somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বোধোদয়

০৯ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাকে দেখে বাবা বেশ অবাক হলেন। অবশ্য অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রায় দুই মিনিট আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন।
‘কীরে তোর না আজ পরীক্ষা?’ অবশেষে কথা বের হলো বাবার মুখ থেকে।
‘কলেজে খুব মারদাঙ্গা হয়েছে, পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। হোস্টেলে থাকাটা নিরাপদ নয় তাই কিছু বইপত্র নিয়ে চলে এসেছি।’ উত্তরটা আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম।
‘ভাল করেছিস। যা কাপড়-চোপড় ছেড়ে, হাতমুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নে।’ বলল বাবা, ‘আর কিছু সময় আগে আসলেই তো তোর মায়ের সাথে দেখা করতে পারতি।’ বারান্দায় মাদুরের উপর শুয়ে থাকা বাবাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলাম। আমি ইচ্ছে করেই কিছু সময় দেরি করে এসেছি যাতে প্রথম দেখাটা মায়ের সাথে না হয়।
মাকে আমি এখনো খুব ভয় পাই। মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। আমি আমার কলেজে স্যারদের মোটেও ভয় পাইনা কিন্তু আমি যে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলের স্যার-আপাদের এখনো ভয় পাই। ব্যাপারটা হাসির হতে পারে কিন্তু সত্য।
আমার বাবাও একসময় হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমি যে হাইস্কুলে পড়েছি সেই হাইস্কুলের না, অন্য একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। তাই হয়ত বাবাকে অতটা ভয় পাইনা।
‘আমার পাশে একটু বসতো। তোকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কী হয়েছে আমাকে সব খুলে বল।’ টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢোকার সময় বাবা হয়ত আরো কিছু বলত, তাহলে আমিও কিছু মিথ্যে কথা বলতাম, কিন্তু পাশের বাড়ি থেকে দাদি আসায় তা আর হলো না। কীরে রাহাত, তুই আবার কোন সময় আলি? তোর মা যি আজ সকালে আমারি বলল, আজকি তোর পরীক্ষা। তা তুই পরীক্ষা ফেলি বাড়িতে আলি ক্যান? দাদিও সবিস্ময়ে আমাকে একই প্রশ্ন করল।
প্রশ্নের উত্তরটা আমাকে দিতে হলোনা। বাবাই দিলেন।
‘তুই কি কিছু খায়েছিস?’ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন দাদি।
‘না দাদি, এখন কিছু খাব না। আমি ঘরে যাচ্ছি। আমার একটু রেস্ট নেয়া দরকার।’ এতটুকু বলেই বারান্দা থেকে উঠে ঘরে গেলাম। বিছানায় পড়তেই চোখ বুজে এল।
দুপুর দুইটার দিকে দাদির ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। ঘুম থেকে জেগে শুয়ে থাকলাম আরো প্রায় আধাঘন্টা। এই সময়টাতে গত একদিনের সব ঘটনা ক্রমান্বয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
আমাদের নেত্রীর ছবির অসম্মান। যার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ওই গ্রুপের উপর হামলা।
আমাদের সভাপতি কামরুল ভাইয়ের উপর হামলা। কামরুল ভাইয়ের আহত হওয়া।
প্রতিশোধস্বরূপ ওই গ্রুপের লিডার কবিরের হাত কেটে ফেলা।
এরপর হোস্টেল থেকে আমার স্টেশনে চলে আসা। স্টেশনে চার ঘন্টা অপেক্ষা করা। ট্রেনে ওঠা।
নজিপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামা। এই স্টেশনেও দুই ঘন্টা বসে থাকা।
সবশেষে মা বের হয়ে যাবার পর বাড়িতে ঢোকা।
‘ও রাহাত ভাই, গোসল- টোসল কিছু করতি হবি না?’ দাদির ডাকে বিছানা ছাড়লাম।
গোসল সেরে বাবার সাথে ভাত খেতে বসলাম। বাবা প্যারালাইসিস হয়ে আছেন চার বছর ধরে। সারাদিন বারান্দায় মাদুরের উপর শুয়ে থাকেন।
‘ও ভাই, তুমি ওসব মারামারির মধ্যে জড়াতি যাইওনা বুঝিছো।’
‘না না, আমি ওসবের মধ্যে থাকি না।’ ভাত খেতে খেতে খাঁটি মিথ্যে কথা বললাম।
আমি ছাত্র-রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর বেশ মারামারি করেছি, তবে হাত কাটাকাটি এই প্রথম। তাছাড়া নেত্রীর অসম্মান নিয়ে কথা। শুধু যে কবিরের হাত কাটা হয়েছে এজন্য ওদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আরো বেশি কিছু হতে পারত।
