প্রিয় "মা",
পত্রের প্রথমে নিও আমার সালাম ও অগণিত ভালোবাসা।বাবাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ো।আশাকরি পরওয়ারদেগার এর অশেষ রহমতে ভালোই আছো।আমি কিন্তু ভালোই আছি তোমার দোয়ায়।আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করিও না।তোমার ছায়া সবসময়ই আমার সাথে আছে।
মাগো জানো,আজ এই দূরদেশে থেকে তোমায় ভীষন মনে পড়ছে।বার বার তোমার কথা মনে পড়ছে আর বুকের ভিতর অনেক দিনের মমতার শূন্যতা অনুভব করছি।আজ অনেকদিন হলো মা বলে ডাকতে পারছি না।মাগো এখন আর তোমার মত করে আদর করে কেউ ডাকে না।যখন তোমায় অনেক বেশী মনে পড়ে তখন আকাশের ঐ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ভাবি যে, পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে তুমিও হয়তো চাঁদটাকে দেখছো আর তোমার এই অধম সন্তানটির কথা ভাবছো।মাগো যখন নিজেকে বড়ই একা আর দুনিয়াটাকে স্বার্থপর বলে মনে হয় তখন তোমাকে অনেক মনে পড়ে।পার্ক বেন্ঞটায় বসে তোমার কথা ভাবি আর ছল ছল চোখদুটো দিয়ে অঝরে জল গরিয়ে পড়ে।"মা" শব্দটা যে কতটা আপন তা আগে বুঝতে পারিনি।একটি মহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারি না।মেহেরবান খোদার নিকট একটাই মিনতি যেন মৃত্যুর পূর্বমহূর্ত পর্যন্ত তোমায় ভুলে না যাই।
"মা" মাগো , তোমায় জানা অজানা কতইনা কষ্ট দিয়েছি।সেই গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে আজ অবধী তোমায় কত যন্ত্রনা কত কষ্ট দিয়েছি।তুমি শুধুই মুখ বুজে সহ্য করেছো কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করোনি।ছোটবেলায় কতবার তোমার কোলে মলত্যাগ করেছি।অবহেলায় দূরে ফেলে দাওনি বরং পরম মমতায় আর আদরে মেনে নিয়েছো।কপালে কালো টিপ এঁকে দিয়েছো।গাল দুটোতে চুমু খেয়েছো।আমাকে রক্ষা করার জন্য তাবিজ বেঁধে দিয়েছিলে।ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে গেলে তোমায় না দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠেছি,তুমি সকল কাজকর্ম ফেলে আমার কাছে ছুটে এসেছো।পরম আদরের সাথে বুকে তুলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছো।তুমি জানোনা মা তোমাকে ক্ষণিকের জন্য না দেখতে পেলে বুকের ভিতরটায় গলা কাঁটা কবুতরের মত ছটফট করে উঠতো।আমি জানি আমার জন্য তোমারও ঠিক একই অনুভূতি ছিলো এবং এখনো আছে।
তোমার মনে পড়ে ছোটবেলায় তুমি আমাকে কোলে নিয়ে সারাবাড়ি ঘুর বেড়াতে।জানো মা তখন আমি কি ভাবতাম? আমি ভাবতাম যে,যখন আমি বড় হয়ে যাব তখন আমি তোমাকে কোলে নিয়ে সাড়াবাড়ি ঘুরাবো।আমি কতটা বোকা ছিলাম তাই না?মাগো অনেক মনে পড়ে তোমায়,বলে বুঝাতে পারবো না।তুমি ছোটবেলা কত আমাকে দোলনায় দোল খাইয়েছো।দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে "ফুক্কি" নামক শব্দটি দ্বারা আমাকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেছো।যখন মুখের বুলি ফুটতে শুরু করে তখন মা ডাকটি শোনার জন্য কতবার বলেছো,"বলো মা,এইতো শোনা আবার বলো মা।" মাগো সত্যি বলছি "মা" শব্দটা তোমার এত প্রিয় জানলে খোদার কাছে অনুরোধ করতাম যেন জন্মের পর পরই মা বলে ডাকতে পারতাম।
