে দু একটা করে পুঁটলি। তাতে দৈনন্দিন দরকারের টুকিটাকি। দলের সাথে দুই-একটা মালবাহী গাধা। খাবারের সময় এল- ‘গরিবরা যা খাবে, তা-ই একটু মুখে দিতে হবে। নইলে, মা ভবানী রাগ করবেন ’, দলের সর্দার বলল পথিককে। বোঝা যায় দলের ভেতর হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের অনুসারীই আছে। রুটি-মাংস দিয়ে খাবার শেষ হয়।

বিকেলে দলে আরো কিছু সদস্য বাড়ে। নতুন সঙ্গী চারজনকে ব্যবসায়ী বলেই মনে হয়। সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বাক্স। প্রথমে তারা একটু ইতস্তত করছিল, কিন্তু সর্দারের প্রাণখোলা আমন্ত্রণ ফেরাতে পারেনি। সর্দারই বলল, পথেঘাটে ডাকাতের ভয়, এক সঙ্গে চলাই ভাল। নতুন করে দল বাড়ায় সবাই দারুণ খুশি। পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল। এবার রাতের মতো বিশ্রাম। রাস্তার পাশে সুন্দর একটা আমবাগানে তাঁবু খাটানো হল। ঠাণ্ডাটা বাড়ছে। কাপড় পেতে জমিয়ে বসল দলটা। একটু দূরে রান্নার আয়োজনে আছে মেয়েরা। বাতাসে গরম রুটির ঘ্রাণ। কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বেলে দিল ফাইফরমাশ খাটার ছোকরাদুটো। সর্দারের গল্প চলছে। পুরোনো কালের গল্প। গল্পে গল্পে সময় যেন পিছিয়ে গেছে দেড়শো-দুশো বছর। অদ্ভুত সব গল্প। গল্পের ঘোরে সবাই তন্ময়। রুটি, সবজি এল গরম গরম। খিদের মুখে গরম রুটির নেশা, আহা! খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হল গান। উষ্ণ আতিথেয়তার উত্তাপ যেন সবাইকে ঘিরে। অপরিচিত হলে কী হবে, এই অচেনা পথের স্বজন পেয়ে পরম নিশ্চিন্তে সবাই।

ঠিক এমন সময় সর্দারের নির্দেশ , ‘বাসন মাজ’। খাবার পর বাসন মাজার অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। কিন্তু, ‘বিয়াল’ বা কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানত সময় এগিয়ে আসছে ! এবার ‘ঝিরনী’ উঠবে অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হল ‘তামাকু লাও’। এক লহমায় ফাঁস জড়াবে শিকারের গলায়। ‘চামোচি’ ধরে থাকবে শিকারকে। ‘চুমোসিয়া’ তার হাত আটকে রাখবে, যাতে সে বাধা দিতে না পারে। ‘চুমিয়া’ তার পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ দেহগুলোকে নিয়ে যাবে কবরে!
শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক। কোথায়, কীভাবে হারাত, জানত না কেউ। কোন এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে-এই পথিক আর চার ব্যাবসায়ীর মত করে। কত মানুষ হারিয়েছিল এই ভাবে? ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ও তার পরের কয়েকশো বছরে প্রতি বছর গড়ে হাজার চল্লিশেক মানুষ নিখোঁজ হত। গিনেস বুক অব রেকর্ডসের হিসাবে এই সংখ্যা মোট ২০ লক্ষ! নিরিহ পথিকদের হত্যা করে মালামাল লুট করত যারা- ভারতীয় কিংবদন্তীতে আমরা তাদের ঠগী বলে চিনি। ঠগীরা ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। এরা সবসময় চলত দল বেঁধে। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রন জানাত। সহযাত্রীদের সৌহার্দের নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, পথ চলার ক্লান্তিতে ঢুলে পড়ত শিকার। গরম খাবার পেটে পড়ায় বন্ধ হয়ে আসত চোখ। আর তখনই আসত সর্দারের হুকুম, বাসন মেজে আনার!

চলবে . . .

দ্বীতিয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:০১
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×