somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষই সবচে দেখার মত জিনিস

২৯ শে মার্চ, ২০১১ বিকাল ৩:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সোমবার রাতে যখন ঢাকা থেকে বাসে উঠে খুলনার দিকে রওনা দিলাম, তখন নতুন কোন অনুভূতি হয়নি। তার কারণ; এই পথে বহুবার এইভাবে আমি আমার বাড়ি গিয়েছি, সেই পুরোনো পথ। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে যখন খুলনার রয়েল হোটেলের মোড়ে নামলাম তখন থেকে শুরু হল নতুন ঘটনা। খুলনা শহরের উপর দিয়ে এর আগে অনেক গিয়েছি কিন্তু নামা হয়েছে খুবই কম, আর কখনই হোটেলে থাকা হয়নি। যাই হোক ‘ক্যাসল সালাম’ হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে সকাল প্রায় ৯টা। অফিস টাইম। অথচ রাস্তায় মানুষ বা যানবাহন নাই বললেই চলে। বেশ অবাক হলাম। খুলনা বিভাগীয় শহর। বেশ পুরান শহর, অথচ সকাল ৯টার সময় রাস্তাঘাট এত ফাঁকা? সঙ্গী টুটুলকে নিয়ে রিক্সায় করে ‘ফরেস্ট ঘাট’ এলাম। এখানে পরপর অনেকগুলি টার্মিনাল। একটার নাম ফরেস্ট ঘাট এরপর জেলখানা ঘাট তারপর আরও কয়েকটি। এক সময় এই এলাকায় কুখ্যাত ‘এরশাদ শিকদারের’ রাজত্ব ছিল। এখন বেশ ছিমছাম। খুলনা শহরের রাস্তাগুলো অনেক চওড়া কিন্তু সে তুলনায় যানবাহন এবং মানুষ খুবই কম। খুলনার কোথাও ‘জ্যাম’ দেখিনি আমি। এই বিষয়টি বেশ ভালো লেগেছিল।
এর কারণ খুলনায় এক সময় অনেক ইন্ডাস্ট্রি ছিল আর তাতে অনেক লোক কাজ করত। তখন খুলনা শহরের লোকসংখ্যা বেশী ছিল। তাদের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট এবং শহর বড় হয়েছিল। এরপর ইন্ডাস্ট্রি গুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল এবং লোকসংখ্যা কমতে শুরু করল। এ কারণে বড় একটি শহর অনেক কম অধিবাসী নিয়ে বেশ সুন্দর একটা রূপ ধারণ করেছে। ঢাকায় কবে যে এমন হবে? প্রত্যেকটা শহরের একেকটা টোন আছে। খুলনার টোন হল “সেই খুলনা তো আর নেই। মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তো তাই ...” এই টোন খুলনাবাসীর প্রতি মুহুর্তের সঙ্গী। টুটুলকে যখন যে প্রশ্নই করি সে প্রথমে ঐ বাক্যটি বলে তারপর উত্তর দেয়। যেমন টুটুলকে প্রশ্ন করলাম,
“খুলনা শহরে দেখার মত কি কি আছে?”
“ভাই, দেখার মত তো তেমন কিছু নেই। মিল-কারখানা যা ছিল সব বন্ধ হয়ে গেছে।”
“টুটুল, মিল-কারখানা দেখার জিনিস না। ঐতিহাসিক বা সুন্দর কিছু নেই?”
“রূপসা ব্রিজ।”
এটা একটা মজার বিষয়। যেখানেই গিয়েছি, সবাই বলে দেখার মত জিনিস অমুক ব্রিজ, তমুক ব্রিজ। এমনকি ঢাকাতেও মহাখালী ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভারে মানুষ বেড়াতে যায়। এর কারণ কি? জানিনা, সম্ভবত বিশালত্ব মানুষকে টানে।
খুলনার মেয়েদের চেহারায় একটা বিশেষত্ব আছে। তাদের মুখমন্ডল গোলাকৃতির, সিরামিকসের প্লেটের মত। নায়িকা ববিতার মত। ইনফ্যাক্ট নায়িকা ববিতাও খুলনার মেয়ে। খুলনার মানুষ তুলনামূলক কম ধার্মিক এবং সংস্কৃতিমনা। তবে খুলনার মানুষ কম মিশুক।
রয়েল হোটেলের মোড়ে ‘ক্লাউড নাইন” এবং “কান্ট্রি লাউঞ্জ” নামের দুটি খুবই উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট পেলাম। ক্লাউড নাইনে ঢুকে টুটুলকে বললাম “বাহ্ খুলনায় তো বেশ ভালো রেস্টুরেন্ট আছে।”
“হ্যাঁ ভাই, আগে অনেক মিল-কারখানা ছিল তো তাই মানুষের হাতে টাকা-পয়সা ছিল, খরচ করার হাতও ছিল। এখন মিল-কারখানা নেই কিন্তু খরচ করার হাত রয়ে গেছে।”
আমি টুটুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। টুটুলও এই হাসির অর্থ বুঝল। বিকালের দিকে গেলাম নিউমার্কেট এবং হাদিস পার্ক। নিউমার্কেটের ঠিক পিছনে একটা দোকানে চা খেলাম, প্রতি কাপের দাম ২০ টাকা। খুবই সুস্বাদু চা। ঢাকার বাইরে কোথাও গেলে আমি সবসময় চেষ্টা করি গরুর দুধের চা খেতে। কিন্তু সিলেট-চট্টগ্রাম এলাকায় গরুর দুধের চা খুব একটা পাওয়া যায় না। খুলনা-রাজশাহী এলাকায় আবার রাস্তার মোড়ে মোড়েই গরুর দুধের চা পেলাম। “খুলনা শহরের প্রজন্মগুলি বেড়ে উঠেছে নিউমার্কেটকে কেন্দ্র করে।” এটা টুটুলের দাবী। আবার হাদীস পার্কে ঢুকতেই টুটুল বলল, “হাদীস পার্কে আমরা আসি সাধারণত কান পরিষ্কার করতে।” আক্ষরিক অর্থেই হাদীস পার্কে বেশ কয়েকজন কান পরিষ্কার করা হকার দেখলাম। দুপুরে গিয়েছিলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চিংড়ি মাছের মগজ দিয়ে ভাত খেলাম। পরদিন সকালে বি. এল. কলেজে গেলাম আমার চাচাতো বোন স্বপ্নার সাথে দেখা করতে, পুরোনো এই কলেজ গুলি ঐতিহ্য হারাতে হারাতে এখন প্রায় নি॥শেষ হয়ে গেছে- ছাত্র রাজনীতির ডাস্টবিন।