আমার আজও মনে পড়ে তুমি আমার মাথায় নারিকেল তেল ঘষে থুতনিতে ধরে ডানদিকে একটা সিথি কেটে দিতে।মাগো আজ আমি মাঝে সিথি কাটি,কেউ তোমার মত করে এলোমেলো চুলগুলোতে তেল দিয়ে দেয় না।মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে তোমার হাতের স্পর্শ খোঁজার চেষ্টা করি।মাগো আমার মনে আছে আমাকে তোমার কোলে বসিয়ে রাতে চাঁদটাকে দেখিয়ে কবিতা পড়ে শোনাতে,"আয় আয় চাঁদ মামা...."। তখন কবিতার শেষটায় তুমি হাতটা আমার কপালে এনে বলতে,"চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।"
মাগো আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় আমি একবার আবদার করেছিলাম ফতুয়া পড়বো বলে।তুমি তোমার জন্য কেনা একটি কাপড়ের পিছ দিয়ে আমাকে ফতুয়া বানিয়ে দিয়েছিলে।সেটা যে আমার কত প্রিয় ছিলো বলে প্রকাশ করতে পারবো না।দুপুরে গোছলের সময় সেটা ধুয়ে রোদে দিয়ে খালি গায়ে পিড়ায় বসে থাকতাম।অতঃপর সেটা শুকিয়ে গেলে তা পড়ে তোমার হাতে খেতে বসতাম।তুমি ভাতের ছোট ছোট দলা বানিয়ে সেটাতে নাম দিয়ে দিতে।তখন সবার নামকে ভালোবেসে সবগুলো খেতে হতো আমাকে।আর মুগের ডাল পছন্দের ছিলোনা বলে সেটাকে কুরিয়া থেকে পাঠানো আব্বুর ডাল বলে খাইয়ে দিতে।মাগো আমার মনে পড়ে মাছের পটকা অথবা ডিম আমার পাতেই আসতো।মা জানো,এখন কেউ আমাকে তোমার মত করে খাইয়ে দেয় না।
মা তোমার মনে আছে ঝড়ের রাতে চুপটি করে তোমার কোলে শুয়ে পড়তাম।আকাশে বিজলী চমকালে তোমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরতাম। তোমাকে তখন গল্প বলতে বলতাম।আমার না ভূতের আর রাক্ষসের গল্পগুলো ভীষন ভয় লাগতো।ভাবতাম কেনো যে শয়তান রাক্ষসগুলোর জন্ম হয়েছে।আমি বড় হয়ে ইয়া বড় এক তরবাড়ি নিয়ে সবগুলা রাক্ষসকে মেরে ফেলবো।তবে মা তোমার রাজা রানীর গল্পগুলো ভীষন ভালো লাগতো।গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।মাগো আমার মনে আছে তুমি একহাতে হাতপাখায় বাতাস করতে আর গল্প বলতে।হাত ধরে গেলে হাত পাল্টে বাতাস করতে।কখনো ঘুমে তোমার চোখ লেগে আসতো আর তোমার হাতের পাখাটা বিছানায় পড়ে যেতো।ঘুমের ঘোরে যখন তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে আমি ঘামিয়ে গেছি তখন আবার হাতপাখাটা তোমার হাতে দুলতে থাকতো।মা তুমি বিশ্বাস করো,তখন যদি আমি জানতাম যে তোমার কষ্ট হচ্ছে তাহলে আমি কখনো নিজের গা জুড়ানোর জন্য তোমাকে বাতাস করতে দিতাম না।
