somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"আমি বিজয় দেখেছি" [একটি অবাস্তব এবং অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী]

১৪ ই মার্চ, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রেক্ষাপট ১

তারিখ: ১৯৭১ সালের ১৭ ই নভেম্বর
স্থান: ফরিদপুরের চাঁদ বোয়ালমারী

গভীর রাত, হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি কাঁদাময় একটি পুকুরের ঢালুতে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার, প্রচন্ড শীত, এর মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গত দুই রাত কোনো ঘুম নাই। ক্ষুধায় পেট সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে নিক্ষিপ্ত হওয়া গ্রেনেডের ২ টি স্পিন্টার আমার ডান পায়ের গোঁড়ালিতে বিদ্ধ হয়েছে। গায়ে পরণের একমাত্র সোয়েটারটি দিয়ে আহত হওয়া স্থানটি শক্ত করে বেঁধে রেখেছি। তবুও অনর্গল রক্ত ঝরছে। আমার খেয়াল তখনও অন্য দিকে। অনুমান করা যাচ্ছে, গোলা-বারুদ আর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত কম পক্ষে ১০/১২ জন পাকসেনা আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। আমরা বলতে, এই মুহুর্তে দুইজন মাত্র জীবিত সদস্য। আমি আর বাবলু ভাই। পাশে শহীদ হয়ে শুয়ে আছেন শফিক আর হেলাল ভাই।

আমরা মুক্তি বাহিনীর সদস্য হিসাবে সেক্টর ২-এ ফরিদপুর জেলার হয়ে প্রাণপন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সেক্টর কমান্ডার হলেন মেজর হায়দার। উনার নির্দেশেই বোয়ালমারীতে অপারেশনে এসেছি পাকবাহিনীর এই ক্যাম্পটি ধ্বংস করতে।

হঠাৎ পাশ থেকে বাবলু ভাই বলে উঠলেন, "আর কোনোভাবেই সম্ভব না রে ভাই! হে বাংলাদেশ, হে মোর জন্মভূমি, আমি তোমায় ভালবাসি। দেশের জন্য জীবন দিতে পেরে আজ আমার জীবন ধন্য"। বাবলু ভাইয়ের বাম হাত গ্রেনেডের তোরে উড়ে গেছে বেশ আগেই, উনি ঠিকভাবে অস্ত্রটিও ধরতে পারছেন না। তবুও উনার চোখে দৃঢ় প্রত্যয়, দেশ স্বাধীন করবেনই।

ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো, এই ভেবে নয় যে আর কিছুক্ষণ পরে মারা যাচ্ছি.....এই ভেবে যে, "স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে হয়তবা আর যাওয়া হবে না"।

ফিরে গেলাম আজ থেকে ৫ মাস আগের সেই দিনে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার গ্রামের বাড়ি যশোরের কালিগঞ্জ থানায়। মাইকেল মধুসুদন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। এমতাবস্থায় দেশকে হিংস্র পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সিদ্বান্ত নিলাম, "মুক্তিযুদ্ধে যাব"। মাকে যেদিন বললাম, "মাগো তোমাকে আমি একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিব, আমি আজ চলে যাচ্ছি"। মা আমাকে কিছুই বললেন না, শুধু আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। বাবাকে বললাম, "বাবা, আল্লাহর কাছে দোয়া করো; যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি নয়তবা শহীদদের কাতারে শামিল হতে চাই"। শেষবারের মতন যখন মাকে কদমবুচি করলাম, তখন মায়ের অশ্রুজল আমার মাথার উপরে পড়ল। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে আমার জীবনে? পরবর্তীতে মেজর মানজুর থেকে খবর পেলাম যে, ওই নর-পশুরা আমার বাবা আর বড় ভাইকে হত্যা করেছে......
__________________________________________________________

আমার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠলো। বাবলু ভাইকে বললাম, "স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা আর মাতৃভূমি। আমরা এসেছি মাটি আর মাকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করতে। এই পিশাচ-রুপী পাকসেনাদের গুলিতে মরবার জন্য আমার জন্ম হয় নাই। আমি জন্মেছি পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে মাথা তুলে ধরবার জন্য"।

আমার মাথায় পেঁচিয়ে বাঁধা আছে বাংলাদেশের পতাকা। হাতের মেশিনগানটাকে শক্ত করে ধরলাম। চিত্কার করে উঠলাম, "জয় বাংলা, আমরা পারবই"।
__________________________________________________________

*** ১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১:

আমরা সবাই ফরিদপুরের কমলাপুর হয়ে জিলা স্কুলের দিয়ে যাচ্ছি উত্ফুল্ল জনতার বিজয় মিছিল নিয়ে........আজ আমরা ইতিহাস গড়েছি.........দু-চোখ দিয়ে আমার অনর্গল অশ্রু ঝরছে......"অবিশ্বাস্য হলেও সত্য......আমরা পেরেছি"


প্রেক্ষাপট ২

তারিখ: ২৮ মার্চ, ২০১১
স্থান: জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম, চট্রগ্রাম

বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের খেলা চলছে। আজকের খেলায় হেরে গেলে; বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে বিদায় নিবে। এর আগে ১৪ বারের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র একবার 'ওডিআই'-তে ইংল্যান্ডকে হারাতে সক্ষম হয়েছে। আবার আগের খেলায় বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে মাত্র ৫৮ রানে অল আউট হয়ে গেছে। ক্রিকেট-বোদ্ধারা বলেই দিয়েছেন যে, আজকে বাংলাদেশের জিতার সম্ভাবনা শতকরা মাত্র ২০ ভাগ।

চট্রগ্রামে প্রশস্থ আলোকরশ্মিতে দিবা-রাত্রির এইটাই প্রথম খেলা। আমরা গ্যালারী ভর্তি দর্শক আজকের খেলা দেখতে এসেছি। প্রথম ইনিংস শেষে বাংলাদেশের টার্গেট: ২২৬ রান করা। দ্বিতীয় ইনিংসের এক পর্যায়ে, বাংলাদেশের অবস্থা গিয়ে দাঁড়ালো ১৬৯ রানে ৮ উইকেট। বাংলাদেশের দরকার ৬২ বলে আরোও ৫৭ রান। ব্যাটিং-এ আছেন মাহমুদুল্লাহ এবং শাফিউল ইসলাম। এমতাবস্থায় মাহমুদুল্লাহ পর পর ৩ টি বল ব্লক করলেন। বাংলাদেশের বিজয়ের কোনই সম্ভাবনা নেই। মাঠের বিশাল পর্দায় দেখা গেল, খেলা দেখতে আসা দর্শকেরা হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমিও হঠাৎ খেয়াল করলাম যে, আমার চারপাশের দর্শকেরাও গায়েব। শুধু আমার ডানপাশে বসে আছে আমার বড় ছেলে আর আমার নাত-ছেলে। আর আমার বামপাশে বসে আছেন, আমার অতি-প্রিয় বন্ধু আর আমার সহ-মুক্তিযোদ্ধা বাবলু ভাই

আমার নাত ছেলের সমগ্র মুখ-জুড়ে বাঘের ছবি আঁকা। সে বলে উঠলো, "নানা-ভাই, আজকে বাংলাদেশের পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না"। বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে, এমন একটা মন-মরা ভাব ধরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আমার বড় ছেলে। আর বাবলু ভাই বাংলাদেশের একটা বিরাট বড় পতাকা নিজের সমগ্র শরীরে পেঁচিয়ে রেখেছেন শক্ত-মুষ্ঠিতে।

আমি ফিরে গেলাম আজ থেকে ৪০ বছর আগের সেই দিনে। সেই দিনটির কথা; কিভাবে ওই নর-পশুরা আমার বাবা আর বড় ভাইকে হত্যা করেছিল! কিভাবে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম ! সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, গাজী, বীরাঙ্গনা আর শহীদের রক্তই তো এই সব দামাল ছেলেদের রক্তে আজ প্রবাহিত হচ্ছে। এই নতুন প্রজন্মের জন্মই হয়েছে নিজেকে বিজয়ীর বেশে উপস্থাপন করতে। এরা হারতে পারে না। কেননা এরা তো পরাজয় মেনে নিতে শিখেনি। এরা যে বাংলার বাঘ।

আমার চোখ-মুখ আবারও শক্ত হয়ে উঠলো। বাবলু ভাইকে বললাম, "এই মুহূর্তে খেলা দেখার জন্য বুকের পাটা লাগে। আমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, ওরা কিসের আশায় বুক বাঁধবে। এখন বাংলাদেশের বেশি দরকার আমাদেরকে; দর্শকদের প্রেরণা আর দোয়া। বাংলাদেশের পরাজয় দেখবার জন্য আমার জন্ম হয় নাই। আমি জন্মেছি পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে মাথা তুলে ধরবার জন্য"।
____________________________________________________

আজও আমার মাথায় পেঁচিয়ে বাঁধা আছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। হাতের পতাকাটা শক্ত করে ধরলাম। সবাই মিলে চিত্কার করে উঠলাম, "জয় বাংলা, আমরা পারবই।"


*** কিছুক্ষণ পরের ঘটনা:

বাবলু ভাইয়ের কোলে উঠে আমার নাত-ছেলে 'বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ' বলে চিত্কার করছে..........আর আমার বড় ছেলে, আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে.....তাদের আনন্দ আজ যেন আর বাঁধ মানছে না !

************************************

আমরা সবাই স্টেডিয়াম দিয়ে বাইরে যাচ্ছি উত্ফুল্ল জনতার বিজয় মিছিল নিয়ে........আজ আমরা ইতিহাস গড়েছি.........দু-চোখ দিয়ে আমার অনর্গল অশ্রু ঝরছে......"অবিশ্বাস্য হলেও সত্য......আমরা পেরেছি"

************************************

[বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতি রইলো শুভ-কামনা]




বিঃদ্রঃ এইটা আমার লেখা একটি কল্পকাহিনী......এই লেখার সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ক্রিকেট আর রাজনীতির কোনই সম্পর্ক নেই.....লেখার চরিত্র আর সবকিছুই নিছক কাল্পনিক...........সবাই ভালো থাকবেন এবং সুস্থ্য থাকবেন !!!
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×