somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাপানের নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার গ্রাফিক্যাল প্রেসেন্টেশান ও বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রশ্ন

১৫ ই মার্চ, ২০১১ রাত ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আর সুনামির তান্ডবে লন্ডভন্ড জাপানের ক্ষুধা-তৃষ্ঞায় কাতর অধিবাসীদের উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে নেমে এসেছে নিউক্লিয়ার দুর্যোগের ঘনঘটা। ফুকোশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের তিন তিনটি রিঅ্যাক্টর বা চুল্লীতে ঘটা বিস্ফোরণ ও এর মধ্যে একটিতে(রিঅ্যাক্টর-২)একেবারে নিউক্লিয়ার মেল্টডাউনের ঘটনা শুধু ফুকোশিমার আশপাশের অধিবাসীদের নয়, গোটা জাপানবাসীকে আতংকগ্রস্থ করে তুলেছে। সেই সাথে এই ঘটনা সারা দুনিয়াতেই নিউক্লিয়ার বিদ্যুত প্ল্যান্ট নিয়ে চালু বিতর্ককে উস্কিয়ে দিয়েছে। সুইজারল্যান্ড সেদেশের পুরনো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট প্রতিস্থাপন করে নতুন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ স্থগিত করেছে। জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে সেদেশের সকল নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করার যে পরিকল্পনাটি স্থগিত করেছিল, সেটি আবার চালু করার কথা উঠেছে। কথা উঠেছে ব্রিটেনের নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের ভবিষ্যত নিয়ে। শুধু কথা নেই বাংলাদেশে রুপপুরে সম্ভাব্য নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অবস্যম্ভাবি ঝুকি নিয়ে। চেরনোবিল কিংবা থ্রিমাইল আইল্যান্ডের ঘটনার পর দুনিয়াতে আর নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা নেই কিংবা কোথাও আর কোন ধরণের নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটেনি ইত্যাদি প্রচারের মাধ্যমে(এবং বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেশে ঘটতে থাকা দুর্ঘটনার খবর প্রচার না করা) নিউক্লিয়ার লবি যে নিরাপত্তার মিথ তৈরী করেছিল, প্রযুক্তিগত দক্ষতার শীর্ষে উঠা জাপানে ভুমিকম্প ও সুনামির ফলে দুনিয়ার অন্যতম নিরাপদ বলে গণ্য জাপানের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের তিন তিনটি রিঅ্যাক্টরে ঘটতে থাকা ভয়াবহ দুর্ঘটনা সে মিথ কে একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছে।

কাজেই এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকদেরকে আহবান করবো আপনারা প্রযুক্তির উপর অন্ধ আনুগত্য টুকু একটু স্থগিত রেখে জাপানের ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে ঘটতে থাকা পারমাণবিক বিপর্যয়ের ম্যাকানিজমটুকু খেয়াল করুণ এবং বোঝার চেষ্টা করুণ, প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণেই নানান অনাকাঙ্খিত ঘটনার চেইন অব ইভেন্ট কেমন করে একটা নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটায়। সেই সাথে ভাবুন জাপানের মতো প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা একটি দেশে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা যেখানে ঠেকানো যায়নি সেখানে বাংলাদেশে বর্তমান প্রযুক্তিগত দক্ষতার সাপেক্ষে কোন ভরসায় আমরা ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর সাহস করছি?


ছবি১: ফুকোশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ও সেখানে ব্যাবহ্রত একটি রিঅ্যাক্টর সিস্টেমের ব্লক ডায়াগ্রাম

জাপানের ফুকোশিমাতে বয়েলিং ওয়াটার রিঅ্যাক্টর ব্যাবহার করা হয়। এই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ভেতরে জিরকোনিয়াম সংকর দিয়ে তৈরী ফুয়েল রডের মধ্যে জ্বালানি ইউরেনিয়াম থাকে। ফুয়েল রডগুলো পানিতে চুবানো থাকে। রডের ভিতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় যে উত্তাপ তৈরী হয় তা পানিকে বাস্পীভূত করে এবং সেই বাস্পের সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুত উতপাদন করা হয়।


ছবি২: ফুকোশিমায় ব্যাবহ্রত বয়েলিং ওয়াটার রিঅ্যাক্টরের এর কনসেপচুয়াল ডায়াগ্রাম


ছবি:৩ রিঅ্যাক্টরের ভিতরে ফুয়েল রড, ফুয়েল রডের ধারক প্লেট আর পানির প্রবেশ পথ


ছবি:৪ পানিতে চুবানো ফুয়েল রড


ছবি:৫ ফুয়েল রডের ফাকে কনট্রোল রড প্রবেশ করিয়ে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়

জাপানে দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটেছে:

১) ভূমিকম্প আঘাত হানার পর পরই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফুয়েল রডের মধ্যে কন্ট্রোল রড্ ও ঠিকঠাক মতো বসে যায়। কিন্তু সমস্যা হয় কুলিং সিস্টেমে।

২)ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে বিদ্যুত ব্যাবস্থা ধ্বসে পড়ে। কুলিং সিস্টেমের জন্য বিদ্যুত না থাকায় কুলিং সিস্টেম চলে না। ব্যাকআপ জেনারেটর গুলোও চালু করা যায় নি। এভবে কুলিং সিস্টেম কাজ না করার ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের নিউক্লিয়ার ফুয়েল যে উত্তাপ তখনও ছড়াতে থাকে সেটা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব থাকে নি।