এরপর বরিশালের উদ্দেশ্যে যাবার বাস খুঁজতে বের হলাম, “কোন বাসটা ভালো?” এই প্রশ্ন করে রীতিমত বিপদেই পড়ে গেলাম। একেকজনের কাছে একেকটা ভালো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। পরে বিআরটিসি বাসে উঠে পড়লাম।
বুধবার রাত প্রায় ১০টায় বরিশাল শহরে পৌঁছলাম। খুলনা শহর যেমন ফাঁকা ফাঁকা, বরিশাল শহরে তেমনটাই ভীড়। বিশেষ করে লঞ্চঘাট এলাকায় ভীড় সবচেয়ে বেশী। রাস্তাঘাট সরু-ঘিঞ্জি। খুলনার তুলনায় হোটেল-রেস্টুরেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ। আর বরিশালের মানুষের যে জিনিসটা চোখে পড়ার মত তা হল ‘চাপা’। বরিশালের সবকিছুই এশিয়ার বৃহত্তম। “মেডিকেল কলেজ এশিয়ার বৃহত্তম,” “বি.এম. কলেজ এশিয়ার বৃহত্তম”... এগুলি আমার সঙ্গী বাবুলের দাবী। অবশ্য রাতে যে ইলিশ মাছ খেলাম সেটা এশিয়ার বৃহত্তম কিনা জানিনা, কিন্তু এর টেস্ট বোধ হয় আমি সারা জীবনে ভুলব না। এতটাই জোশ।
পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠে বিবির পুকুরপাড়ে গেলাম। এটাই বরিশাল শহরের ‘গুলিস্তান’। বরিশালের সকালটায় খুলনার মতই কম লোকজন। এর কারণ বরিশাল শহরটা ব্যবসাকেন্দ্রিক শহর। এখানে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান খুবই কম, কাজেই চাকুরীজীবিও কম। তাই সকালবেলার ছোটাছুটিও কম। কিন্তু সন্ধ্যায় জমে উঠে বরিশাল শহর। নদীবন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসায় এবং ব্যস্ততায় শহর সরগরম। এই শহরটা বেশ পুরাতন, তার সাক্ষী অনেকগুলি পুরাতন গির্জা এবং স্কুল-কলেজ। ও! আর একটা বিষয়, বরিশাল শহরে যতক্ষণ ছিলাম ঠাণ্ডা-মিষ্টি বাতাসে সারাক্ষণই মুগ্ধ-শীতল ছিলাম। আর একটা জিনিস হল পুকুর। যেদিকেই তাকিয়েছি সেদিকেই পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ পুকুর দেখেছি।
বরিশালের মেয়েদের নাক বেশ খাড়া এবং লম্বাটে চেহারা। আর তারা পিঠা বানাতে পারে হাজার পদের। পিঠার বিষয়টা বাবুলের দাবী, তবে আমার হাতে পিঠা খাওয়ার মত সময় ছিল না। বাবুল আরও দাবী করল, “বরিশালের মিষ্টি খুবই বিখ্যাত।” এই দাবী পরীক্ষা করতে বড় সাইজের তিনটা ‘রসগোল্লা’ খেলাম। এই পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষণা করব ময়মনসিংহে গিয়ে। খুলনা-ময়মনসিংহে যেমন স্থানীয় লোকের চেয়ে বাইরের জেলার লোক বেশী। বরিশালে তার উল্টা। অধিকাংশই বৃহত্তর বরিশাল জেলার মানুষ। এমনকি ভোলা, বরিশাল বিভাগের অধীনে হলেও ভোলার মানুষও বরিশালে কম। পেয়ারা-আমড়ার মত ফল বরিশালে বেশী জন্মালেও বরিশালের রাস্তায় খাবার বিক্রেতা ফেরিওয়ালা খুবই কম দেখেছি। এর কারণ কি? বরিশালের মানুষ বাইরের খাবার কম খায়? হতে পারে।
বরিশাল শহর থেকে একটু দূরে ‘নারকেল বাগান’ এবং ‘দূর্গা সাগর’ নামের দুটি খুবই সুন্দর বেড়ানোর জায়গা আছে। একটি কৃত্রিম নারকেল বন এবং অন্যটি বড় দিঘি, তবে নারকেল বাগানে নারকেলের চেয়ে সুপারি গাছই বেশী দেখেছি। তবে পাঠক, যদি কখনও বরিশাল শহরে বেড়াতে যান অবশ্যই বিকাল বেলায় নদীতে নৌকা নিয়ে বেড়াতে ভুলবেন না। খোদার কসম, এত বাতাসওয়ালা নদী এবং টলটলে পানি আমি আর কোথাও দেখিনি। আর অবশ্যই লঞ্চে চড়ে বরিশাল যাবেন। বরিশালের লঞ্চ আসলেই আরামদায়ক এবং বি-শা-ল। তবে ভীড়ের সময় আক্ষরিক অর্থেই প্রতি ইঞ্চি জায়গায় প্যাসেঞ্জার নেওয়া হয়। আমি যেদিন বরিশাল থেকে ফিরি, সেদিন বৃহস্পতিবার রাত হওয়ায় সামনের দুই ফুট চওড়া লঞ্চের ‘ড্রাইভিং হুইলে’র জায়গায় পর্যন্ত লোক শুয়ে ঢাকায় আসতে দেখেছি। অন্য প্যাসেসগুলির কথাতো বাদই দিলাম।

