somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফরহাদ মাজহার এর এই লেখার উপরে সামুর জ্ঞানি ভাইদের কমেন্ট চাচ্ছি

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ রাত ২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাই এই লেখাটা পড়লাম।আফনারাও পইরা এইখানে কিছু জ্ঞানি কমেন্ট ঝারেন :):):):)


বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ যে চরিত্র গ্রহণ করেছে, তাতে শাহবাগের রাজনীতি ও আচরণের বিপরীতে বিপুল মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মাহমুদুর রহমান এ ক্ষোভের প্রতীক হিসেবে গণমানুষের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন। আমরা অবশ্যই সেই প্রিয় মানুষ মাহমুদুর রহমানের তিনটনারও প্রকাশিত বই নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি। তার বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে পৃষ্ঠাবন্দি লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা করা গেলে সুবিচার হতো। কিন্তু গত কয়েক দিনে বেশকিছু ঘটনা ঘটে গেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের লক্ষণ এতে ফুটে উঠেছে। ফলে এ অনুষ্ঠানের সময় গত কয়েক দিনে যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে, তা আমাদের সবারই চিন্তা দখল করে আছে। সেই পরিবর্তনে, আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, মাহমুদুর রহমান এবং দৈনিক আমার দেশ এখন রাজনীতিতে এক নির্ধারক ভূমিকা পালন করছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, মাহমুদুর রহমানের বই নিয়ে আলোচনা করতে এলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা ছাড়া উপায় থাকে না। সময় কম বলে তার বই প্রকাশকে স্বাগত জানাব, কিন্তু বই নিয়ে কথা বলার সময় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বারবার আলোচনায় ফিরে না এসে বরং বর্তমান রাজনীতির ওপরই আমার বক্তব্য কেন্দ্রীভূত রাখব। তার বইয়ের লেখাগুলো এর আগে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অনুমান করে নেব আপনারা তা পড়েছেন।
আপনারা জানেন, মাহমুদুর রহমান আমার বন্ধু। তিনি স্বাধীনচেতা মানুষ। তাঁর নিজস্ব চিন্তা আছে। তিনি আমার মতো কমিউনিস্ট নন, কিন্তু আমি আবার বামপন্থী নই। অতএব নাস্তিকও নই। খেয়ে না খেয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার সঙ্গে কমিউনিজমের কোন সম্পর্ক নেই। মনে রাখতে হবে, আস্তিক-নাস্তিক ভাগ শুরু হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনের বিরুদ্ধে বেসামরিক যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল হিসেবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচার করেছিল কমিউনিজম নাস্তিকের ধর্ম। তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঈমানি কর্তব্য। তারা আমাদের ধর্মপ্রাণ মানুষ আলেম-ওলামাদের বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল। কারণ কমিউনিস্টদের একাংশ নিজেদের নাস্তিক বলে জাহির করত। এর ফল তাদের জন্য ভালো হয়নি। ইতিহাস তার প্রমাণ। এতে ধারণা তৈরি হয়েছে, নাস্তিকতাই প্রগতিশীলতা। কিন্তু কমিউনিজমের যারা গুরু—মার্কস বা লেনিন, তারা কখনোই ধর্মের বিপরীতে নাস্তিকতাবাদ প্রচার করেননি, কিন্তু ধর্মের নামে জনগণের ওপর শোষণ-নিপীড়নের বিরোধিতা করেছেন। একই সঙ্গে বারবার বলেছেন, ইতিহাসে ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে, যখন ধর্ম জালিম শাসক ও তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশে আজ আমরা সে পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করেছি কি না, তার বিচার আমি আপনাদের ওপর ছেড়ে দেব। ফলে ‘বামপন্থী’ হলেই ওদের প্রগতিশীল ভাববেন না—যাদের মওলানা ভাসানীর মতো আমরা মজলুম, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের পাশে দেখি না; দেখি শেখ হাসিনার বাদশাহি টিকিয়ে রাখার গর্হিত কাজে। সারাদেশের গরিব, শোষিত, নিপীড়িত তরুণদের