খাওয়া শেষ করে আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটা সিগারেটের জন্য বুকের ভিতরটা আইটাই করতে লাগলো। আগে সিগারেট খেতাম না। কী উজবুকই না ছিলাম তখন। গ্রুপের সবার দেখাদেখি সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। এখন প্রতিদিন সাত-আটটা না হলে চলেনা। কিন্তু এখন সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে কিনা চিন্তা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম মা বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো। সিগারেটও খাওয়া হবে, মোবাইলে কিছু টাকাও তুলে ফেলব কোন এক ফাঁকে।
পকেটে মোবাইল এখন দু’টো। একটা সাধারণ মানের সেট আগে থেকেই ছিল। নতুন মডেলের বেশ দামি একটা সেট কিনেছি কিছুদিন আগে। মা বাড়ি থেকে প্রতিমাসে যে পাঁচ হাজার টাকা পাঠান, গত তিন মাস থেকে সেই টাকা মোটেও খরচ হয়নি। এখন আর মেস ভাড়া দিতে হয়না। বাড়িওয়ালা আরো সকাল-বিকাল খোঁজ নিয়ে যায় কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। বই-খাতা কেনা, কলেজের ফি দেয়া, পরীক্ষার ফি দেয়া বাদ দিয়েছি কয়েকমাস আগে থেকেই। ক্যান্টিনের চাচাও আর বিল চায় না। রিকশাওয়ালারাও ভাড়া নেয় না। সবাই সম্মান করে। সালাম দেয়। মাস শেষে দেখা যায় মায়ের দেয়া টাকাতো খরচ হয়নি বরং চান্দা-টান্দা তুলে মানিব্যাগের সাইজ আরও বড় হচ্ছে। তাই তিন মাস টাকা জমিয়েই নতুন মোবাইল সেটটা কিনে ফেললাম।
সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল।
মা, ছোটবোন শারমিন সবাই ততক্ষণে বাড়িতে ফিরে এসেছে। মায়ের চোখজোড়া দেখেই বুঝলাম তিনি বাবা আর দাদির কাছ থেকে শোনা কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছেন। মায়ের দৃষ্টিতে অবিশ্বাসের কোন ছায়া নেই।
রাতের বেলা ভাত খেয়ে আমার ঘরে অলসভাবে শুয়েছিলাম। মা আমাকে ঘুমন্ত ভেবে হারিকেনটা ওনার ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার ঘরের ডানপাশের ঘরটিতে বাবা-মা থাকে আর বামপাশের ঘরটিতে থাকে দাদি আর ছোটবোন।
মা হারিকেন নিয়ে যাওয়ার পর মোবাইলে গেইম খেলতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই খেলায় মন বসছিল না। শুধু আমাদের নেত্রীর মুখচ্ছবিটা ভেসে উঠতে লাগলো আমার চোখের সামনে। আমার জানামতে বিশ্বের সবচেয়ে সংগ্রামী মহিলা। কত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে এই মহিলাটিকে। তার তুলানায় আমার এই সামান্য কষ্টতো কিছুই না। এই মহান মহিলার মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্র রাজনীতি করি বলে গর্ববোধ করতে লাগলাম।
হঠাৎ মা-বাবার কথা শোনা গেলঃ
‘রাহাত কি ঘুমিয়েছে?’ বাবার ঘরঘরে কণ্ঠস্বর।
‘হ্যাঁ, রাহাত, শারমিন, আম্মা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।’ মা বললেন।
‘এগুলো কিসের টাকা?’ আবারও বাবার প্রশ্ন।
‘তোমার জন্য একটা শার্ট কিনতে হবে এই মাসে।’ মায়ের গলা শোনা গেল।
‘আমি তো সারাদিন বারান্দায় শুয়ে থাকি। আমার কোনো শার্টের দরকার নাই। তোমাকে তো প্রতিদিনই বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, তোমার বরঞ্চ একটা শাড়ি কেনা উচিত। এই শাড়িটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে।’ বাবা বললেন।
‘এই শাড়ি দিয়েই আমার আরও একবছর যাবে। তুমি যখন শার্ট কিনতে চাচ্ছ না তাহলে আর বাদ দাও।’ মায়ের কণ্ঠস্বর খুব স্বাভাবিক যেন এই ধরনের আলাপ আলোচনা প্রায়ই হয়, ‘টাকাগুলো আজেবাজে কাজে খরচ না করে বরং টাকা জমানোর কৌটাটাতে রেখে দেই। সামনের মাসে তাহলে প্রথম সপ্তাহেই রাহাতের কাছে টাকা পাঠানো যাবে। গত মাসের মত এর কাছে ওর কাছে হাত পাততে হবেনা।’
‘এর উপর শারমিন নাইনে উঠেছে ওর খরচও বেড়ে যাবে এখন। আমাদের জন্য শার্ট-শাড়ি কিনে কোনো লাভ নাই। আমাদের দিন তো বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন ওদের জন্য চিন্তা করা দরকার।’ বাবার ঘরঘরে গলা শোনা গেল আবার।
মোবাইলটা আমার হাত থেকে বিছানায় পড়ে গেল। কে যেন আমার বুকের ভিতরের কলিজাটাকে কুচিকুচি করে কাটতে লাগল। এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস। আমার চোখের সামনে নেত্রীর পরিবর্তে ভেসে উঠল আমার মায়ের সদাগম্ভীর মুখ। আমার মনে হলো, মা কারো চেয়ে কোনো অংশে কম নন বরং নেত্রীর চেয়ে অনেক বেশি অনেক।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×