শুক্রবার রাতে পৌছলাম ম্যাংগো ল্যান্ড রাজশাহী। এখানে এসে যে ‘ডালাস’ হোটেলে উঠলাম তা বরিশালের ‘অ্যাথেনা’ হোটেলের চেয়ে বেশ ভালো কিন্তু খুলনার ‘ব্যাসল সালামের’ চেয়ে খারাপ। যাই হোক পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে গেলাম রাজশাহীর গুলিস্তান ‘সাহেব বাজারে’ রাজশাহী শহর প্রায় খুলনার মতই কিন্তু রাস্তাগুলি অত চওড়া নয় তাই মাঝে মধ্যে রিক্সায় জ্যাম লাগে। ঢাকা বাদে প্রত্যেকটি শহরেই প্রচুর ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা দেখলাম। ভালোই, পরিবেশ বান্ধব এবং বেবি ট্যাক্সির মত ‘ভটভট’ শব্দও হয় না।
রাজশাহীর মেয়েদের চোখ বেশ বড় বড়। আর গোল। চোখের উপরের ভ্রুও অর্ধবৃত্তাকার। রাজশাহী এসে উপলব্ধি করলাম কবি জীবনানন্দ দাসের ফিলিংস। জীবনানন্দ দাসের শহর বরিশালের মেয়েদের নাক খাড়া হলেও চোখ তেমন বড় নয় তাই রাজশাহী বা নাটোরের মেয়েদের বড় বড় গোল চোখ দেখে তার মনে হয়েছিল ‘পাখির নীড়ের মত’। বরিশালের বিএম কলেজে এই কবির নামে একটি চত্তর আছে। কবি সেখানে বসে কবিতা লিখতেন। আমি জীবনানন্দ দাসের পাগল ফ্যান, চত্তরে বাঁধানো শানের উপর কিছুক্ষন চুপচাপ বসে ছিরাম, মনে পড়ছিল বনলতা সেনের কথা। আমি হেলাল হাফিজেরও পাগল ফ্যান, তাদের কবিতা পড়ে মনে হয় আর কারো কবিতা লেখার দরকার নেই।
রাজশাহী গিয়ে বিখ্যাত ‘কমলা ভোগ’ মিষ্টি খেয়েছি। এখানে কমলা ভোগ মিষ্টির চেয়ে আমভোগ মিষ্টি থাকা বেশী জরুরী, কিন্তু নেই, দেশী যোগী ভিখ পায়না। রাজশাহীর আরও দুটি বিখ্যাত খাবার হল ‘কালাইয়ের রুটি এবং মরিচ ভর্তা’ ও ‘গরুর বট’ বা ভূড়ি ভাজি। যদিও আমার সঙ্গী রনি আমাকে পরের দুটি খাবার খেতে নিয়ে যায়নি তবু আমি সেখানকার মানুষের মুখেই এই খাবারগুলির প্রশংসা শুনেছি। রাজশাহী শহর দেখে আমার কলিগ অপু বলেছিল “শহরটা ১৯৯০ সালে এসে আটকে গেছে তারপর আর আগায়নি”। আমারও তাই মনে হল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়টাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯০ সালের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে রাজশাহীর মানুষ অনেক ভালো, সহজ-সরল। আরও ভালো লেগেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা। ঢাকার চারুকলার চেয়ে সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক বেশী এ্যাকটিভ। রুয়েট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছন দিয়ে একটি সরু রাস্তা আছে, প্রিয় কাউকে নিয়ে এই রাস্তায় ঘোরা বোধ করি বেহেস্তের চেয়েও সুখের হবে।
রাজশাহী শহরটা পদ্মা নদীর তীর ঘেসে গড়ে উঠেছে। শনিবার সকাল ১০টা/১১টার দিকে যখন নদীর পাড়ে গেলাম তখন একটা জিনিস আমার নজর কেড়েছিল। নদীর কুল ঘেসে জোড়া জোড়া লাল প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। জুটিরা যাতে নিরিবিলিতে প্রেম করতে পারে সেই আয়োজন। সকাল বলে অধিকাংশ চেয়ার অবশ্য খালি ছিল। তবু আয়োজন আছে দেখে আমি মুগ্ধ। খুলনা বা বরিশালে এমন কোন আয়োজন আমি দেখিনি। এর সঙ্গে তুলনা চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার। অবশ্য সেখানেও এমন সুন্দর চেয়ার পাতা নেই। ভালোবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে বসার এই আয়োজনের পিছে যতই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাক, সুযোগ টুকু তৈরির জন্যে উদ্দ্যেক্তাদের ধন্যবাদ জানাই।

