somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সর্বস্তরে বাংলা কত দূর

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিন শ চৌষট্টি দিনের ভোর থেকে আজকের ভোরটি ভিন্ন বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের কাছে। বছরের এই দিনে এ দেশের তরুণেরা মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন; সমগ্র জাতিকে, বিশ্বকে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে, আকাশবিদীর্ণ স্লোগানে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’।
না, তাঁরা মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেননি।
আজ একুশের সেই দিন, যে দিনে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতরা বুকের রক্ত দিয়ে ভাষাকে রক্ষা করেছিলেন, দেশের ও বিদেশের কোটি কোটি বাঙালির মনে আশা জাগিয়েছিলেন, স্বপ্নকে রাঙিয়ে তুলেছিলেন রক্তের অক্ষরে । তাদের তিন শ চৌষট্টি দিনের ভোর থেকে আজকের ভোরটি ভিন্ন বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের কাছে। বছরের এই দিনে এ দেশের তরুণেরা মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন; সমগ্র জাতিকে, বিশ্বকে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে, আকাশবিদীর্ণ স্লোগানে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’।
না, তাঁরা মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেননি।
আজ একুশের সেই দিন, যে দিনে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতরা বুকের রক্ত দিয়ে ভাষাকে রক্ষা করেছিলেন, দেশের ও বিদেশের কোটি কোটি বাঙালির মনে আশা জাগিয়েছিলেন, স্বপ্নকে রাঙিয়ে তুলেছিলেন রক্তের অক্ষরে। তাঁদের জ্বালানো দীপশিখাই একাত্তরে আরও প্রোজ্জ্বল হয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধীনতায়। বিশ্বের বুকে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল—বাংলাদেশ।
বায়ান্নর একুশের আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থে গণমানুষের আন্দোলন, গণবিদ্রোহ। এই আন্দোলনে কোনো নেতা ছিলেন না, বরং নেতাদের নিষেধ অমান্য করে সাধারণ ছাত্ররা, তরুণেরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন, তাদের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনীর গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন।
সেদিনের অকুতোভয় ভাষাসংগ্রামীদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাসনা ছিল না, পদ-পদবির মোহ ছিল না। যে ছাত্রাবাস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন, মিছিল শেষে সেখানেই ফিরে গেছেন। জনারণ্য থেকে আসা মানুষ আবার জনারণ্যে মিশে গিয়েছিলেন।তাঁদের মধ্যে ছাত্রছাত্রী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। ছিলেন গৃহবধূ থেকে রিকশাচালক, রাস্তার ছিন্নমূল হকার থেকে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। একটি সূত্রই তাঁদের ঐক্যের বন্ধনে বেঁধেছিল—ভাষা, মাতৃভাষা বাংলা।
২.
বায়ান্ন থেকে দুই হাজার এগারো—ঊনষাট বছর। এই দীর্ঘ সময়ে কতটা এগিয়েছে বাংলা ভাষা? আমাদের স্বপ্নে চিন্তায় মননে ও সৃজনশীলতায় এই ভাষাকে কতটা ধারণ করতে পেরেছি আমরা? গত ছয় দশকে যেখানে পৃথিবীর অনেক অনুল্লেখ্য ভাষা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছেছে, বিশ্ব সাহিত্যে মর্যাদার আসন লাভ করেছে, সেখানে আমাদের অবস্থান কোথায়?
যদি শিক্ষার হারের কথা বলি, যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনায় আনি, ভাবি প্রতিবছরে বইমেলার পরিধি ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা, মানতে হবে বাংলা ভাষার উন্নতি হয়েছে। যখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়, কিংবা একটি দেশের সংবিধান রচিত হয় এই ভাষায়, সরকারি অফিসের কাজকর্মে ব্যবহূত হয়, তখন মানতেই হবে বাংলার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে। আমাদের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা প্রায় অপাংক্তেয়। পাঠ্যবই ও পরিভাষা না থাকার ঠুনকো অজুহাতে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ নিতে হয় ইংরেজিতে। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রবেশাধিকার নেই। গত ৪০ বছরে শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষে প্রায় ডজনখানেক কমিশন বা কমিটি হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার পাঠ্যবই প্রণয়নের জন্য একটি কমিশনও কোনো সরকার করেনি। পন্ডিতেরা সরকারকে দুষছেন, সরকার দুষছে পন্ডিতদের।
এ প্রসঙ্গে আমরা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের মতো দুরূহ কাজ যিনি করতে পারেন, বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও যিনি সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করে শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখেন, তিনি কেন মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবেন না? এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন করুন। তারা আগামী তিন বছরে এমন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন, যাতে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কেউ পরিভাষা ও পাঠ্যবইয়ের অভাব থাকার বিষয়টি অজুহাত হিসেবে দেখাতে না পারে।
পঞ্চাশের দশকে জীবননান্দ দাশ বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বাংলার বিভক্তি এবং দুই দেশে উর্দু-হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে। এ বাংলায় এখন পাকিস্তানি শাসকেরা না থাকলেও অনেকের মধ্যেই ঔপনিবেশিক মানসিকতা রয়ে গেছে। যে বাঙালি একদা সড়ক, অফিস, বাড়ি ও গাড়ির নামফলক বাংলায় লেখার জন্য রাজপথে নেমেছিল, সেই বাঙালি এখন ইংরেজির খপ্পরে পড়ে বাংলাকে ভুলতে বসেছে। ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা পুরোপুরি অনুপস্থিত।
প্রতিবছরই আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর শপথ নেন, লোকদেখানো পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অসামান্য আলস্য দেখান, যাা প্রমাণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একবার লিখেছিলেন, ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে, যারা শুধু বাংলায় কথা বলে।’ দেশের অগ্রগতি চাইলে, মানুষের উন্নতি চাইলে আমাদের অবশ্যই তাদের কাছে যেতে হবে। কেবল যাওয়া নয়, তাদেরও নিয়ে আসতে হবে তথাকথিত নাগরিক ও শিক্ষিত মানুষের সমান্তরালে। মনে রাখতে হবে অশিক্ষা ও দারিদ্র্যই ভাষার প্রধান শত্রু।
আজ সেই একুশের ভোর, যেই অনন্য ভোরে এ দেশের সন্তানেরা ইতিহাস রচনা করেছিলেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এই ভোরে আমরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যাব, অর্ঘ্য হাতে প্রভাত ফেরিতে অংশ নেব। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হলো যে ভাষার জন্য তাঁরা জীবন দিয়েছেন, সেই ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেটিই হবে ভাষা শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাইনারি চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি: পূর্ণাঙ্গ তুলনার ধারণা এবং এর গুরুত্ব

লিখেছেন মি. বিকেল, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩০



সাধারণত নির্দিষ্ট কোন বস্তু যা শুধুমাত্র পৃথিবীতে একটি বিদ্যমান তার তুলনা কারো সাথে করা যায় না। সেটিকে তুলনা করে বলা যায় না যে, এটা খারাপ বা ভালো। তুলনা তখন আসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×