তারা ‘তরুণ’ বলে স্বীকার করে না; স্বীকার করে না তাদের; কলকারখানায় যারা এদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য দিনের পর দিন তাদের রক্ত ক্ষয় করে যায়, যারা পুড়ে মরে, কারখানা ভেঙে চাপা পড়ে, জ্যান্ত কবর হয়। বাংলাদেশের যেসব ‘তরুণ’ দেশে দেশে শ্রমিক হয়ে বুকের জল পানি করে এদেশে অর্থ পাঠায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখে, তারা ‘প্রজন্ম’ নয়। প্রজন্ম হলো তারাই, যারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়; দিন-রাত আওয়ামী ও ছাত্রলীগের পাহারায় এবং পুলিশি নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ‘বিচার মানি না, ফাঁসি চাই-ফাঁসি চাই’ বলে উত্সব করে। ভেবে দেখুন, আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে কী পরিমাণ মিথ্যা ও অবাস্তবের জগতে বাস করছি। প্রপাগান্ডা ও মিথ্যচারেরও একটা সীমা থাকে। রাজনীতির বোঝাবুঝি থাক, কেউ কমিউনিস্ট হোক বা না হোক, ‘তারুণ্য’ আর ‘প্রজন্ম’ নামের শাহবাগি ধারণার মধ্যেই যে এদেশের গরিব, অত্যাচারিত, নির্যাতিত শ্রমিক ও খেটেখাওয়া জনগণকে অস্বীকার করার তত্ত্ব নিহিত রয়েছে, সেটা বোঝার জন্য কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। বাংলাদেশের সেসব কোটি কোটি সত্যিকারের তরুণ, যাদের ঘামে ও রক্তে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে তারা নয়, শহরের তরুণদেরও ক্ষুদ্র একটি অংশ—এরাই হলো একমাত্র তরুণ! আবার এরাই দেশের একমাত্র ‘ব্লগার’ নয়, আরও বহু চিন্তা ও মতের ব্লগার আছে। কিন্তু গণমাধ্যম আজ তাদেরই ‘প্রজন্ম’ বলে হাজির করছে, যাদের অনেকে ধর্মের বিরুদ্ধে ও মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পর্নো জীবনী লেখার মধ্য দিয়ে দুঃসাহস দেখিয়েছে। এখন তারা চায় ‘আমার দেশ’ বন্ধ হয়ে যাক। পত্রিকাটি তারা জ্বালিয়ে দিতে চায়। তারা চায়, মাহমুদুর রহমানকে বন্দী করে আবার কারাগারে পাঠাতে। মাহমুদ আমার বন্ধু। আমি তাকে ও তার পরিবারকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। তিনি ভয়টয় পান না। আমার বোন, তার সহধর্মিণী পারভীনেরও ভয়-ডর কম। কিন্তু এ লড়াইয়ে আমি আবেদন করি যার যার বিশ্বাস ও রীতি অনুযায়ী মাহমুদুর রহমান, তার মা ও পরিবারের প্রতি দোয়া, আশীর্বাদ ও সংহতি জানাতে। আজ বাংলাদেশ খুব কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন। গণমাধ্যমের মিথ্যাচারের কারণে আমরা যেন সংগ্রামে বিভিন্ন পক্ষের শ্রেণীচরিত্র বুঝতে ভুল না করি।
আমরা মনে করি, নতুন যেসব মামলা মাহমুদুর রহমানের ওপর দেয়া হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেও আপনারা তার জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ করবেন, সংহতি জানাবেন। তিনি ও তার পরিবার যেন সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার শক্তি পায়। সামনের লড়াইয়েও সাহসের সঙ্গে যেন সবাই মোকাবিলা করতে পরেন। আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশকে যে জায়গায় আজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে আমরা ফিরে আর আগের জায়গায় যেতে পারছি না। আমরা যারা রাজনীতি একটু একটু বুঝি, আমাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে একটু-আধটু ধারণা রাখেন, তাদের এটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া যাবে না। শফিক রেহমান ভাই শান্তির কথা বলেছেন। আমাদের এখানে হাজির এমন কেউ নেই, যারা শান্তি চান না। আমরা সবাই এখানে শান্তি চাই। কিন্তু অনেকে বলছেন, গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ ঘটিয়ে দেয়ার ইতিহাস কিন্তু আওয়ামী লীগের আছে। বাংলাদেশ যদি সেই বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়, তাহলে সেটা প্রথম ঘটনা হবে না। গৃহযুদ্ধ এর আগেও বাংলাদেশে হয়েছে। আপনারা ভুলে যাবেন না সে কথা। কীভাবে সেটা হয়েছিল? যখনই আপনি আপনার ভাষা বা সংস্কৃতিকে আপনার ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ না রেখে তার ‘রাজনীতিকীকরণ’ করেন, তাকে পলিটিসাইজ করেন, তখনই আপনি দেশে একটি সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করেন। যারা পলিটিক্যাল সায়েন্সে একটু পড়াশোনা করেছেন, তারা জানেন ‘রাজনীতিকীকরণ’ কথাটার মানে কী। নৃতাত্ত্বিক বা ভাষাভিত্তিক কোনো একটা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের আকার দেবেন, একটা রাজনীতি দাঁড় করাবেন, তখন এ রাষ্ট্র দুর্বল হবে, নতুন সংঘাতের ভিত্তি হবে—যেটা শেষ পরিণতিতে গৃহযুদ্ধময় পরিস্থিতি জন্মানোর উত্স হবে।
আমাদের দেশে বাঙালি আছে, চাকমা আছে, মান্দিরা আছে; আরও অনেক জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। তাদের মধ্যে সামাজিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বজায় রাখা ও পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা সহজেই সম্ভব। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং পরস্পরের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনে সামাজিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সেটা খুবই সম্ভব। কিন্তু যদি ‘বাঙালি’রা বলে তাদের সংস্কৃতিই রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একমাত্র জাতীয় পরিচয়, রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে সবাইকে স্বীকার করতে হবে, তখনই সেটা অন্য ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাকে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে। অথচ বাঙালি আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মপরিচয়—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং সে পরিচয় স্বীকার বা ত্যাগ করারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আপনি ‘বাঙালি’ বলে যদি দাবি করেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদই আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, একে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তাহলে আপনি চাকমাসহ পাহাড়ি ও সমতলের অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। পাহাড়িরা তা মানবে না, মানেনি, মানার কথাও নয়। তাদের আরজি, আকুতি কিছুই আপনি শুনলেন না। বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই রাজনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন কী হবে? প্রথমে তারা প্রতিবাদ করবে। মানবেন্দ্রনাথ লারমা প্রতিবাদ করলেন, আপনি শুনলেন না। তখন তারা আন্দোলনে নামলেন, আপনি তারপরও শুনলেন না। এরপর তারা তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র ধারণ করলেন। আপনি যেমন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভারত থেকে সহায়তা পেয়েছিলেন, তারাও ভারত থেকে সহযোগিতা পেলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের রণধ্বনি বাংলাদেশকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিল, যার ক্ষত আমরা এখনও শুকিয়ে উঠতে পারিনি। নতুন করে পঞ্চদশ সংশোধনীতে একালে সেই বিষফোঁড়া আবার গাড়া হয়েছে।
সামাজিক, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ‘রাজনীতিকীকরণ’বলতে কী বোঝায়, তা আশা করি পরিষ্কার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জায়গা থেকে না বুঝলেও অভিজ্ঞতা থেকেই আপনারা জানেন ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির রাজনীতিকীকরণের অর্থ কী। এমনকি সেক্যুলার বনাম ইসলাম—এভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তির তর্ক তুলেও এ আকাম আপনি করতে পারেন। যদি বলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদই বাংলাদেশের সবার একমাত্র রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়, বাঙালি ছাড়া আমরা আর কোনো জাতিসত্তাকে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করি না, তাহলে অন্যদের আপনি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করলেন। তারা তখন প্রতিবাদ জানাবে, শক্তি থাকলে অস্ত্র হাতে আপনার মতোই নিজেদের আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য আপনার বিরুদ্ধে লড়বে; আপনার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়বে। পারলে রাষ্ট্রকে দু’ভাগ করে ফেলবে। তাই বলছিলাম, বাংলাদেশের প্রথম গৃহযুদ্ধের কথা ভাবুন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি বাংলাদেশের প্রথম গৃহযুদ্ধের উসকানিদাতা হিসেবে হাজির হয়নি? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে কি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি? কিন্তু এরাই আবার ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না—দাবি তোলে; ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।
মনে রাখবেন, গৃহযুদ্ধ আওয়ামী লীগ লাগাতে জানে। আওয়ামী লীগই দেশের সব ক্ষমতার একমাত্র মালিক। এখন তারা দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে। নতুন যে পরিস্থিতি তারা তৈরি করেছে, তাতে সমাজকে তারা দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। একদিকে আছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী, আর অন্যদিকে আছে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ—যারা অবশ্যই ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালি, কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মও তাদের সংস্কৃতির অংশ। তাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু যদি আপনি নিরন্তর আর বারবার দাবি করেন, ভাষা ও সংস্কৃতিই আপনার মূল পরিচয়, ধর্ম নয়, তখন নতুন এক বিরোধ আপনি তৈরি করেন। সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র ত্যাগ করে ভাষা ও সংস্কৃতিকে যদি রাজনৈতিকতা ও রাষ্ট্রের স্তরে উন্নীত করে আপনি দাবি করেন— এ স্তরে শুধু ‘বাঙালিত্ব’ই স্বীকার করা হবে, ইসলামকে স্বীকার করবেন না; তখন আপনি যেমন ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ঝান্ডা বানিয়ে সামনে দাঁড়ান, তখন আপনি চান বা না চান প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসলামও তার ধর্মের ঝান্ডা নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে বাধ্য। দাঁড়ানোর শর্ত তৈরি হয়ে যায়। বাঙালিকে আপনি বিভক্ত করেন। একদিকে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা আর অন্যদিকে ইসলাম ও ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ। আপনি তখন তাদের ধর্মান্ধ, গোঁড়া, পশ্চাত্পদ এবং খুব অপছন্দ হলে ‘রাজাকার’ গালি দিয়ে থাকেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য বিশ্বের সহযোগিতায় তাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েন। আজ শেখ হাসিনার সরকার সেই দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষকে ‘বাঙালি’ ও মুসলমানে ভাগ করে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষের ধর্মানুভূতিকে আহত করা হয়েছে।
যারা ইসলামে বিশ্বাসী, তারা নিঃসন্দেহে নাস্তিকতার বিরোধী—এটা তার ঈমান-আকিদার অংশ। কিন্তু কেউ যদি নাস্তিক থাকতে চায়, সেটা তার নিজের বিশ্বাস। সে বিশ্বাসের দায়দায়িত্ব তার নিজের। নাস্তিকদের সঙ্গে মুমিন মুসলমানের সামাজিক কোনো ঝগড়া নেই। ফলে কাউকে যখন তখন মুরতাদ বলা বা তার বিশ্বাসের জন্য শারীরিকভাবে ক্ষতি করা মুমিনের কাজ হতে পারে না। সমাজে নাস্তিক আছে, থাকবে। সামাজিক কোনো ঝগড়া নেই। আপনার ছেলেও নাস্তিক হতে পারে। আপনি তাকে বোঝান, ঘরের মধ্যে বোঝান। নাস্তিকতাও একটা আদর্শ হতে পারে। অসুবিধা নেই। কিন্তু আপনি যখন নবী-রাসুলদের বিরুদ্ধে এমনসব কুিসত ও কদর্য ভাষায় লেখেন, লেখালিখি করেন, তখন কী হবে? একে দিনের পর দিন যখন প্রশ্রয় দেয়া হয়, তখন এটাই বোঝা যায়, পরিকল্পিতভাবে আপনি বাংলাদেশকে হিংসার পথে নিয়ে যেতে চান। ইসলামের মানুষের কথা দূরে থাক, ব্লগে নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লেমের বিরুদ্ধে