ঘন্টাখানেক আগের ঘটনা। কার্জন হল থেকে রিকশা যোগে ফিরছিলাম আমার নিবাস সুর্যসেন হলে। ভাড়া ঠিক না করেই রিকসায় উঠে বসি। চলিশোর্ধ্ব চালক নির্বিকারভাবে রিকসা চালাচ্ছিল। টিএসসি পার হয়ে ভাষা ইন্সটিটিউশন মোড় নেয়ার সময় অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে চালক জিজ্ঞাসা করল, ‘মামা কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েন?’
-জ্বি , গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা।
-কোন ইয়ারে? পাল্টা প্রশ্ন।
-এইতো ৬ষ্ঠ সেমিস্টার শেষ হচ্ছে।
-কিছুণ নিরব থেকে কলাভবনের সামনের দিকটার দিকে ইঙ্গিত করে,‘দেখছেন কী সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা। রাতের বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই অপূর্ব!’
-হ্যাঁ, সত্যি বলছেন, বলে তার কথায় আমি সায় দেই।
-তারপর মিনিট পাঁছেকের নিরবতা। ততণে আমরা মল চত্বরে চলে এসেছি। রিকসা চলছে। আর কয়েক মিনিট পরেই আমার হলে পৌছে যাব।
-তার পর আবার তার কন্ঠ বেজে উঠল। শোনেন মামা, ‘আপনি একটা ভাল বিষয়ে পড়েন।’ সরকারি হলে থাকেন। জনগণের দেয়া করের টাকায় অনেক সুবিধা ভোগ করেন। ভালো কথা। একটা রিকোয়েস্ট করি আপনাকে। সময়, অর্থ ও জীবন ব্যয় করে অযথা কাজ করবেন না। এমন কিছু করেন যাতে নিজে এবং যাদের টাকায় সুবিধা নিচ্ছেন উভয়ই লাভবান হন। দেখবেন, ভালো থাকবেন। আর সবার আগে নিজের কাছে স্বচ্ছ ও মুক্ত থাকুন। সময় ও কালকে অতিক্রম করে জনসমুদ্রের মাঝেও ভিন্ন জগতে বাস করা যায়। ইচ্ছার উপর অন্য কোনো বড় শক্তি নেই। স্বচ্ছতা আর স্বাধীনতার উপর ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে। পৃথিবীর সকল বড় মানুষই নিজের কাছে সৎ ও মুক্ত ছিলেন। আর মানুষকে মুল্যায়ন করবেন। নয়তো মানুষ হতে পরবেন না। কেননা,ওজনে ওজন হয়।
-তার প্রাজ্ঞতাপূর্ণ কথার মাঝে কখন যে আমি লীন হয়ে গেছি টেরই পাইনি। ততণে রিকসা এসে আমার হল গেটে দাঁড়িয়েছে। আমি মুর্তির মত নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম।
-এরপর রিকসা ঘুরিয়ে লোকটি যেদিন থেকে এসেছে সেদিকে চলতে শুরু করে।
-প্রথম বর্ষের একদল ছাত্রের হৈ হুল্লোড়ে আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে পিছনে তাকালাম। ততণে রিকসাটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তারপর নিজের অজান্তেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। হায়! এতণ আমি কার কথা শুনেছি। একি কোনো রিকসা চালক নাকি সাাৎ দার্শনিক! এত চমৎকার বোধের রিকসা চালকতো আগে কখনো চোখে পড়েনি! যাহোক তার অনুরোধের কথাগুলো রাখতে পারব কীনা তা জানিনা। এছাড়া তার কিছু কথা আমার কাছে নিগুঢ় মনে হয়েছে। ভাবালু উদাস গলায় বলা এ কথার অধিকাংশেরই অর্থ আমি বুঝতে পারিনি। তবে আকস্মিক ঘটে যাওয়া পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি একটা জিনিষ বুঝতে পেরেছি। তা হলো, এ চালক কোনো সাধারণ লোক নয়। নি:সন্দেহে অসাধারণ! ঘটনাটি হয়তো আজব এ শহরের অসংখ্য দুবোধ্য বিষয়ের মধ্যকার একটি। এ সান্ত্বনা নিয়ে অমীমাংসিত চিন্তায় মাথা ভর্তি করে ৮ টি সিড়ির ৫৬ টি ধাপ বেয়ে নিজ নীড়ে ফিরে এলাম। প্রতিটি সিড়ি ঠিঙ্গাতে গিয়ে আকস্মিক এ রহস্যের জন্মদাতা সেই রিকসা চালকের মুখ স্বরণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাহ! স্মৃতি বরাবরের মত এবারো আমার সঙ্গে প্রতারণা করল। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধান। কিন্তু আমি তার চেহারা ভুলে গেছি। অথচ এত দ্রুত আমি কিছুই ভুলি না। সত্যিই অসাধারণ!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ৮:২৭