একটি পেন্সিলের খোঁচা, একটি লোকের ‘নিকাশ’
১৫ই এপ্রিল ঢাকায় ঘোরার সময় ইকবাল হলের ছাদে আমি চারটি ছাত্রের গলিত মাথা পড়ে থাকতে দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক জানান যে, তাদের হত্যা করা হয়েছে ২৫শে মার্চের রাত্রে। দুটো সিঁড়ি এবং চারটি ঘরে প্রচুর রক্তপাতের চিহ্নও আমি দেখেছি। ইকবাল হলের পেছনে একটি বিশাল আবাসিক ভবন সেনাবাহিনীর বিশেষ মনোযোগ পেয়েছিল বলে মনে হল। বিশাল দেয়ালগুলো গুলিতে ঝাঁঝরা এবং সিঁড়িতে বাজে গন্ধের রেশ রয়ে গেছে, যদিও এখানে প্রচুর ডিডিটির গুঁড়ো ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান ২৩ জন নারী ও শিশুর মৃতুদেহ মাত্র ঘন্টাখানেক আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গাড়িতে করে। ২৫ তারিখ থেকেই ছাদের ওপর লাশগুলো পচছিল। অনেক প্রশ্নের পর জানা গেল হতভাগ্যরা ছিল কাছের হিন্দু-বাড়ির। এই ভবনে তারা আশ্রয় নিয়েছিল।
এই গণহত্যা সাধন করা হয়েছে নিতান্ত নির্বিকারভাবে। ১৯শে এপ্রিল সকালে কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে থাকার সময়ে আমি দেখেছি এ-সমস্ত নির্দেশ কী নির্মমতার সঙ্গে দেয়া হয়। এক বিহারী সাব-ইন্সপেক্টর বন্দিদের একটি তালিকা নিয়ে এল। ওটার দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে চারটি নামের পাশে পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে আগা বললেন, “সন্ধ্যার সময় এই চারজনকে নিকাশের জন্যে নিয়ে এসো।” তালিকার দিকে তাকিয়ে আবার তিনি পেন্সিলের দাগ বসালেন, “এই চোরটাকেও নিয়ে এসো ওদের সঙ্গে।”
মৃত্যুর ঐ আদেশ দেয়া হলো নারকেলের দুধ খেতে খেতে। আমাকে জানানো হল যে বন্দিদের দুজন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন এক আওয়ামী লীগ নেতা। ‘চোরটি,’ জানা গেলো, নিজ বাড়ীতে তার বন্ধুকে থাকতে দিয়েছিল। পরে সন্ধ্যার দিকে দেখলাম একটি দড়ি দিয়ে হাত-পায়ে শিথিলভাবে বেঁধে সার্কিট হাউজগামী রাস্তা দিয়ে ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারফিউর কিছু পরে সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাখিদের একটি দল কাছে কোথাও কিচিরিমিচির করছিল, হঠাৎ গুলির তীব্র শব্দে তাদের খেলায় ছেদ পড়ল।
বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমতকে নিয়ে প্রায়ই মেসে দুটো ব্যাপার আলোচনা করা হতো। একটি হলো ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজার এডিসি হিসেবে ওর চাকরি। অপরটি নিয়ে ওর সহকর্মীরা ওকে পেয়ে বসতো। জানা গেল আজমত দলের একমাত্র অফিসার যে কোনো ‘খুন’ করেনি। মেজর বশির তাকে নির্মমভাবে খোঁচাতো। “এই যে আজমত,” এক রাতে বশির তাকে বললেন, “কাল আমরা তোমাকে মানুষ করতে যাচ্ছি। কাল দেখব তুমি তাদের কেমন ধাওয়া দিতে পারো। ব্যাপারটা খুবই সোজা।” এই অসামর্থ্যরে জন্যে বশির তার সঙ্গে লেগেই থাকতেন। এসএসও-র চাকরি ছাড়াও বশির হেডকোয়ার্টারে ‘শিক্ষা কর্মকর্তা’ ছিলেন। তাকেই একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার দেখেছি, যে অনর্গল বাংলা বলতে পারতো।
শুনলাম বশিরের কাছে এক দাড়িঅলা একদিন সকালে তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে এসেছিল। তার ভাই ছিল কুমিল্লার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা। কিছুদিন আগে পাকসেনারা তাকে বন্দি করেছিলো। বশির তাকে জানালেন, “দৌড় গ্যায়া, পালিয়ে গেছে।” বুড়ো লোকটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কীভাবে ভাঙা পা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমিও না। এ-ঘটনা বলে লম্বা হাসি দিয়ে মেজর বশির আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। পরে জেনেছি ওদের নিজস্ব ভাষায় ‘দৌড় গ্যায়া’ মানে হলো, “পালানোর সময় গুলি করে খুন।”