যে কদর্য ভাষায় লেখালেখি হয়েছে, তা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। এটা কিন্তু নতুন নয়। এখন শাহবাগের কিছু ব্লগারের কীর্তিকাহিনী প্রকাশ হয়েছে মাত্র। শেখ হাসিনা এ ধরনের ব্লগারকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তাদের প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ দু-একটি মন্দ কথা লিখেছে বলে তাদের জেলে ঢুকিয়েছেন তিনি। কিন্তু কুিসত ভাষায় লেখা এই ব্লগগুলো এর আগে রাষ্ট্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করা হয়নি। এটাকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকানি দেয়ার জন্যই প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে, পাবলিক অর্ডার নষ্ট করতে পারে এমন কাজ করা যাবে না। আমাদের বিচার বিভাগের নজরে আনার পর তারা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাষ্ট্র কোনো কিছুই করেনি। উল্টো দেখছি এ ধরনের ব্লগার নিয়েই শাহবাগের ‘প্রজন্ম’ গঠিত হয়েছে।
যারা এ দেশের মানুষের ধর্মানুভূতিকে সচেতনভাবে আহত করেছে, তারা আজ শেখ হাসিনার মদতপুষ্ট হয়ে বরং মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে উলটো উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। পত্রিকা পোড়াচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের খেয়াল করতে হবে, এ ধরনের উসকানির জন্য শেখ হাসিনা সরকার এবং বর্তমান রাষ্ট্র ষোলো আনা দায়ী। আজ উসকানিদাতারা মাহমুদুর রহমানকে উসকানিদাতা বলছে এবং সরকার তাকে গ্রেফতার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ব্লগের কুিসত লেখাগুলো আগে ইনকিলাবে ছাপা হয়েছে, সেগুলো মাহমুদুর রহমান তুলে ধরেছেন। যারা নিজেদের এ ধরনের ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্ট বলে দাবি করেন, বাংলাদেশে কি কেবল তারাই ‘তারুণ্য’, তারাই ‘প্রজন্ম’?
তারপরও ব্লগার রাজীবের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে হবে আমাদের। কিন্তু যিনি তার ছেলেকে হারিয়েছেন, সেই ছেলের মায়ের যেমন ব্যথা, তার বাবার যেমন ব্যথা—মনে রাখতে হবে, ঠিক একইভাবে একটা ছেলে যদি ইসলামি রাজনীতি করে, আপনি তাকে পছন্দ না করতে পারেন, সমর্থন করতে না পারেন, কিন্তু সে যখন মারা যায়, তাকে যখন গুলি করে মারা হয়, তার বাপের ব্যথা-মায়ের বেদনাও আপনাকে শুনতে হবে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা সেটা শুনতে পায় না। শেখ হাসিনা শুনতে পান না। আপনি শুনতে পারেন না, আপনি তার মায়ের ব্যথা শুনতে রাজি নন। কারণ সে নাকি ইসলামি রাজনীতি করে। এর মধ্যে যারা প্রাণ হারিয়েছে, আমরা কিন্তু তাদের নিয়ে কথা বলি না, তাদের নিয়ে মিডিয়াতে কথা বলি না। মানবাধিকার কর্মীরাও কথা বলে না। আপনি দাবি করছেন আপনি তরুণ প্রজন্ম। আমি সকালে এক তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলি, যে তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে যান, আমি তাদের প্রশ্ন করি: আপনারা ‘তরুণ’ কিন্তু যে তরুণকে পুলিশ গুলি কতে হত্যা করল, সে তরুণ নয়? সে কোন প্রজন্ম? তাহলে কি তারা তরুণ না? আপনি যদি ইসলামের কথা বলেন, তাহলে আপনি ‘তরুণ’ হবেন না, নিজেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী না ভাবলে আপনি তরুণ প্রজন্মের লোক নন? এটা কী করে হতে পারে? তাহলে এই যে বিভক্তিটা টানা হচ্ছে, তার ভিত্তিটা কী? যে গণমাধ্যমগুলো ‘প্রজন্ম’ ‘প্রজন্ম’ করছে—লাখ লাখ মানুষ, কোটি কোটি মানুষ, শত-কোটি কণ্ঠস্বরের কথা বলছে, তারা কারা? যে গণমাধ্যম এগুলো বলছে, তারাও দেশকে আজ দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। প্রত্যেকটি গণমাধ্যম উসকানির জন্য দায়ী। এ ধরনের প্রত্যেকটি গণমাধ্যমকে প্রমাণ করতে হবে, আগামী দিনে যে বিশৃঙ্খলা হবে, তার শর্ত তারা তৈরি করেছে দিনেরপর দিন, তারা সাংবাদিকতার নামে পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের একদিন নিশ্চয়ই জবাবদিহি করতে হবে। সাংবাদিকতার ভূমিকা এরা কেউ পালন করেনি।
