somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রতিচ্ছবি ছোট-গল্প

১২ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

( এক )
নিঃশব্দ পতন। এমন-ই। মানুষের পতনের বোধ হয় কোন শব্দ হয়না। সূর্য্য যেমন অন্ধকার কে পথ দেখিয়ে অস্ত যায় নীরবে,-----নদীর পাড় যেমন একটু একটু করে ভেঙ্গে-ভেঙ্গে জলের তলাতেই মুখ লুকায়,-----পলির স্তর যতই পুরু হয় জলের স্বচ্ছতাও ততই কমে যায়।
তারপর একদিন সেই তলতলে কোমল বুকই হয়ে ওঠে রুক্ষ, শুষ্ক, কঠিন। ফেটে যাওয়া সেই চৌচির বুক নিয়ে সে চেয়ে থাকে আকাশ পানে। দেখা যায়না, শোনা যায়না। কিন্তু যেখানে ধরা পড়ে, সেখানে গভীর-গোপনে রক্তপাত হয় চুঁইয়ে, চুঁইয়ে।

( দুই )
-"আচ্ছা, কেয়া, শুক্লা এখন-ও ফিরছেনা কেন? ওরতো এত দেরী হয়না?-
-"হ্যাঁ দিদি, আমিও তাই ভাবছি। দেখি আর কিছুক্ষন। তোমার ভাই-এরও তো আসার সময় হয়ে গেল। গুড্ডুটাও আজ দেরী করছে। ও এলেও নাহয় পাঠান যেত।
আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে দুজনার গলা দিয়ে আর স্বর বেরোয়না। কিছুই স্থির করতে পারে না। সামান্য পাতার আওয়াজেও পর্দ্দা তুলে দেখে। শেষমেষ আর ঘরে বসতে না পেরে দুজনে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে দাঁড়াতে পা টাটিয়ে ওঠে। বাইরের আলো নিবিয়ে মোড়া পেতে বসে। মাথা ঝুঁকিয়ে, গলা বাড়িয়ে, দৃষ্টিকে যতদূর পারে ছড়িয়ে দেয়। বুকের কাঁপুনিও বাড়তে থাকে। পথের মানুষও বুঝি বুকের শব্দে থমকে দাঁড়াবে। কি করবে? কি করবে? কোথায় যাবে? কিছুই মাথায় আসেনা । কিছুক্ষন চুপ থেকেই আবার দুজনেই দুজনকে শুধায়,----------------------------------
-"আচ্ছা , তোমার কি মনে হয় বলতো? কেন , এক-জনও ফিরছেনা?-"
বলতে না বলতেই সমীরের ফেরার শব্দে দুজনেই উতলা হয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকেই, দুই মহিলার এমন বিহ্বল দৃষ্টি তাকেও আতঙ্কিত করে। কে, কথাটা বলবে? দুজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর এক সময় দুজনেই একসাথে ঝপ্ করে কথাটা বলে ফেলে।
-"শুক্লা এখন-ও ফেরেনি।-"
-"সে কি কথা? এত রাত পর্যন্ত ফেরেনি? তার মানে? আর, তোমরা নিশ্চিন্তে বসে আছ?-"
কেয়া, এতক্ষনে নিজেকে নির্ভার করে, হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে।----------"কি জানি, কি যে করব, কোথায় যে যাব, কিছুই বুঝতে পারছিনা। তাই তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি।-"
-"কেন? ওর কলেজে কিংবা বন্ধুদের বাড়ীতে একবার গুড্ডুকে পাঠিয়ে খোঁজ নিতে পারলে না?-"
-" সে ই বা কোথায়?-"
বিরক্তি, চিন্তা সব মিলিয়ে-মিশিয়ে বকবক করতে করতে ঘরে ঢোকে । পেছন পেছন তারা দুজন। কেয়া নিজেকে আর সামলাতে পারেনা। ওদের পাশ কাটিয়ে ধীরে-ধীরে শুক্লার ঘরে গিয়ে, ওর জিনিস-পত্রগুলো ধরে ধরে নাড়া-চাড়া করে।
টেবিলের ওপর ডাঁই করা বই, খাতা, কলম সব খোলা পড়ে আছে। ও এরকমই। কোন কালেই গুছিয়ে কিছু করতে পারেনা। প্রয়োজন-ও হয়না। মা আর পিসি তাহলে করবেটাই বা কি ? শক্ত মোটা ডাইরী-টা, পেনের ক্লীপ দিয়ে দুভাগ করা। খোলা পাতায়-----চোখ-দুটো স্থির হয়ে আটকে যায়।
অসম্ভব চাপা একটা আর্তনাদে ভাই-বোন দুজনে ছুটে আসে।------------খোলা ডাইরীর পাতার ওপর ছটা চোখ স্থির হয়ে থাকে। দুটি কালির আঁচড়ের ওপর সমস্ত চিন্তা মুখ থুবড়ে পড়ে।
টেবিলের তিনটে কোনা , তিন-জনকে, তিন-ঘরে ছিটকে দেয়। লজ্জায়, ঘেন্নায় সারারাত আর কেউ কারুর মুখ দর্শণ করে না।