আমি জানতে পারিনি ক্যাপ্টেন আজমত কাউকে খুন করতে পেরেছিলেন কি না। চট্টগ্রামের সত্তর মাইল উত্তরে ফেনীর কাছে কুমিল্লা সড়কে বাঙালি-বিদ্রোহীরা পরিখা খনন করেছিল, সে-এলাকার সব ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে ৯ম ডিভিশনের চলাচলকে সীমিত করে রেখেছিল। ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড থেকে একের পর এক বাজে খবর পেয়ে জেনারেল রাজা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়া রদ করার জন্যে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত-অঞ্চল বন্ধ করে দেয়া। অথচ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছানো অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যে বর্তমানে একমাত্র পথ হিশেবে উন্মুক্ত রাখাও দরকার হয়ে পড়ে। তাই জেনারেল রাজা সহজেই উত্তেজিত হয়ে যান। সেখানে তিনি উড়ে যেতেন প্রায় প্রত্যেক দিনই। ফেনীর ভেঙে পড়া ব্রিজ নিয়ে বকবক করতেন দীর্ঘসময় ধরে। ক্যাপ্টেন আজমত সবসময়ের মতো তখনো জেনারেলের ছায়া। আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। পরবর্তী তিন সপ্তাহর জন্যে খোঁচা থেকে আজমত মোটামুটি রক্ষা পেয়েছিল। ফেনী ও সংলগ্ন অঞ্চল ৮ই মে ৯ম ডিভিশন আয়ত্তে আনতে পারলো। বাঙালি বিদ্রোহীরা বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এতোদিন সেখানে অবরোধ দিয়ে রেখেছিলো। শেষমেষ তারা সীমান্ত টপকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়।
৯ম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের জি-১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসলাম বেগ ভারি অস্ত্রসহ বাঙালি বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়ার খবরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, “ভারতীয়রা তাদের ওখানে একদমই থাকতে দেবে না। ব্যাপারটা তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে। সীমান্ত-অঞ্চলে তারা যত হামলা করবে আমরা তত ভোগান্তির শিকার হব।” পাক-ভারত যুদ্ধের সময় চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার। তিনি ছিলেন একজন গর্বিত পরিবারের সদস্য। তিনি ফুলও পছন্দ করতেন। আমাকে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, কুমিল্লায় এর আগের পোস্টিং-এর সময় চীন থেকে আনিয়ে হেড কোয়ার্টারের উল্টোদিকের পুকুরে তিনি টকটকে লাল রঙের বিশাল জলপদ্ম রোপন করেছিলেন। মেজর বশির তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বশির আমাকে জানালেন, একবার এক বিদ্রোহী কর্মকর্তাকে ধরা হলো। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল, তাকে নিয়ে কী করা যায়। অন্যরা যখন নির্দেশ পাবার জন্য টেলিফোনে খোঁজখবর করছেন তিনি সব সমাধান করে ফেললেন, দৌড় গ্যায়া। শুধু ওর পাটুকুই গর্তের বাইরে বের হয়ে ছিল।
পরিব্যাপ্ত শ্যামল সৌন্দর্যের মধ্যে কী পাশবিকতা চলছে, তা কল্পনা করাও অসম্ভব। এপ্রিলের শেষ দিকে আমি যখন সেখানে যাই, তখন কুমিল্লা ধ্বংস¯তূপ। পথের দু’পাশের সবুজ ধানক্ষেত দিগন্তে রক্তিম আভার আকাশে গিয়ে মিশেছে। গুলমোহর, ‘অরণ্যের বহ্নিশিখা’ ফোটার সময় এসে গেছে। গ্রামের আম আর নারকেল গাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। এমন কি রাস্তার পাশে ছাগলের দৌড়ঝাঁপও প্রমাণ করছিলো প্রকৃতিক বাংলার পূর্ণতা। “পুরুষ আর স্ত্রীগুলোকে আলাদা করার একমাত্র উপায় হলো,” আমাকে ওরা বললো, “মেয়ে ছাগলগুলো গর্ভবতী।”