আজও আমার মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিতে।আমি স্কুলের পথে হেটে যেতাম আর পিছন ফিরে দেখতাম তোমার নয়নজোড়া তৃপ্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।আমি দূর থেকে হাত নেড়ে ইসারা করতাম আর তুমিও নিজের অজান্তে হাত তুলে বিদায় জানাতে আর তোমার ঠোটের কোনায় থাকতো চিরচেনা সেই হাসি।আমি স্কুল থেকে যখন ফিরে আসতাম তখন তোমার হাতের চিনি আর লেবুর সরবত সব ক্লান্তি জুরিয়ে দিতো।এখন ব্যাস্ততার মাঝে কত সরবত খাওয়া হ্য় কিন্তু সেই চিনি আর লেবুর সরবতের মত ক্লান্তি ঘুচায় না।
ক্লাসে যে প্রতিবার ফার্স্ট হতাম আর সেই কৃতিত্ত যে পুরটাই তোমার সেটা বলতে কখনই কার্পন্য হবে না মা।তুমি আমার ফার্স্ট প্রাইজটা হাতে নিয়ে সেটা মাঝে যে কি খুঁজতে তা এখন আমি বুঝতে পারি।এখন ইচ্ছে করে দুনিয়ার সব কিছুতে ফার্স্ট হয়ে তোমার কাছে প্রাইজ তুলে দেই।ছেলেকে নিয়ে গর্বটা একটু বেশীই করতে তুমি।
মাগো,আমার যখন অসুখ করতো তখন তোমার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখতাম।কত খেয়াল করেছো তুমি আমার।সারারাত নির্ঘুম আমার শয্যা পাশে বসে থাকতে তুমি।আমার আরোগ্যের জন্য কত কি মানত করতে খোদার কাছে। কিন্তু আমি অধম তোমার সেবা করিনি।মাগো যেদিন ফুটন্ত পানি তোমার পায়ে পড়েছিলো সেদিনের কথা মনে আছে তোমার।আমি সারারাত তোমার পা ধরে বসেছিলাম।সেদিন আমার চোখের পানি ফোটায় ফোটায় তোমার পায়ে পড়ছিলো।সেদিন আমার মাঝে যে কিরকম অনুভূতি কাজ করছিলো তা ভাষায় প্রকাশের বাইরে।তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে," কাঁদিস কেন বোকা,কিছুই হয়নি আমার।"
মাগো, যখন শ্বশুরবাড়ীর মানুষগুলোর কথায় কষ্ট পেয়ে নিরবে অস্রু বিসর্জন দিতে তখনকার কোন কিছুই আমার চোখ এড়ায়নি।আমি তোমার কাছে এসে চোখ মুছে দিতেই তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো তীব্র কান্না করতে।আর তোমার সাথে সাথে আমিও কেঁদে ফেলতাম।তখন তুমি হেসে ফেলতে আর আমাকে প্রশ্ন করতে,"কিরে বোকা,কাঁদিস কেন তুই?"আমি তখন আবেগের সূরে বলতাম তুমি কাঁদছো কেনো?তুমি তখন বলতে "তুই যখন বড় হবি তখন সব বুঝতে পারবি।মাগো এখন আমি বুঝতে পাড়ি।আমি কি বড় হয়ে গেছি?মাগো,ও মা তাহলে আমি বড় হতে চাই না।আমি তোমার কোলের ছোট্ৎি হয়ে থাকতে চাই।বড় হয়ে তোমার সেই আবেগ সেই ভালোবাসা বুঝতে পারিনা।আমি তোমার কাছে ছোটই থাকতে চাই।
মা,তোমাকে যখন কাঁদতে দেখতাম তখন আমি কি ভাবতাম জানো?তুমি প্রমিজ করো কাউকে বলবে না....তাহলে শোন,আমি তখন ভাবতাম আমি বড় হলে আমার বউকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।আমি আমার বউকে কাঁদতে দিবো না।হা হা............।আমি কতটা পাগল ছিলাম দেখলে।
আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন পকেটের খরচটা বেড়ে গেলো।বাবার কাছে টাকা চাইতে ভয় ও লজ্জা দুটোই করতো।তোমার আঁচল থেকে কতবার গিট খুলে টাকা নিয়েছি তুমি জানতেই পারনি।মা তোমার মনে পড়ে খাওয়ার পরে আমি তোমার আঁচলে হাত মুখ মুছতাম।তুমি শত বকাঝকা করেও শুধরাতে পারোনি।মাগো আজ আমি নিজেই শুধরে গেছি।তোমার আঁচলের অভাব এখন রিসাইকেল টিস্যু দিয়ে মেটানো হয়।