( তিন )
প্রতিদিনের মত কেয়াই সমীরকে তোলে। চা দেয়। নিজেকে স্বভাবিক রাখতে চায়। প্রসঙ্গ টেনে আনে,
-"কি করবে, কিছু ভেবেছ?-"
-"আচ্ছা, কেয়া, শুক্লা এ-কি করল? তুমি কি কিছু টের পেয়েছিলে? আমি যে আর এক-দন্ডও এখানে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা কেয়া। সকাল হলেই সব রোগীরা আসতে শুরু করবে কি , করে ওদের সামনে বেরোব? আমি পারব না, পারব না।-"
-"কিন্তু আজ যে তোমায় পারতেই হবে। দুধ-কলা দিয়ে যে কালসাপ পুষেছ, সে-তো সময় মত ছোবল মারবেই।----------এতটা অবশ্য আমিও ভাবিনি।

তবে সেদিন আমার কথা তোমার খুবই খারাপ লেগেছিল। ভেবেছিলে আমার মনটা অত্যন্ত নীচ। থাক , এখন এসব কথা বলার বা শোনার সময় নয়। তবুও বুকের জ্বালা যে নিবতে চায়না-----সমীর!
আমি চলে যাচ্ছি দিদির বাড়ী। না, না, চিরদিনের জন্য চলে যাবনা, পালিয়েও যাবনা, হারিয়েও যাবনা। আমৃত্যু তোমার পাশেই থাকব। এছাড়া পৃথিবীর আজ আর কোন শক্তি নেই , তোমার থেকে আমায় দূরে সরিয়ে দেবার। তোমার দিদির কি , ব্যবস্থা করবে তা তোমরাই ঠিক কোর।------------এখানে বোধহয় আমরা আর মানাতে পারব না। দেখ আমার এই শেষ সিদ্ধান্ত-ও তোমার উচিৎ বলে মনে হয় কিনা? তবে, আরতো কোনদিন তোমায় কিছু বলতে হবে না।

দেওয়ালেরও কান আছে। মাথা ঠোকে, চুল ছেঁড়ে। সমস্ত রাগের উৎস গিয়ে পড়ে অসহায় শরীরটার ওপর। পাগলের মত দাপাতে থাকে,
-"না, না, না. কেউ , কোথাও যাবেনা। কেউ, কোথাও যাবেনা। এবার শুরু হবে আমাদের শেষ যাত্রা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন-পরিজন-------------সব, সব ছেড়ে চলে যাব। চলে যাব সকলের চোখের আড়ালে।
---নির্বংশ আমরা হয়ে যাব নিশ্চিহ্ন।---------------------