রাজশাহী থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ গেলাম। ময়মনসিংহ শহরের যত কাছে আগাই ততই দেখি ট্রাক বোঝাই আনারস। আনারস আর আনারস। চারদিকে শুধু আনারস। আনারসের প্রতি আমার একটু বেশিই ব্যক্তিগত অনুরাগ আছে। মাঝে ডায়েট কনট্রোল করতে গিয়ে টানা প্রায় ১৫ দিন দুপুর বেলা আনারস খেতাম। যাই হোক ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করেই বুঝলাম এখানে রিক্সাভাড়া আকাশ ছোয়া। আর একটা বিষয় দেখলাম অধিকাংশ রেস্টুরেন্টেই কচু শাক ভর্তা পাওয়া যায়। মনে হয় ময়মনসিংহে কচু শাক বেশী জন্মে।
ঐদিন বিকালেই ২ জন সঙ্গীসহ মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা খাওয়ার জন্যে মুক্তাগাছা গেলাম। আমাদের সঙ্গে মুস্তাফিজ নামে যিনি ছিলেন তিনি এখানকার স্থানীয়। মুক্তাগাছার মন্ডার প্রশংসায় তিনি অস্থির। অন্য সঙ্গী রাজুর বাড়ি নাটোরে। রাজু এক টুকরা মন্ডা মুখে দিয়েই বলল, “এটাতো ‘নাটোরের কাচা গোল্লা’র মতই। শুধু কাচাগোল্লা একটু ভিজা ভিজা আর মন্ডা একটু বেশী শুকনা। দুটাই তো ছানার মিষ্টি।”
রাজুর মন্তব্যে মুস্তাফিজের মুখ শুকিয়ে গেল। হা হা হা ...(আমি হেসে দিলাম)। মন্ডা খেয়ে আমরা গেলাম মুক্তাগাছা রাজবাড়ি দেখতে। ধ্বংসস্তুপের আড়ালে এখনও সহজেই বোঝা যায় এই রাজবাড়ির এককালে কত জৌলুস ছিল। ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের সহযোগিতায় এখানে বেশ কিছু সংস্কার কাজও হয়েছে। আমরা যে মটর সাইকেলে করে গিয়েছিলাম সেটার হর্ণ এবং হেডলাইট ছিল না কাজেই অন্ধকার হবার আগেই ফিরতে হল।
শুধু ময়মনসিংহ নয় বাংলাদেশের যেখানেই ‘বিখ্যাত!’ মিষ্টি খেয়েছি, দেখেছি কম বেশী একই রকম। একথা ঠিক, বিখ্যাত মিষ্টি গুলো অবশ্যই ভালো। কিন্তু জিনিস মোটামুটি একই। যেমন বগুড়ার দৈ একটু শক্ত-ঘন আর বাগেরহাটের দই নরম, ঈযৎ তরল। এই যা পার্থক্য। ময়মনসিংহ শহরকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে ব্রক্ষপুত্র নদ। আরেক স্থানীয় সঙ্গী অংকুরের দাবী “এই নদীতে গোসল করলে গা চুলকায়।” বুঝলাম না এত সুন্দর টলটলে পানিতে গা চুলকাবে কেন? কিন্তু নেমে পরীক্ষা করার সময় এবং ইচ্ছা কোনটাই ছিলনা। এই শহরের অলিতে গলিতে প্রচুর স্কুল-কলেজ দেখেছি। অবাক হয়েছি এত ছোট একটা শহরে এত স্কুল কলেজ দিয়ে এরা কি করে। সোমবার সকালে যখন সকালের নাস্তা করে রিক্সা নিয়ে বের হলাম শহর দেখতে, অবাক হলাম স্কুল গোয়িং ছেলে মেয়েদের দেখে। রাস্তার লোক জনের ৭০% ই স্কুল গোয়িং ছেলে মেয়ে। একেক স্কুলের ড্রেস আবার একেক রকম। খুবই ভালো লাগল।
এই শহরটা বরিশালের ঠিক বিপরীত। ক্যান্টনমেন্ট, বিডিআর ঘাটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, মৎস গবেষনা কেন্দ্র সহ বহু বড় বড় প্রতিষ্ঠান থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই বাইরের জেলার এবং তাদের পেষা চাকুরী। বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান যেন চোখেই পড়েনি। মুক্তা গাছার রাজার বাগান বাড়ি সহ তার বেশ কিছু স্থাপনা ময়মনসিংহ শহরের গাম্ভিয্যকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। এই বাগান বাড়িতেই শুটিং করা হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত নাটক ‘অয়োময়’ এর। সেটি এখন বর্তমানে টিচার্সট্রেনিং কলেজ।

