somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের নতুন নাম এখন রেশমা।।

১১ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের সকাল সাড়ে আটটা-পোনে নয়টার দিকে সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ভবন ধসের সময় রেশমা রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমসে কাজ করছিলেন। পরে মরনফাঁদ রানা প্লাজার কর্মস্থল তৃতীয় তলা থেকে লাঠির সাহায্যে দোতলায় নেমে আসতে পেরেছিলেন রেশমা। দীর্ঘ ১৭ দিনের অনিদ্রা, অনাহার আর দুর্গন্ধের কারণে একেক সময় বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন রেশমা। পরক্ষণেই আবার জীবন যুদ্ধ শুরু করেছেন তিনি। দীর্ঘ ১৫ দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকা শুকনো খাবার ও পানি খেয়ে বেঁচেছিলেন রেশমা। কিন্তু গত দুই দিন কোনো খাবার ছিল না। ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজি করে কুড়িয়ে পান একটু খানি পানি। ওই পানিটুকু নিয়েই জীবনের আশা বাঁচিয়ে রাখেন রেশমা। দীর্ঘ ৩৯১ ঘণ্টা অন্ধকার মৃত্যুকূপে মৃত্যুর শীতল স্পর্শের সঙ্গে এভাবেই পাশাপাশি বসবাস করছিলেন রেশমা।

গতকাল ভবন ধসের ১৭তম দিনে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী টিম ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ভবনের চতুর্থ, তৃতীয় ও দোতলায় উদ্ধার অভিযান ও ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ পরিচালনা করছিলেন। ধ্বংস স্তূপের নীচে লাশের সন্ধানে তাঁরা যন্ত্রপাতি দিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার এক পর্যায়ে ভবনের বেসমেন্টে পানির সন্ধান পান। এই পর্যায়ে বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে হঠাৎ উদ্ধারকারী দলের সেনা সদস্য ওয়ারেন্ট অফিসার রাজ্জাক ভবনের দোতলার একটি ছোট গর্তের ভেতর এসএস রডের পাইপ নাড়াচড়া দেখতে পান। দ্রুত সেখানে উদ্ধারকারী দল ছুটে যায় এবং উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণকারী সেনা সদস্য জেসিও ওয়ারেন্ট অফিসার রাজ্জাক কংক্রিটের একটি ছোট স্লাব সরিয়ে একটি দুই ইঞ্চি পরিমান ফাঁকা স্থান থেকে মেয়েটিকে দেখতে পান। তারপর সেনা সদস্য রাজ্জাক ও তাঁর কিছু সহকর্মী ওই ছোট ফাঁকা স্থানটিকে সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে হাত-করাত ও বাটালের মাধ্যমে বড় করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তাঁরা মেয়েটিকে খাবার পানি ও শুকনো বিস্কিট সরবাহ করেন এবং জানতে পারেন মেয়েটির নাম রেশমা। রেশমা উদ্ধারকারীদের জানান, দীর্ঘ ১৫ দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকা শুকনো খাবার ও পানি খেয়ে বেঁচেছিলেন রেশমা। কিন্তু গত দুই দিন কোনো খাবার ছিল না। কেবল একটু পানি ছিল তাঁর সম্বল। উদ্ধারকর্মী সেনা সদস্য রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, রানা প্লাজার আন্ডারগ্রাউন্ড তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কারণ ধসের সময় একটির পর আরেকটি বিম পড়ে সেখানে মোটামুটি প্রায় দশ ফুট বাই আটু ফুট আকারের একটি বেশ বড়সড় ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়েছিলো। সেখানে হাঁটাচলা করতে পারছিলেন রেশমা। তিনি হেঁটে আমাদের কাছে এসেছিলেন ও ভেতরে গিয়েছেন।

জীবনের সন্ধানের খবর পেয়েই সাভারের জিওসিসহ উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ছুটে যান। রেশমার জন্য খাবার, পানি ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স ও স্ট্রেচারও নিয়ে আসা হয় সেখানে। এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকেই রেশমার জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ধ্বংসস্তূপে কারো জীবিত সন্ধান পাওয়ার এবং তাঁকে জীবিত বের করে আনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা'র খবরে সাভারের রানা প্লাজা এলাকায় মুহূর্তের মধ্যে লোকে লোকরণ্য হয়ে ওঠে এবং সবাই রেশমা'র জীবিত উদ্ধারের জন্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনা করতে থাকে। এর আগে সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল জীবিত কাউকে উদ্ধার করা হয়েছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে। সেই রাতে শাহীনা আক্তার নামে এক নারীকে জীবিত পাওয়া গেলেও জীবিত উদ্ধার করা যায়নি শাহীনাকে। লোহা কাটার মেশিনের স্ফূলিঙ্গ থেকে আগুন লেগে তখন গুরুতর আহত হন উদ্ধারকর্মী এজাজ উদ্দিন কায়কোবাদ। পরে যিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। জীবিত পেয়েও শাহীনা আক্তারকে উদ্ধারের ব্যর্থতার কথা মনে রেখেই যতোটা সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যেই রেশমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন উদ্ধারকারী দল। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বিকাল ৪টা ২৬ মিনিটে রেশমাকে উদ্ধার করে সাভার সেনানিবাসের সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। রেশমা'র শরীরে খুব ডিহাইড্রেশান রয়েছে। রেশমাকে সাভার সেনানিবাসের সিএমএইচের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ১৯ বছর বয়সী এই তরুণী এখন অনেকটাই আশঙ্কামুক্ত।