( চার )
মাঠ, ঘাট , জল-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সবার পেট চিরে, বুক ফুঁড়ে, একটা দানবের মত হু-হু করে ট্রেন ছুটে চলেছে। ভয় নেই। কোন ভয় নেই। আজ এ কোন দুর্ঘটনা ঘটাবে না। কারণ তিন-তিনটে মৃত্যু-কামী প্রান যে এর পেটে ঢুকে বসে আছে।-----------------দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় কেউ পাশা-পাশি বা মুখোমুখি নই। তিন কামরায় তিনজন। সবই স্বেচ্ছায়। যে যার মত ভাবুক। ভাবনাই তো এখন একমাত্র সম্বল।
ভাবতেও ঘেন্না হয়, আমাদের-ই, এ কি আমাদের-ই সন্তান? তবে সে এত নীচ হয় কি করে? এ কার পাপ? কার পাপ?

আজ তিন-তিনটে মানুষের চোখের জল-ও পর্যাপ্ত নয়, তোদের পাপ ধোওয়াতে। এ তুই কি করলি শুক্লা? পালিয়ে যাচ্ছি, আমরা পালিয়ে যাচ্ছিরে শুক্লা। তোর ভয়ে, তোকে ফেলে এভাবে যে আমাদের পালিয়ে যেতে হবে, এ-তো আগে কখনো ভাবিনি!-------------------এ-কি, সবাই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? সিটের ওপর, হাঁটু-দুটো মুড়ে, নিজের চূন-কালি মাখা মুখ-খানা তাতে আরও সেঁদিয়ে দি।

যদি, যদি আবার ফিরে আসিস? পারবনা, পারবনা, চোখ খুলে তাকাতে।-----------পারবনা সহ্য করতে।------পারবনা ক্ষমা করতে।
আমি জেনে গেছি, আমার সেই ধবধবে শুক্লা আর নেই। যার প্রতিটা স্পন্দনে আমি কেঁপে-কেঁপে উঠেছি, শরীরের প্রতিটা রোমকূপ শিহরিত হয়েছে, রোমাঞ্চিত হয়েছে। আমার সেই শুক্লা হারিয়ে গেছে।

মায়ের কাঁপন সন্তানকে বোধহয় সেভাবে স্পর্শ করেনা। কিজানি? নাকি এসবই পশ্চিমী আলো-হাওয়া-জল গায়ে মেখে বেড়ে ওঠার নিদর্শন? কিন্তু তোদের মূল শিকড় যে আমাদের-ই নরম বুকের মাটিতে পোঁতা ছিলরে শুক্লা?-----------তা-কি একবারও টের পাসনি? কেন? কেন এমন করলি? মূহূর্তের উন্মাদনায় ভেসে গেলি? এমন বিকৃত কামনার বলি হয়ে গেলি? কতদিন? কতদিন লুকিয়ে, লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াবি? নিজের কাছ থেকেতো পালাতে পারবিনা। সেদিন অতীত তোকে ধিক্কার দেবে। ভবিষ্যৎ তোকে চোখ রাঙ্গাবে।
হঠাৎ একটা হাতের প্রবল ঝাঁকুনিতে চমকে উঠি। পাশের মহিলা মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করেন,
-"আপনি কি অসুস্থ? তাহলে এ যায়গাটায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিন।-"
-"না, না, কেন?-"
-"না, আপনাকে দেখে যেন মনে হোল, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, আপনি কেমন কোঁকাচ্ছিলেন।

বিক্ষিপ্ত মন, উল্টো-পাল্টা চিন্তা। ভাল করে কোনটিতে নিজেকে ঠেসে, গোছগাছ করে আবার শক্ত হয়ে বসি। ভুলে যাওয়া কত স্মৃতি, কেমন সারি সারি হয়ে ট্রেনের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে যায়।