ময়মনসিংহ শহরের টোন হল, “আমাদের দুঃখ ময়মনসিংহ এতদিনেও বিভাগ হলনা”। রাজশাহী শহরের টোন; “রাজশাহী শিক্ষা নগরী, এখানে মানুষের চেয়ে ছাত্র বেশী” আর বরিশালের টোন হল, “বরিশালে....এশিয়ার বৃহত্তম”।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর ব্রক্ষপুত্র নদীর ওপারের কাশবনের অনেক সুনাম শুনেছিলাম। কিন্তু আমি গিয়ে দেখলাম, কিসের কাশবন? পাটক্ষেতে ভরে গেছে নদীর কুল। হয়তো শরৎ তখনও আসেনি তাই, বা কৃষি বিপ্লব। এই শহরে পা রাখতে না রাখতেই ‘মুকুলের চা’ এর প্রশংসা শুনতে শুনতে আমি অস্থির। “সন্ধ্যা সাতটার আগে মুকুল সাহেব দোকান খোলেন না”। “তার দোকানে দুধ চায়ের চেয়ে রং চায়ের দাম বেশী”। ইত্যাদি আরও অনেক প্রশংসা। আজ সন্ধ্যাতেই আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেব, তবু মুকুলের চা খাওয়ার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম। সময় কাটানোর জন্যে আরেক দোকানে মালাইকারি খেলাম। এরপর যখন মুকুল সাহেবের বিখ্যাত চা খেলাম? তখন...? বিশ্বাস করুন, এর চেয়ে আমার নিজের বানানো “রিমিক্স” চা অনেক অনেক ভালো। মুকুলের চা খেয়ে আমি রীতিমত হতাশ। তবে মুকুল সাহেবের চা বানানোর ভঙ্গি এবং গাম্ভির্য মুক্তাগাছার রাজার মতই। এই বিষয়টা অবশ্য আমার খুবই ভালো লেগেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের কুল ঘেষে বেশ কয়েকটি পার্ক। খুলনা নিউমার্কেটের মত ময়মনসিংহের প্রজন্মগুলো বড় হয়েছে এই পার্কে আড্ডা দিয়ে। আমরাও বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার পৌছলাম মঙ্গলবার গভীর রাতে। ফেনী থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত লম্বা জ্যামের কারণে এই দেরী। কক্সবাজার শহর নিয়ে আসলে লেখার নতুন কিছু নেই। শহরটা ঠিক দুই ভাগে বিভক্ত। অর্ধেকটা বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত এবং পর্যটন কেন্দ্র যা আপনারা সবাই অবশ্যই জানেন আর বাকি অর্ধেক সমুদ্র তীরবর্তী একটি বিরাট মাছের বাজার। যা আপনাদের অনেকেই জানেন। শহর থেকে কিছু দূরে একটি বড় শুটকির বাজার আছে। কিন্তু এখন সিজন না হওয়ায় চালু হয়নি। কক্সবাজারে কেউ বেড়াতে গেলে অবশ্যই “পুরাতন ঝাউবনের” শুটকি ভর্তা দিয়ে লাঞ্চ করবেন এবং কলাতলী বীচে অ্যাঞ্জেল ড্রপে বিকাল ও সন্ধ্যাটা কাটাবেন। লাবনী পয়েন্ট আর বার্মিজ মার্কেটে শপিংও করতে পারেন।