৩)কুলিং সিস্টেম বন্ধ হওয়ার ফলে রিঅ্যাক্টরের মধ্যে পানির আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পানি আটকা পড়ে প্রচন্ড উত্তাপে বাস্পীভূত হতে থাকে। পানির স্তর নীচে নামতে থাকে ফলে ফুয়েল রড গুলো পানি থেকে ভেসে উঠে বায়ুর সংস্পর্শে আসতে থাকে। ফূয়েল রডের জিরকোনিয়াম কেসিং আরো উত্তপ্ত হতে থাকে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উত্তাপে ভাঙতে বা গলতে থাকে। ফুকোশিমা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের রিঅ্যাকটর-২ এ এরকম ভাবেই ফুয়েল রড এক্সপোসড বা উন্মোচিত হওয়ার ফলে জিরকোনিয়াম কেসিং এর ফূয়েল রড গলে গিয়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে জাপানের সরকারি এনএইচকে ওয়ার্ল্ডে খবর প্রকাশ করা হয়েছে।(Fuel rods exposed at Fukushima reactor http://www3.nhk.or.jp/daily/english/14_46.html)

৪)ফুয়েল রডের জিরকোনিয়াম সংকর উত্তপ্ত বাস্পের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরী করে যা আবার রিঅ্যাক্টরের আধারের উপর ব্যাপক চাপ তৈরী করে। এই চাপ কমানোর জন্যই রিঅ্যাক্টরের আবরণের বাইরে গ্যাসটুকু বেরকরে দেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। এই কাজটি করার সময়ই ব্যাপক চাপে রিঅ্যাক্টর ভবনের ছাদ উড়ে যায়। রিঅ্যাক্টর-১ এবং রিঅ্যাক্টর-৩ এরকম ঘটনা ঘটে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে যদিও জরুরী ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করিয়ে কুলিং সিস্টেম চালু রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল(এখনও চলছে)সেখানে।


ছবি:৬ রিঅ্যাক্টর ভবনের উড়ে যাওয়া ছাদ


ছবি:৭ স্যাটেলাইট ছবিতে সোমবারে রিঅ্যাক্টর-৩ এ দুর্ঘটনার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে

এই দুর্ঘটনা থেকে আমরা দেখছি:
ভুমিকম্প ও সুনামির ফলে হঠাত এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যেগুলোর সবগুলো পূর্ব থেকে অনুমান করে আগাম ব্যাবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। যেমন: নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট অটোমেটিক শাট ডাউন সফল ভাবে হলেও কুলিং সিস্টেম কাজ না করা, বিকল্প বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর কাজ না করা, ইন্টারনাল ব্যাটারির চার্জ কুলিং এর জন্য যথেস্ট না হওয়া, বিকল্প ব্যাবস্থা হিসেবে সমুদ্রের পানি যথেস্ট দ্রুতগতিতে পাম্প করে কুলিং এর কাজ করতে না পারা, হাইড্রোজেন গ্যাসের চাপ বেশি হয়ে উঠা, সেই গ্যাসের চাপ সামাল দেয়ার জন্য স্বেচ্ছায় তেজস্ক্রিয় গ্যাস বাইরে বের করা, তারপরও চাপ পুরোপুরি সামলাতে না পারার ফলে রিঅ্যাক্টর ভবন উড়ে যাওয়া ইত্যাদি। আমরা দেখছি এডহক ভিত্তিতে তাতক্ষণিক ভাবে পারমাণবিক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের চেষ্টা চালাতে হয় জাপান কে যার কোনটি সফল হয়েছে কোনটি হয় নি ফলে রিঅ্যাক্টর-২ এ কোর মেল্টডাউন ঘটেছে এবং তেজস্ক্রিয়তা আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি আরো ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা যাচ্ছে।

আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বন্যা ভুমিকম্প সহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ কি নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টকে কেন্দ্র করে এই ধরণের এক ঝাক অনাকাঙ্খিত বিপর্যয়ের আশংকা ও সেই বিপর্যয় মোকাবিলার সম্ভাব্যতা/অসম্ভাব্যতা, প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য থাকা না থাকার ঝুকি বিবেচনা করেই নিউক্লিয়ার বিদ্যুত কেন্দ্র বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

নাকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মরণের উপর আবার খাড়ার ঘা হিসেবে দেশের মানুষের উপর এক প্রযুক্তিগত দুর্যোগ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে?


তথ্যসূত্র
Click This Link

Click This Link

Click This Link

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১১ রাত ১০:২০
৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি অজ্ঞ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫২


ভাবতে পারো
৮০ টুকরো হতে হয়;
ভাবতে পারো
জ্বলে পুড়ে মরতে হয়!
ভাবতে পারো
কতটুকু লোভ লালসা
থাকলে পরে
এমন হবে বলো দেখি;
ভাবতে পারো
কেমন জন্ম মৃত্যুর খেলা;
জানি আমি
তুমি কিছু ভাবতে পারবে না
কারণ তুমি অজ্ঞ
মৃত্যুর পরে একা... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×