somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি বেড়াল এবং ভেঁজা জ্যোৎস্না…নীলাঞ্জনা নীলা

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ রাত ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যরাতে ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়লো কাঁচের প্লেট । বেড়ালটা নিজেই ভয় পেয়ে গেছে , আর তাই মিউ মিউ করে ডাক শুরু করলো । চৈতির ঘুম ভেঙ্গে গেছে , পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার । বুঝলো যে লোডশেডিং । আজ অসম্ভব গরম পড়েছে । কার বাড়ীর বেড়াল কখন যে এসে ঢুকেছে ঘরে , বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নামলো । একে কি নিশ্চিন্তের শয্যা বলে , কে জানে ! তোষকের ভেতরে যে তুলো ছিলো তা একেবারে সমান , কাঠের সাথে মিশে গেছে । খুব ব্যথা করে পিঠে । আজ অব্দি একটি সংসার হলো না তার । তবে না হয়ে ভালোই হয়েছে , নিজের মতো করে জীবনটাকে যেভাবেই হোক সাজিয়ে তো নিয়েছে ! এরই মধ্যে আবারও বেড়ালের ডাক , “উফ কি যে জ্বালা ! দরজাটা যখন বন্ধ করে , একটু কি খেয়াল করবে না শুভ্র ?” নিজের মনেই কথাগুলো বললো । শুভ্র আর স্নিগ্ধ এই হলো তার সন্তান । শুভ্র একেবারে ওর বাবার মতো , আর তাই ভাবে না ওকে নিয়ে চৈতি । তবে স্নিগ্ধকে নিয়ে খুব চিন্তা । যদিও ছেলে , তাও ভাবে তার নিজের মতো জীবনটা যদি হয় ? মেয়ে চাইতো সবসময় আর যখন শুভ্র হলো তখন কি প্রার্থনা ! তবুও নিজেরই তো সন্তান । মনের চাওয়া এখানে বিফল হলেও খারাপ লাগে না । কষ্ট হয়না । কি অদ্ভূত , ভাবে চৈতি ! আর স্নিগ্ধ তো আসার আগেই নাম রেখে দেয়া স্নিগ্ধা । স্নিগ্ধ এখনও বলবে , “কি যে মেয়েলি নাম রেখেছো মা , বন্ধুরা ক্ষ্যাপায় স্নিগ্ধা বলে ।” আবারও বেড়ালটা ডাকছে , এই অন্ধকারে কোথায় খুঁজবে ? এতো রাতে যে দরজা খুলে দেবে ওটাকে বেড়ুবার জন্যে , সেটাও ভাবতে পারছে না । বেড়াল মোটেও সহ্য হয়না চৈতির ।

বেড়ালটাকে খুঁজতে হলে আগে মোমবাতি খুঁজতে হবে । কিন্তু সেসব কি আর গোছানো থাকে ? তবুও হাতড়ে হাতড়ে পেয়েই গেলো । এখন খোঁজো দিয়াশলাই । একদিক থেকে শান্তি কোনো ছেলেই সিগারেট খায়না । অবশ্য স্নিগ্ধকে দিয়ে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না । রান্নাঘরে যেতেই আবার সেই মিউ ডাক । “তার মানে আপনি এখানে বেড়াল মশায় ? আরে মেয়েও তো হতে পারে ! এই যা তো , কি শুরু করেছিস ? ঘুম তো দিলি ভাঙ্গিয়ে ।” এই একা একা কথা বলার অভ্যেসটা এখনও গেলো না । মনে পড়ে মা বলতো , “একা একা কথা যে বলিস , জানিস অনেক একা হয়ে যাবি ?” কোথায় মা , আর কোথায় বাবা । এখন তো নিজেরই বয়স হয়ে গেছে ঠিকই বুঝতে পারছে , তা নইলে কি এভাবে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় ?

নাহ ছেলেগুলো যদি সিগারেট খেতো , ভালোই হতো মনে হয় এখন । শুভ্র যদিও এড়িয়ে চলে তার মাকে , স্নিগ্ধ ততোটাই আঁকড়ে ধরে আছে । একদিন বাসায় ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলো চৈতি , “এই কি রে তুই কি সিগারেট খাচ্ছিস ? গন্ধ পাচ্ছি কেন ?” অমনি স্নিগ্ধর উত্তর , “যা টাকা দাও হাত-খরচ , সেটা দিয়ে প্রেম করাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে , তা আবার সিগারেট !” চৈতি কিছুক্ষণ গজগজ করতে থাকে এই যুগ আর এ সময়ের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে । অথচ একসময় চৈতি তার নিজের যুগের অনেক আগেই এগিয়ে গিয়েছিলো । অবাধ স্বাধীনতা মাঝে-মধ্যে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করে যে , তখন এমন কিছু ঘটে যায় জীবনে , যার জন্যে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিতে হয় সেই ভুলের বোঝা । তাই তো চৈতি নিজের বাবা-মায়ের মতো হয়নি । নিজের হাসিমাখা মুখটাকে রোজ আয়নায় নিয়ে দাঁড় করায় । এখন পর্যন্ত তো হেরে যায়নি । মন খারাপ হয়না যে তা নয় । সেসময় আকাশের দিকে চেয়ে আর গানের সাথে মিশিয়ে দেয় নিজেকে । অনেক আগে একদিন রেণুকে দেখেছিলো কাঁদতে আর তাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে । সেদিন বলেছিলো চৈতি , “রেণু চোখের জল আকাশের কাছে ঢালিস , আয়নার কাছে না । আয়নার সামনে নিজের হাসি-হাসি মুখটা দেখাস । দেখবি আনন্দ তোকে জড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ ।” চৈতির খুব প্রিয় বান্ধবী রেণু । ওর কান্না ছিলো তার গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেনি । যেখানে সবাই অসহ্য এবং বিরক্তিকর প্রেমের জন্যে চোখের জল ফেলে , সেখানে রেণুর কান্না স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছিলো প্রায় তখুনি বিয়ে । কি জানি কোথায় আছে এখন !