এটা খুব পরিষ্কার থাকতে হবে, উসকানির ক্ষেত্রে যে গণমাধ্যমগুলো দায়ী, আজ তারাই উলটা মাহমুদুর রহমানকে উসকানিতে অভিযুক্ত করছে। আপনাদের যদি মাহমুদুর রহমানের কোনো সংবাদের ব্যাপারে আপত্তি থাকে, তার কোনো লেখার ব্যাপারে আপত্তি থাকে, সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা করা যায়; আলোচনা করা উচিত। আমিও করতে রাজি আছি। কিন্তু যারা উসকানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাদের উসকানির ব্যাপারে কিছু বলছেন না; যেভাবেই হোক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে ঢোকানোর জন্য আপনারা ব্যস্ত হয়ে গেছেন।
তরুণরা, যারা শাহবাগে যাচ্ছেন, তাদের আমি বিনীতভাবে বলছি, আপনারা যারা ভেবেছেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি, ঠিক আছে। আসলেই তো হয়নি। শেখ মুজিব ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার চলছে। আপনারা প্রতিবাদ জানাতে গেছেন, বিক্ষুব্ধ হয়েছেন; কেন? কারণ এর আগে একজনের ফাঁসির রায় না হয়ে যাবজ্জীবন হলো। আপনাদের মনে হয়েছে জামাতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা আঁতাত হয়েছে। আপনারা এর জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করতে, প্রতিবাদ জানাতে ওখানে গেছেন; এটা ন্যায্য। এর অধিকার আপনার আছে। কিন্তু গিয়ে যখন দেখছেন, পুরো ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের সাজানো, ছাত্রলীগ পুরো অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করছে, যারা ওখানে সাংস্কৃতিক কর্মী বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন তারা আওয়ামী লীগের মানুষ, যারা অন্য পরিচয় দিচ্ছেন—যেমন নিজেকে ব্লগার বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগেরই অঙ্গসংগঠনের একজন লোক। তাহলে এটা তো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে, পুরোটাই একটা আওয়ামী সমাবেশ ছাড়া কিছুই নয়। আপনি কিসের ভিত্তিতে একে তরুণ প্রজন্ম ভাবলেন? তরুণ প্রজন্ম কাকে বলছেন? তারা কারা? —তারা ছাত্রলীগ। এর আগে পরশু তারা যেখানে ঘোষণা দিচ্ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি। তারাই ডিক্টেট করছেন, তারাই নির্দেশ দিচ্ছেন, অথচ গণমাধ্যম সে সত্য লুকিয়ে তাকে বলছে এটা তরুণ প্রজন্ম চত্বর।
অস্বীকার করার উপায় নেই, তরুণদের বড় একটি অংশ মনে-প্রাণে ক্ষুব্ধ। তাদের এ ক্ষুব্ধতাকে অবশ্যই আমাদের বুঝতে হবে। কিন্তু তারা যেভাবে আওয়ামী ছত্রছায়ায় নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, সেটা সঠিকভাবে করছেন না। দেশকে তারা যেখানে ঠেলে দিয়েছেন, সে জায়গা থেকে ফিরে আসার উপায় নেই। আমি রাজনীতি যতটুকু বুঝি, তাতে মনে করি এখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ খুবই কম। কারণ পরিণতিটা ব্লগারদের সামনে রাখার মধ্যে নিহিত রয়েছে। যে কুিসত ব্লগ নিয়ে কথা হয়েছে, হতে পারে সেটা একজন ব্লগারের সমস্যা। এটা ব্যক্তিগত কুকাণ্ড। শাহবাগের তরুণদের যারা নিজেরা খুব সহনশীল নয়, তাদের বহু রকম বেয়াদবি আমরা সহ্য করতে রাজি আছি। একজন ব্লগারের জন্য সব ব্লগারকে তো আমরা দোষী করতে পারি না। তরুণ বলে ক্ষমা করে দিতেও রাজি আছি। কিন্তু সে তরুণকে তরুণ প্রজন্মের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শুধু শহীদ বলে ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, আপনারা তার ভাস্কর্য স্থাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রী তার বাসায় গেছেন; তিনি বিশ্বজিতের বাসায় যাননি। এতে তিনি কী প্রমাণ করলেন—তিনি ব্লগার রাজীবের আদর্শ ধারণ করেন। সে আদর্শ হচ্ছে রাসুলে করিমের বিরুদ্ধে কুিসত লেখালিখি করা। শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষ হয়ে জবাব চাইতে পারি আমরা। ছাত্রলীগ কুপিয়ে বিশ্বজিেক হত্যা করল টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে। তার বাড়িতে যাওয়ার