জীবনে চাক্ষুষ কোন অভাব হয়ত রাখোনি, তবে জীবনের প্রতিটি পর্ব্বে তোমার অসহযোগিতা আমায় যে কিভাবে তিল-তিল করে খুন করেছে, তা-ও যদি একটু বুঝতে।---------সেটাও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তার মূল্য যে এমন নির্মমভাবে দুজনকেই দিতে হবে, এ যদি জানতাম তাহলে না-হয় আরও একটু বেশীই কঠোর হোতাম ।---------চিরদিন, চিরটা কাল সেই এককাট্টা, এক-গুঁয়েমি বজায় রেখেছ। আমি ডানে বললে, তুমি বাঁয়ে। আমি পাহাড়ে বললে, তুমি সমুদ্রে। এ যেন তোমার একটা জেদ ছিল। তুমি স্বোচ্চার ছিলে, তাই আমি নীরব রয়ে গেলাম। কিন্তু তাতেই -বা কি লাভ হোল? আখেরে আমার ক্ষতিই-তো হোল। আজ নিঃস্ব হয়ে, মুখ পুড়িয়ে, বেঁচে থাকা ছাড়া আর কি-ই-বা করার আছে?

( পাঁচ )
যেদিন গুড্ডু আর ওর মাকে এনে প্রথম এখানে ওঠালে, সেদিন আমি বারণ করিনি। পরে অবশ্য বলেছিলাম, চেয়েওছিলাম।-------------প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক ওদের তুমি একটা আলাদা ব্যবস্থা করে দিও। কথাটার মধ্যে কি-যে এমন অন্যায় ছিল আমি জানিনা। আমার মন বলেছিল, এটাই-তো স্বভাবিক। দূরে থাকলে সম্পর্ক ভালও থাকবে, সুন্দরও থাকবে। যে যার মত স্বাধীনভাবে থাকনা।-----------একটি মানুষ, অন্য মানুষের প্রতিযোগী হবে কেন? পরিপূরক-ও-তো নয়? সে তার নিজের মত একক, স্বতন্ত্র ও সুন্দর হওয়াই-কি বাঞ্ছনীয় নয়? তা-বলে এমন অসুস্থ সম্পর্কতো আমি কখনও কল্পনাও করিনি! এ কি করে সম্ভব?

( ছয় )
কাঠগোদামের আগের স্টেশন হালদুয়ানীতে নেবেই টের পাই পিঠের ব্যাথাটা ক্রমশ যেন ছড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গে ওষুধ ছিল, খেয়েনি। রুক-স্যাক পিঠে চাপাতেই আবার শুরু হয়। যাক্, বেশীক্ষন হাঁটতে হবেনা। দিনের একমাত্র বাস চেপে সরযূ ও গোমতী নদীর তীরে পূণ্য শৈব-তীর্থ বাগেশ্বরে এসে পৌঁছাই।
না হাঁটলেও, পাহাড়ী রাস্তায় এতক্ষনের বাসের ধকলে ব্যাথাটা আবার চাগিয়ে ওঠে। জানিনা আমাকে নিয়ে এবার শিবের কি ইচ্ছা। কতদিনের প্ল্যান, প্রোগ্রাম, কতরকম ব্যাবস্থা, সব বুঝি ভেস্তে গেল। ঠান্ডায় পিঠের ব্যাথা ক্রমশ যেন বুককেও খামচে ধরছে।
ঠিক হয়েছে। যেমন শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে ঢোকা? বাগেশ্বর থেকে সঙ্গীদের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে, খালি হাতে সাং পর্যন্ত আসতেই দম বেরিয়ে যায়। ওরা দেখছি এখন-ও কেমন ফুল-স্ট্যামিনা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে।----------উঠুক, উঠুক। আমার ব্যাথা যত বাড়ছে ওদের স্ফূর্তি-ও তত বাড়ছে। আসলে প্রথম থেকেই আমাকে ওদের দলে নেওয়ার মোটেই ইচ্ছা ছিলনা। শেষ পর্যন্ত ওদের দলের-ই একজন আসতে না পারায়, তার যায়গায় আমি ঢুকে পড়ি। পরিস্থিতি মনে হয় তাদের-ই অনুকূলে।----------------যা বাবা যা। আমার আর পাহাড় বেয়ে কাজ নেই। আমার ভাল-মত-ই আক্কেল হয়েছে। যা তোরাই ভালভাবে ঘুরে আয়। কেউ তো আর দেখতে আসছেনা , আমি কতটা উঠেছি। ঘুরে গিয়ে তোরা যা গল্প করবি, আমিও তাই বলব। বরং তার চাইতেও বেশীই বলব। বয়সের একটা অভিজ্ঞতা আছে না?