আজও মাঝে মাঝে চশমাটা চোখে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।মাগো তোমার মত করে কেউ মাঝ রাতে এসে দেখে যায় না।চশমাটা খুলে টেবিলের উপর নিয়ে রাখে না।কাপড়গুলোতে তোমার করা ভাঁজ খুঁজে পাই না। এলোমেলো কাপড়গুলো আর ভাঁজ করা হয় না।
মা তোমার কি মনে পড়ে আমি যখন ভার্সিটিতে উঠলাম তখনকার কথাগুলো?তখনো বাইরে থেকে এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম।তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরতাম আর তুমি আমার চুলগুলি টেনে দিতে আর শাশন করতে চুল কাটাইনা কবে।মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরলে আব্বুকে দিয়ে শাশন করাতে।মোটেই ভালো লাগতো না সেটা।কিন্তু এখন বুঝি,আমাকে নিয়ে সবসময় টেনশন করতে। মনে আছে মা আমি যখন কম্পিউটারে বসতাম তখন তুমি আমার ঘরে এসে চেয়ারটার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে।আর আমি ফেইসবুক থেকে উদ্ভট সব মেয়ের ছবি তোমাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করতাম,"দেখ তোমার পুত্রবধু....পছন্দ হইলে জানাইয়ো।বাসায় নিয়ে আসবো।"তুমি তখন আমার পীঠে চর মেরে বলতে,"অনেক বড় হয়ে গেছিস না?এত তারাতারি বিয়ে নেই তোমার কপালে,আরও দশ বছর সাধনা কর।আগে নিজে একটা কিছু কর,পরের মেয়ে ঘরে এনে খাওয়াবা কি?"তখন আমি দুষ্টামি করে বলতাম,"দশ বছর অনেক সময়,আর কয়েকটা বছর কমাও না মা।"তুমি তখন হাসতে হাসতে বলতে যে বেশী বারাবারি করলে বাবাকে জানিয়ে দিবে।হা হা হা......আরও কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি জমা আছে মা।তোমার কোন কথাই আমি ভুলিনি।
মাগো,ও মা, পারলে তোমার এই অধম সন্তানকে ক্ষমা করে দিও।সেই প্রথম থেকেই তোমাকে কত জ্বালাতন করেছি।তোমার খাবার কতদিন আমিই খেয়ে ফেলেছি।তুমি শুধুই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছো।কত অন্যায় আবদার করেছি তোমার কাছে।সেই আবদার রক্ষা করতে কতইনা কষ্ট পেতে হয়েছে তোমাকে।মাগো জানিনা কবে আবার তোমার কোলে ফিরে যাব।আজ তোমাকে কাছে না পেয়ে যে অনুভূতি কাজ করছে সেই অনুভূতির আদলে সারাজীবন যেন তোমার পায়ে স্থান পাই এই কামনাই করি উপরওয়ালার কাছে।মাগো আবারো বলি কোন ভুল ত্রুটি করে থাকলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো।তোমার ঋণ দুই ভুবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়ে শোধ হবে না মাগো।ভালো থেকো মা।নিজের প্রতি খেয়াল রেখো।
ইতি,
তোমার হতভাগা সন্তান
মা কে ডেডিকেটেড করে সন্তানদের একটি গান।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১১ বিকাল ৫:৩৭