সময় আপনার হয়নি। কিন্তু ব্লগার রাজীবকে আপনি কোন যুক্তিতে মহামান্বিত করলেন? কোন আদর্শের তাগিদে আপনি তা বোধ করলেন? কোন নৈতিকতায় আপনি বিশ্বজিতের প্রতি সমবেদনাও নয়, অথচ ব্লগার রাজীবকে মহান চিহ্নিত করলেন? বাংলাদেশে যদি কোনো ধর্মপ্রাণ বা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ থাকে, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ থাকে, অপ্রকৃতিস্থ না হয়—এ ধরনের যদি কোনো মানুষ বাংলাদেশে আদৌ থেকে থাকে, তাহলে এর পরে তিনি যদি শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেন—তাহলে আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ অন্ধকার।
একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি জানেন এই ব্লগার কী লিখেছে। তিনি রাজীবকে পুরো আন্দোলনের শহীদ আকারে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এখান থেকে শাহবাগি ও আওয়ামী রাজনীতির সরে আসার কোনো সুযোগ আমি দেখছি না। এর বিপরীতে রাজীবের আদর্শ যে রাজনীতি ধারণ করে, যা এতদিন সুপ্ত ছিল, সেটাই মাহমুদুর রহমান প্রকাশ করে দিয়েছেন। এতে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে। কিন্তু আজকে যারা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাদের প্রতি আমাদের নিবেদন—কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িকতাকে কোনোভাবে আমরা যেন প্রশ্রয় না দেই। আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে যে, এই লড়াই মুসলমান-অমুসলমানের লড়াই নয়; এটা হচ্ছে অশ্লীল, কুিসত, বিকৃত রুচির আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই—শেখ হাসিনার বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে আদর্শ ধারণ করে। ধর্মীয় কোনো বিশ্বাসের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নেই। অন্যের চিন্তা ও মতকে যারা সহ্য করতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণের, গরিব ও নিপীড়িত মানুষের লড়াই।
নিঃসন্দেহে নবী করিমের ইজ্জত ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এ লড়াইয়ের প্রধান বিষয়, কিন্তু এটা নয় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতোই আমরা ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছি। আমরা লড়ছি আত্মমর্যাদার জন্য, শেখ হাসিনা আমাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন। আমরা লড়ছি গণতন্ত্রের জন্য—যেখানে ইসলাম, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তো অবশ্যই, একই সঙ্গে অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। আজ আমাদের মাওলানা-মাশায়েখদের পরীক্ষা দেয়ার সময় এসেছে। তারা ভুল করলে ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় এ দেশকে প্রস্তরযুগে পরিণত করবে। আমাদের হুশিয়ার হতে হবে। তারা প্রচার করছে যে, একটা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য জনগণ মাঠে নেমে এসেছে। প্রচার চলছে, আবারও মৌলবাদীরা মাঠে নেমে এসেছে। আবারও জামায়াত-শিবির চক্রান্ত করছে। আপনাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, ওই পথে যাবেন না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চান, ইরাক বানাতে চান। তারা বাংলাদেশকে একটা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে চায়। ওই মারাত্মক বিপদের দিকে আমরা যেন না যাই।
গরিব মানুষ, হাজার মজলুম মানুষ, হাজার নিপীড়িত মানুষ—যাদের মনের কথা কোনোদিন শুনিনি, তাদের বিভিন্নভাবে লুণ্ঠন করা হয়েছে। দেশ লুটপাট করা হয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। জনগণ বিচার পায় না, কিছুই পায় না। এই যে একটা নৈরাজ্য তৈরি করে রাষ্ট্রহীন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে, তারই বিরুদ্ধে এ বিস্ফোরণ। তারা মৌলবাদের কথা বলে, জামায়াত-শিবিরের কথা বলে দোষ চাপায়; আসলে তারা টুপিপরা, পাগড়িপরা লোকদের ঘৃণা করে। ওরা আমাদের পছন্দ করে না। তাই যা কিছুই আমরা করি, তাকে তারা জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত বলে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যেহেতু আমরা টুপি পরি, দাড়ি রাখি, আমরা আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতির কথা বলি—এটা তারা পছন্দ করে না।