( সাত )
শুরু হোক পথ চলা, থেমে যাক কথা বলা। প্রথম দিন সাং থেকে চার কি।মি হেঁটে "-লোহার ক্ষেত-" দ্বিতীয় দিন নয় কি,মি পথ খাড়া চড়াই বেয়ে, আর দুই কি,মি উৎরাই নাবতেই ঢাকুরী।
লোহার-ক্ষেত ও ঢাকুরীতে দুই রাত কাটিয়ে একটু যেন আরাম বোধ-হয়। ঢাকুরী থেকে চার কি,মি পেরুতেই উমলা থেকে পথ পৃথক হয়েছে আমাদের গন্তব্য-স্থল সুন্দর-ডুঙ্গার দিকে।
শুনেছি রং-বেরঙ্গের পাথরের জন্য এই সুন্দর-ডুঙ্গার প্রশস্তি আছে। চলার কোন নিদ্দিষ্ট পথ নেই। বোল্ডার পেরিয়ে, গাছ সরিয়ে চলতে হয়। পথ খুবই দুর্গম। পাহাড়ী অভিজ্ঞতা ছাড়া সাধারনের জন্য নয় সুন্দর-ডুঙ্গা।
তৃতীয় রাত ৮৫০ ফুট উঁচু হাতোলিতে পৌঁছে বুঝি, এ যাত্রায় আমার পক্ষে আর এগোন সম্ভব নয়। হাতোলি এ পথের শেষ গ্রাম। ভুজ গাছের ফাঁকে-ফাঁকে পাহাড়ী ফুলেদের জলসা। এরই মাঝে পশ্চিম থেকে সুকরীম নালা আর পূব থেকে মাইকতোলি নালা এসে মিলিত ধারায় জন্ম নিয়েছে সুন্দর-ডুঙ্গা নদী।

এতক্ষনে আমার জন্য সত্যি-সত্যিই তারা সকলে চিন্তিত হয়। নিজের শরীরের ওপর আর ভরসা রাখতে পারিনা। অবশেষে এই গ্রামেরই এক গাইড পুষ্কর সিং এর বাড়ীতে আমার থাকার ব্যাবস্থা করে, সঙ্গীরা সব এগিয়ে যায়।--------ওরা না ফেরা পর্যন্ত অচেনা পাহাড়ী মানুষের বন্ধু হয়ে , হাতোলি গ্রামে ঘুরে বেড়াই। চার পাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটি নিরিবিলি গ্রাম। যেদিকে তাকাই হলুদ আর হলুদ রাম-দানার গাছ যেন ঢেকে রেখেছে। ওদের হাতে গড়া এই রাম-দানার আটার রুটীও খেয়েছি। সে যে কি মিষ্টি স্বাদ, সে আর কি বলব।

সামনেই তুষার ধবল হিমালয়। এক নয়নাভিরাম পরিবেশ। পাইন, ফার্ন, রডোডেনড্রন, আখরোট আর বন্য ফুলেদের বাসর সাজান পথে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে যাই সব দুঃখ। হিমালয়ের এই হিম সৌন্দর্যে মন খারাপ করে কার সাধ্যি? এসব জায়গার মানুষ বড় সহজ-সরল। একটুক্ষনেই কেমন আপন করে নেয়। আমার ব্যথা উপসমের জন্য তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। সকলেরই একমাত্র ভরসা তাদের ডাক্তার-সাব। অগাধ বিশ্বাসে আমাকেও নিয়ে যায় তাদের সেই ধন্বন্তরী ডাক্তার-সাবের কাছে। সত্যি, ওষুধে বেশ কাজও হয়। মনে মনে ভাবি, আর একদিন আগে দেখা হলে, আমি হয়ত আরও কিছুটা উঠতে পারতাম। অবশ্য তাতে বিপদও ছিল। কারণ এরপর হাঁটা পথে আর কোনও বসতি নেই। সবই জানা। সুতরাং সেটা আরও বিপজ্জনক হোত। যাক্, মঙ্গলময়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।