১২ দিনে ৫টি শহর ভ্রমণ এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি সুনামগঞ্জ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের বাকি জায়গাগুলোর ল্যান্ডস্কেপ মোটামুটি একই রকম। আলাদা শুধু মানুষ। একটু খেয়াল করলে অনেক কিছু দেখতে পারবেন- বুঝতে পারবেন। আমিও চেষ্টা করেছিলাম মানুষ দেখতে। যা দেখেছি তার কিছু কিছু লিখলাম আর কিছু কিছু আছে যা প্রকাশ করা যায় না। নিজের কাছে রেখে দিলাম।
৯টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মায়ের নতুন বাড়ি

লিখেছেন সাদা মনের মানুষ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২২

নতুন বাড়িতে উঠেছি অল্প ক'দিন হলো। কিছু ইন্টরিয়রের কাজ করায় বাড়ির কাজ আর শেষই হচ্ছিল না। টাকার ঘাটতি থাকলে যা হয় আরকি। বউয়ের পিড়াপিড়িতে কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকার পরও পুরান... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শ্রান্ত নিথর দেহে প্রশান্তির আখ্যান..... (উৎসর্গঃ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগারদের)

লিখেছেন স্বপ্নবাজ সৌরভ, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪২



কদিন আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে
কুকুরের মত জিহবা বের করে বসবো
শুকনো পুকুর ধারের পাতাঝরা জামগাছের নিচে
সুশীতলতা আর পানির আশায়।

একদিন অদ্ভুত নিয়মের ফাঁদে নেতিয়ে পড়বে
আমার শ্রান্ত শরীর , ধীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×