যারা তরুণ, শাহবাগে গিয়ে তারা অনেকেই নিজেদের বামপন্থী দাবি করেন। তারা অনেকে আছেন। তাদের আমি কিছু কথা বলব। প্রথমত, আপনি বাঙালি জাতির হতে পারেন অসুবিধা নেই; বাংলা সংস্কৃতির হতে পারেন; চাকমা, মান্দি, সাঁওতাল, রাজবংশী যা কিছু হতে পারেন; আপনি নাস্তিক হলেও কোনো অসুবিধা নেই—কিন্তু যখনই আপনি সংস্কৃতিকে এবং ভাষাকে, বিশেষ সামাজিক পরিচয়ের ‘রাজনীতিকীকরণ’ ঘটান, ‘রাজনীতিকীকরণ’ করেন, তখন অন্যেরা আপনার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ পতাকা নিয়ে দাঁড়াবে। এর আগে জুম্ম জাতির পতাকা দাঁড়িয়েছে, এখন ইসলামের পতাকা দাঁড়াবে। দাঁড়াতে বাধ্য। এর জন্য আপনিই দায়ী। আপনি সমাজ আর রাজনীতির ফারাক বজায় রাখেননি। এ কারণে অন্যরাও আর রাখতে রাজি থাকবে না। তারা ইসলামের পতাকা দিয়েই আপনার বর্ণবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র উত্খাত করবে—এটাই নিয়ম। এক্ষেত্রে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি বলে কোনো লাভ হবে না।
আপনি যদি মনে করেন, সংস্কৃতি এবং ভাষাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবেন, যদি তার দ্বারাই বাংলাদেশের শত্রুমিত্র ঠিক করেন, তখন যারা নিজেদের বাঙালি ভাবার চেয়েও মুসলমান ভাবতে চান—আর সে সামাজিক অধিকার তার অবশ্যই আছে—তখন তারাও রাজনৈতিকভাবে আপনার বাঙালি জাতীয়তাবাদ মোকাবিলার জন্য ইসলামের পতাকা নিয়ে মাঠে নামবেন। এর দ্বারাই বাংলাদেশের শত্রুমিত্র ঠিক হবে। শেখ হাসিনা সেদিকেই বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছেন।
কিন্তু এ লড়াইকে সুন্দর পথে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। যদি গ্রিকো-খ্রিস্টিয়ান ধর্ম ও সংস্কৃতি ইউরোপীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে এ দেশের মানুষের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিও নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। ইউরোপের রাষ্ট্রের চেয়েও এ রাষ্ট্র হবে বিকশিত, উন্নত ও অগ্রসর। এক্ষেত্রে ইসলাম অবশ্যই আমাদের পথ দেখাতে পারে। এ রাষ্ট্রে মানুষের মর্যাদা ও অধিকারকে মহীয়ান করা হবে; কারণ ইসলাম মানুষকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করে আশরাফুল মাখলুকাত গণ্য করে। নিজেদের ইশতিহারে বলতে হবে, আমাদের ইনসাফ কায়েম করতে হবে। মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং একই সঙ্গে মানুষের রিজিক বা জীবনধারনের নিশ্চয়তা দেয়া এ রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হবে। ‘ইনসাফ’ শব্দটি যে অর্থ ও দ্যোতনা তৈরি করে, তার সমার্থক শব্দ নেই। আমরা এমন এক ইনসাফভিত্তিক গণতন্ত্র চাই, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীন; কিন্তু সে সমাজের সামষ্টিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়।
আমাদের দ্বিতীয় কাজ হবে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গণপ্রতিরক্ষার ধারণা ও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেয়া। বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা দরকার। আমরা কিন্তু আজ একটি প্রতিরক্ষার লড়াইয়ের মধ্যে আছি। এটা যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা এ লড়াইকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারব।
[গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মাহমুদুর রহমানের তিনটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য]

অনুলিখন : শাহাদাত্ তৈয়ব
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ রাত ২:১৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×