somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ার বাঁধন

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মোবাইল ফোনে পরিচয় হয়েছিল মেয়েটির সাথে। কিছুদিন পর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রথম দেখেছিলাম শ্যামল বর্ণের মিষ্টি চেহারার মেয়েটিকে। নিরহংকারী, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী মেয়েটির চালচলনে ছিল কৌলিন্যের ছাপ। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং শালীন ও পরিশীলিত পোষাক-পরিচ্ছদে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল সে সম্ভ্রান্ত বংশের শ্যামবর্ণের হীরক খন্ড। নিজেকে বড় করে প্রকাশের বিন্দুমাত্র কোশেশ ছিল না তার মাধ্যে। সেদিন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক কিন্তু সে ছিল শান্ত ও মার্জিত। মেধা ও বুদ্ধিতে দীপ্তিমান চেহারায় ছিল দুঃখবোধের প্রচ্ছন্ন ছাপ। কেন যেন মেয়েটিকে খুব আপন মনে হলো।

পরবর্তীতে কিছু গিফট নেয়ার জন্য সে আমাদের মতিঝিলের অফিসে এসেছিল। গিফট ডিস্ট্রিবিউশনে দায়িত্বরত কলিগের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমার বড় মেয়ে। কলিগের চোখ বিস্ফোরিত হওয়ার উপক্রম! মেয়েটিও আমার মুখের দিকে বোকার মতো চেয়ে আছে! কলিগের বিস্ময়ের ঘোর কাটছেই না। নড়েচড়ে বসে বললেন, আপনার মেয়ে তো মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ছে। হেসে বললাম, ও যশোর মনিরামপুরের রিয়া - যার কথা আপনাকে কয়দিন ধরে বলছিলাম। এবার এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। ভিকারুননিসায় একাদশে ভর্তি হয়েছে। গিফটসহ রিয়াকে মতিঝিলে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বললাম, মা মনদিয়ে পড়াশুনা করিও। সে বললো জ্বী আঙ্কল!

মাঝে মাঝে রিয়া এবং তার বাবার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয়। রিয়ার বাবা মোঃ মশিউর রহমান একজন নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। তিনি যশোরের মনিরামপুর থানার শ্যামকুর ইউপির চেয়ারম্যান। জনসেবা তার ধা্যান-জ্ঞান। গত অক্টোবরে হঠাৎ ফুফুর অসুস্থতার খবর পেয়ে যশোর যাই। মশিউর ভাইকে ফোন করে বললাম, ভাই আমি তো এখন যশোরে। তিনি বেশ রেগে বললেন, 'আপনি যশোর আসবেন, আমাকে আগে জানিয়ে আসবেন না? আমি তো এখন মনিরামপুরে একটি শালিসে আছি। কাল দুপুরে আমার বাসায় ভোজনের দওয়াত রইল।' বললাম, ভাই খাওয়া হয়তো হবে না, তবে আপনার সাথে দেখা না করে ঢাকায় ফেরার ইচ্ছে নেই।

পরদিন সন্ধ্যায় আমার বন্ধু ব্যাংক কর্মকর্তা আলমগীর তার মোটর সাইকেলে করে আমাকে নিয়ে যায় মশিউর ভাইয়ের বেজ পাড়ার বাসায় । গেইট থেকে মশিউর ভাই, তার ভাতিজা বাবলু এবং ছোট দুই মেয়ে প্রিয়া ও সুইটি আমাদেরকে রিসিভ করে। মনে হলো তারা কত যুগযুগের আপন অথচ আজই প্রথম দেখা! মানুষের ভালোবাসা বুঝি এরকমই হয়! ভালোবাসার জাদুতে পরও এভাবে আপন হয়ে যায়! সুইটি তো আনন্দে আত্মহারা। খুব মিষ্টি মেয়ে। সে যেন কাননে প্রসফুটিত সূর্যমুখী ফুলের মতো হেসেই হয়রান। প্রিয়াও খুব খুশী। রিয়া থাকলে আরো আনন্দঘন হয়ে উঠতো এ মজলিশ। টেবিলে নাস্তা এসে গেছে। অপেক্ষায় ছিলাম ভাবীর। মশিউর ভাই সম্ভবত বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বললেন, ভাই আপনি হয়তো জানেন না রিয়ার আম্মু বেঁচে নেই! ভিতরটা খচ্ করে উঠে। মুহূর্তের মধ্যে বিষাদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে হর্ষোল্লসিত বৈঠক। সুইটি একেবারেই চুপ মেরে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, হায় খোদা একি শুনালে তুমি!