হাঁড়-কাপুনি শীতে এখানে মানুষের চোখ, নাক আর ঠোঁট ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। তবুও কেন জানি ভদ্রলোককে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি বলে মনে হয়। খুবই কম কথা বলেন। অহেতুক একা একা আর কত কথা বলা যায়? পাহাড়ী দোস্তরাও সব তাদের রুজী-রোজগারের ধান্দায় ঘোরে। আমাকে সঙ্গ দিলেতো আর তাদের পেট চলবে না। তাই ঘুরে-ফিরে ডাক্তার-বাবুর আস্তানাতেই ফিরে-ফিরে যাই। বিরক্ত হন বলেতো মনে হয়না। তবে আমন্ত্রণও জানান-না।

( আট )
কাল হোল, সেদিনের সেই উপভগ করা চড়া রোদ্দুর।
পাহাড়ী শীত যতই হাড়কে অবশ করুক না কেন, বরফ ঠিকরোন তেজী রোদ কিন্তু এক নিমেষেই ঝলসে দেয়। সর্বক্ষন চেপে থাকা টুপি, মাফলার, কোট সব আলগা করে, ভুজ গাছের ছাওয়ায়, ভদ্রলোক বোধহয় চোখ বুজে একটু রিলাক্স করছিলেন।-----------------কাছে যেতেই, অবাক চোখে চেয়ে থাকি, শুক্লার বাবা না?-----------

দীর্ঘ দশ বছর আমাদের একতলায় ভাড়া ছিলেন। বছর পাঁচেক আগে, সন্তোষপুরে কোথায় একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন। বলেন, সেখানে চলে যাবেন। যাওয়ার আগে জিনিস-পত্র সব পাঠিয়ে দিয়ে, কিছুদিন দিল্লীতে দাদার বাড়ীতে কাটিয়ে আসবেন বলে শুনেছি। নতুন বাড়ীতে ফিরে এসেই সবার সাথে যোগাযোগ করবেন।

ব্যাস্, সেই থেকে ডাক্তার-বাবু নিখোঁজ। এত বড় শহরে আর তাঁর দেখা পাইনি। প্রথম প্রথম বাড়ীতে নিজেদের ভেতরেই আলোচনা করেছি। ডাক্তার মানুষ বলে কথা। পাড়াতে সকলেরই পরম-বান্ধব ছিলেন। আর সত্যিই অতি সজ্জন , অমায়িক ছিলেন ভদ্রলোক। স্বামী, স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে শুক্লা। শেষের দিকে ডাক্তার-বাবুর এক দিদিও, তার এক ছেলে গুড্ডুকে নিয়ে ওনাদের সাথেই থাকতেন। অত্যন্ত ভদ্র পরিবার। দিন যেতে যেতে প্রতিবেশীদের কৌতূহলেও ভাটা পড়ে। নিত্য দেখা মানুষই মনে রাখেনা। আর অদেখা প্রতিবেশীর স্মৃতি কে-ই-বা বয়ে বেড়ায়?

প্রায় মুছেই গেছিল। সকলে ভুলেও গেছিল। হঠাৎ বাচ্চা কোলে শুক্লা আর গুড্ডু যদি সেদিন সেখানে উদয় না হোত । মা-বাবার খোঁজে আসতেই বিষয়টা সকলের চোখে পরিষ্কার হয়ে যায়। নেহাত-ই নিষ্কলুষ জীবন যে নয়, সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়না। পৃথিবীতে কোন সম্পর্কই বোধহয় চূড়ান্ত নয়।-------------নতুন ঠিকানা রেখে চলে যায়------------