এবার আবার শব্দ । একেবারে হাতের কাছেই কি জানি পড়লো । কেন জানি মনে হচ্ছে মুড়ির টিন । “উফ এসব কি সহ্য হয় ?” সকালেই আবার ছুটতে হবে , কাল আবার অফিসে অডিট । এর মধ্যে সারা দেশে আন্দোলন হচ্ছে মানবতা বিরোধী রাজাকারদের ফাঁসি নিয়ে । ধর্মের নামে রাজনীতি যে কবে বন্ধ হবে ! একদিন গিয়েছিলো শাহবাগ । জীবনে একাত্তর দেখা হয়নি , আন্দোলন দেখেছিলো সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ে উনিশশো নব্বই সালে । মনে আছে মিছিলও করেছিলো চৈতি , গণতন্ত্র মুক্তি পাবার পর । সেদিন শাহবাগ যাবার পর ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি । নিজেকে যেনো একজন মুক্তিযোদ্ধা মনে হচ্ছিলো । সেদিন শ্লোগানও দিয়েছিলো । স্নিগ্ধকে বলেছিলো , “আমাকে নিয়ে যাবি ? খুব ইচ্ছে করছে রে যেতে ।” স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বললো , “মা তুমি যেতে চাও ? আমি জানো তোমাকে ভয়ে বলিনি আমি না রোজ ওখানে যাই মা ।” চৈতি দু’ চোখ ভরে চেয়ে দেখছিলো স্নিগ্ধকে । এ কোন স্নিগ্ধ ! এতো বড়ো হয়ে গেছে ? এতো কিছু বোঝে তার সন্তান ? তারপর মা আর ছেলে দুজনে মিলে শাহবাগ । স্নিগ্ধকে দেখেই একটি মেয়ে ছুটে এসেছিলো , চৈতিকে লক্ষ্য করেনি । এসেই বললো “এতো দেরী কেন ? সেই কখন থেকে এসেছি ?” সাথে সাথেই স্নিগ্ধ বললো , “মা ওর নাম পিয়া ।” বুঝে গেলো চৈতি । মেয়ে তো হতভম্ব ! কি করবে বুঝতে পারছে না । তখন চৈতি নিজেই বলে উঠলো , “পিয়া বাসায় এসো , কেমন ? আমি শ্লোগান দেই কিছু সময় ।” ভালো লেগেছে পিয়াকে , নিষ্পাপ চেহারা । মিষ্টি মুখ । আর বেশ লাজুক । চৈতির একেবারে বিপরীত ।

নাহ একটা দিয়াশলাই কি কোথাও নেই ? চুলার পাশে নেই , যেখানে যেখানে থাকার কথা ছিলো সেখানেও নেই । গেলোটা কোথায় ? নাহ স্নিগ্ধটাকে ওঠাতে হবে । কেন জানি মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ বোধ হয় সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে । এই একটা জিনিস একেবারেই অপছন্দ চৈতির । এই সিগারেটের জন্যে অনেক কিছুই হারিয়েছে চৈতি । খুব কষ্ট হচ্ছে । শুভ্র যখন পেটে ওটাকে দেখার কি ইচ্ছে । কবে নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পাবে এমন প্রতীক্ষায় যে কি আনন্দ ! তখন মা বলেছিলো , “চৈতি পেটে আছে ওটার চেয়ে আর কোনো শান্তি নেই রে । যখনই আলো-হাওয়া লাগবে সেই থেকে যে চিন্তা শুরু হবে , মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তি নেই । কি জানি মৃত্যুর পরেও হয় কিনা !” ধ্যৎ এতো ভাবনার কি আছে ? এমন কিছুই না । অনেক ছেলেই সিগারেট খায় , নিজেকে আবার স্বান্তনা দেয় । কিন্তু তখুনি মনে পড়ে যায় নিজের জীবন । বিড়বিড় করতে থাকে চৈতি , “যেনো এমন না হয় হে ঈশ্বর ।” অনেকক্ষণ ওই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো । হঠাৎ পেছন থেকে কেউ যেনো জড়িয়ে ধরেছে , “মা কি খুঁজছো ? দিয়াশলাই ? আমি নিয়ে গিয়েছিলাম আজ সাথে করে । মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ছিলো আজ শাহবাগে । স্যরি মা , এমন আর হবে না । সকালে উঠেই নিয়ে আসবো দোকানে গিয়ে , ঠিক আছে ?” আবার বেড়ালের ডাক খুব ভালো লাগছে চৈতির সেই ডাকটা । কি জানি বেড়ালটা হয়তো তার বাচ্চাকে খুঁজছে , নয়তো বাচ্চা বেড়ালটা তার মাকে । এই অসম্ভব গরমের মধ্যেও এতো শীতলতা ! আর ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এতো আলো আলোকিত করেছে সারাটি ঘর । ছোট্ট একটা ভ্যান্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার আলো আর ভিঁজিয়ে দিচ্ছে চৈতির সমস্ত মন ।

হ্যামিল্টন , কানাডা
২৫ ফেব্রুয়ারী , ২০১৩ ইং ।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীবাদ, ইসলাম এবং আইয়ামে জাহেলিয়া: ঐতিহাসিক ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

লিখেছেন মি. বিকেল, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৪



আইয়ামে জাহিলিয়াত (আরবি: ‏جَاهِلِيَّة‎) একটি ইসলামিক ধারণা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী আরবের যুগকে বোঝায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়কাল ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×