নাস্তা খেতে খেতে মশিউর ভাই বলে যাচ্ছেন, 'আপনার ভাবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা এবং একনিষ্ঠ সমাজ সেবক। এলাকার জনগণের সুখ-দুঃখের সাথী। আমি রসিকতা করে মাঝে মাঝে বলতাম তুমিই তো চেয়ারম্যান! সে হেসে বলতো, শিরনি পেয়েছো কার উছিলায় পীর চিনলা না! দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নির্মল আনন্দ পেতো সে। মানুষকে সাহায্য করতে পারলে পরম তৃপ্তি পেতো। এলাকার মানুষেরা তাকে খুব ভালোবাসতো। অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ছিল আপনার ভাবী। মৃতু্যর পর ওর জানায় মানুষের ঢল নেমে ছিল। এতদঞ্চলে এতো বড়ো জানাজা আর দ্বিতীয়টি হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।' ধীরে ধীরে মশিউর ভাইয়ের কন্ঠ ভারী হয়ে উঠছে। ভাবীর বিরহ কষ্টে তার মুখ নীল হয়ে আসছে। মশিউর ভাইয়ের হাহাকারের কথা ভেবেই হয়তো কবি গুরু লেখেছিলেন, 'ওরে অভিমানিনী / এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানি নি / পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দুদিন এসেছিলি / সকল সহা সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি / হেলায় বিদায় দিনু যারে / ভেবেছিনু ভুলব তারে / হায়। ভোলা কি তা যায় / ওরে হারামনি এখন কাঁদি দিবস যামিনী।'

মশিউর ভাই বলে যাচ্ছে আর আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি, 'ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের অদ্ভুত শাসনামলে বার বার গ্রেফতার হচ্ছিলাম। সেনা সমর্থিত শাসকের শ্যেন দৃষ্টির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে স্বাভাবকি জীবন বিপর্যস্ত। অধিকাংশ সময় আমাকে থাকতে হতো এলাকায়। এদিকে বেঁচে নেই আপনার ভাবী। সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিস্থিতিতে রিয়া এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে! ভাবতেও পারিনি এরকম বিপদ সংকুল অবস্থা মোকাবেলা করে সে এতো ভালো রেজাল্ট করবে। একই পরিস্থিতিতে প্রিয়া যশোর জেলা শহরে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে! আল্লার রহমতে সুইটিও পড়াশুনায় খুব ভালো।' মনে মনে বললাম, মেয়েগুলোর মা বেঁচে নেই, বাবা থেকেও পাশে নেই, তারপরও এত ভালো রেজাল্ট। এতো হৃদয়গ্রাহী ব্যবহার। এতো সুন্দর শিষ্টাচার! মশিউর ভাই সুইটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'মেয়েটি খুব চটপটে ছিল। ওর মা মারা যাওয়ার পর নিজর্ীব হয়ে পড়ে। খুব কষ্ট লাগে ওদের জন্য। রাতে যখন বাড়ীতে একা ঘুমাতে যাই তখন কষ্টে দু'পাশের পাঁজর ভেঙ্গে একাকার হতে চায়।'

ইতোমধ্যে আমাদের বৈঠকে এসে যোগ দেন দায়িত্বশীল মমতাময়ী আরেক মা। মশিউর ভাই পরিচয় করিয়ে বললেন, 'তিনি আমার বড় ভাবী। প্রিয়াদের ভালোবাসার মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েছেন। রিয়ার মায়ের মৃতু্যর পর তিনিই ওদের আগলে রেখেছেন। বড় ভাই থাকেন গ্রামে। তার বয়স হয়েছে, প্রায়শ: অসুস্থ থাকেন। তারপরও ভাবী শুধুমাত্র ওদের ভালোবাসার টানে পড়ে আছেন এ শহরে।' গল্পে গল্পে অনেক সময় গড়িয়েছে। উঠে যাবো টেরপেয়েই সুইটির আকুল আবেদন আঙ্কেল আজ থেকে যান। অকৃত্রিম ভালোবাসার নির্মল বহি:প্রকাশ। হাসতে হাসতে বললাম, আম্মু আজ নয় অন্যদিন এসে থাকবো। তোমরা আঙ্কেলের বাসায় বেড়াতে যেও। মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে সম্মতি জানালো সুইটি। চলে এসেছি ঠিকই, তবে নিজের অজান্তেই মনটাকে ফেলে এসেছি সুইটি-প্রিয়াদের উচ্ছ্বসিত মিষ্টি হাসির শুভ্র ঝর্ণা ধারায়। ওদের সোনালী উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মিনতি রইল প্রভুর দরবারে। আর ওদের মমতাময়ী মায়ের জন্য রইলো মাগফিরাতের কামনা।

বিঃদ্রঃ গত জেএসসি পরীক্ষায় প্রিয়া গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৯:৫৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×