কে এই রেশমা?
মেয়ের সন্ধান পাওয়ার খবরে সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে লাশের জন্য অপেক্ষারত রেশমা'র মা জোবেদা খাতুন তাৎক্ষণিকভাবেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। পরে তাকে সাভার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর হাসপাতালে জোবেদা খাতুন জানান, ভবন ধসের মাসেই রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমসে রেশমা কাজ নিয়েছিল। সাভার বাজার রোডের মনসুরুল আলম নুরুর বাড়িতে তাঁরা ভাড়া থাকতেন। স্বামী সবুজ মিয়ার সঙ্গে আড়াই বছর আগে ওই বাসায় ওঠলেও বছরখানেক আগে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর থেকে রেশমা ওই বাসায় একাই থাকতেন।
রেশমার বাবার নাম আনসার আলী। ঘোড়াঘাট উপজেলার কোশিগাড়ি এলাকায় তাঁদের বাড়ি। রেশমার বড় ভাই জায়েদ, আরেক ভাই সাদেক, আরেক বোন আসমা আর ৬০ বছর বয়সি মা জোবেদা খাতুন রেশমার লাশের সন্ধানে সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অবস্থান করছিলেন। যখনই কোনো লাশ সেখানে পৌঁছায় তাঁরা তখন রেশমাকে খুঁজতে যান। এটা গত ১৭ দিন এভাবে চলছিল। গতকাল বিকালে ভবনের নীচে রেশমা নামে একজনকে জীবিত থাকার খবরে বড় ভাই জায়েদ সেখানে ছুটে যান। বোন আসমাকে ফোন করে রেশমার একটি ছবি নিয়ে আসতে বলেন। জায়েদ দিনাজপুরে আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যবসা করেন। ভাই সাদেক ঢাকায় রিক্সা চালান। বোন আসমাও রানা প্লাজায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ভবন ধসের দিন আসমা অফিসে যায়নি। বড় বোন ফাতেমা টিভি সংবদে রেশমার উদ্ধারের খবর জানতে পারেন। সাভার সিএমএইচে বোন আসমাকে দেখে রেশমা আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, আপা...। আসমা জানান, তখন রেশমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছিল।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, এটা অবিশ্বাস করার মত ঘটনা। তখন সেখানে রাস্তায় হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়ো হয়ে উল্লাস করতে থাকেন আর বলেন, এটা মিরাকল। আল্লাহ রেশমারে বাঁচাইছে।

রেশমার চেয়ে বেশি সময় ‘টিকে থাকার’ অভিজ্ঞতা রয়েছে দু'জনের:
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ১৭ দিন আটক থেকে বেঁচে আসা রেশমার চেয়ে বেশি সময় এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে এর আগে বাঁচতে পেরেছিলেন মাত্র দু'জন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালে পাকিস্তানে ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া ঘরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েছিলেন নাকাশা বিবি। যিনি পঁচা খাবার আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন ৬৩ দিন। ৬৩ তম দিনে নাকাশা বাবাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। আর ২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি বিপণীবিতানের ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন আটক থাকার পর জীবিত উদ্ধার হন ইভান্স মোনসিজনাক। যিনি পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
আর ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামপোং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ধসের ১৭ দিন পর পার্ক সেউং হায়ুন নামে ১৯ বছরের এক কিশোরীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। বৃষ্টির পানি খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন হায়ুন। এছাড়া ১৯৯০ সালে ফিলিপাইনে ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া একটি হোটেলের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৪ দিন আটকা থাকার পর জীবিত উদ্ধার হয়েছিলেন পেদরিতো দি। পানি আর প্রস্রাব খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন পেদরিতো।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ার সপ্তদশ দিনে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়ার পর পোশাকশিল্প কর্মী রেশমা এখন সারা বিশ্বের মিডিয়ায় প্রধান খবর হয়েছেন। জয়তু রেশমা। জয়তু উদ্ধার অভিযানে নের্তৃত্ব দেওয়া অকুতোভয় বীরসেনানী। জয়তু মানবতা। জীবনের নতুন নাম এখন কোশিগাড়ি'র রেশমা।


সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:১২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×