( নয় )
চোখ খুলেই , আমায় দেখে আঁতকে ওঠেন,
-"একি, আপনি? এখানে? এখানে কেন? কেন এসেছেন? বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান।-"
সহসা এমন রোষের উপলক্ষ্যে, ডাক্তার বাবুর স্ত্রী ও দিদিও বেরিয়ে আসেন। তিনটে মানুষ নয় , যেন তিন তিনটে স্থির মূর্তি। অসাঢ়, অনড়, পাথর। লজ্জায়, অপমানে সরে পড়ি।

ভ্রমনে আর স্বাদ নাই। সৌন্দর্য্যে আর লিপ্সা নাই। পরদিন ভোরে টিলার ওপর একাই বসে আছি। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। কি দেখতে এলাম, আর কি দেখলাম? অযথা কারুককে ব্যাথা দেওয়াতো আমার কাম্য নয়। যাত্রার শুরু থেকেই লক্ষ্য করছি, বিধাতা আমার সাথে যেন একরকম শত্রূতা করে চলেছেন। দুষ্মন-রূপী এক শনি-গ্রহ যেন আমার ওপর ভর করেছে। আমাকে এই অকুতো-স্তলে টেনে না নিয়ে এলে তার এমন কি ক্ষতি ছিল?

একেই বলে ভোগ ।-------------------- আজ ডাক্তার-বাবু নিজেই এসে পাশে বসেন। আর কথা এগোয় না। দুজনেই চুপচাপ। তাতে কিছু যায় আসে না। নীরবতার -তো একটা ভাষা আছে। ক্রমশ এই শব্দ-হীন অস্তিত্ব, এই থেমে থাকা, পরস্পরের কাছে যথেষ্ট মনে হয়।

টুকরো টুকরো নিঃশ্বাস পাহাড়ের গায়ে ঘা খেয়ে আবার ফিরিয়ে দেয় নিজেদের। এক সময় সমীর বাবু নিজেই শুরু করেন।

( দশ )
তৃপ্তি বাবু, আজ পাঁচ পাঁচটা বছর, আমরা এই তিনটে প্রাণী বোবা হয়ে এই পাহাড়ের গহ্বরে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছি। জানোয়ারের মত, মানুষ দেখলে ভয় পাই। এ জীবন-যাপন নয় তৃপ্তি বাবু, এ জীবন-যাপন নয়। এ জীবন হনন। প্রতিটা মূহূর্ত জীবনটাকে কেটে-কেটে ছোট করে আনছি, আর রক্তাক্ত হচ্ছি।
পোড় খাওয়া প্রৌঢ়ত্ব, সংগ্রামে অটল। এতটুকু বাঁধ ভাঙ্গেনা। কেবল অস্থির চিত্তে দীর্ঘ হাত দুখানি কোলে নিয়ে, বারবার মুঠি খোলে আর বন্ধ করে।

--"জানেন, শুক্লা দশমীতে জন্মেছিল বলে, আমার মা, ওর নাম রেখেছিল শুক্লা।------------------আচ্ছা, একই মুখ, একই মন, একই সাথে এতখানি সুন্দর ও কদর্য হয় কি করে বলুন তো?--------------
চেয়ে থাকা বা শুনে যাওয়া ছাড়া আজ যে আমার আর জানার কিছুই নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা প্রত্যক্ষ করি, জীবনে চূড়ান্ত সফল ব্যাক্তিরাই সংসারে প্রিয়জনের কাছে একটি বড় মানের শূন্য। মূল্যহীন।------------তবুও না বলে পারিনা। দেখি না একবার চেষ্টা করে। আগুনে আগুন নেভে।
জীবনে জীবন খোঁজে।

--"ডাক্তার-বাবু, আপনি কি শুক্লাকে দেখতে চান?----------"
গ্লানি যে মানুষকে কতখানি ক্ষিপ্ত করে,
কতখানি তিক্ত করে, রিক্ত করে, তা সেদিন আমি চোখে দেখে ছিলাম।
---"কেন? কেন? আমার ঘরে একটা আয়নাতো এখনো আছে----------------"
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:৪১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×