somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিশর বিপ্লবের ফসল এবার কার ঘরে উঠবে ?

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘরপোড়া গরুর মত বিপ্লবের পরপরেই বিপ্লবীদের আনন্দ মিছিলের সময়টাতে আমার মনের ভিতর কু-ডাক ডাকতে থাকে । গণমানুষের বিপ্লবের ভিতর যে অপার্থিব সৌন্দর্যের জোয়ার থাকে তার ভয়ে বিপ্লবের সময়ে শয়তানের প্রেতাত্নারা লুকিয়ে থাকলেও, মানুষের আনন্দের জোয়ারের পরপরেই তারা লেগে যাবে তাদের কাজে । বিপ্লবের ফসল ছিনতাইয়ের কাজে ।

ইরান বিপ্লবের সময়ে আমার জন্মই হয় নাই । আমরা যারা শেষ-নব্বইয়ে বালেগ হইছি তাদের মধ্যে এক সময়ে (সবার মধ্যে কিনা জানিনা) একটা ভাবনা মনে আসছিলো । সেটা হইলো আমরা একটা বোরিং সময়ে বাস করি । গণজোয়ারগুলো সব আমাদের জন্মের আগে হইছে অথবা যেগুলা আমাদের সময়ের ভিতরে হইছে সেইগুলার সময়েও আমরা শিশু । বার্লিন প্রাচীরের পতন, বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এইসব ঘটার সময়ে আমরা পৃথিবীতে বর্তমান থাকলেও, সেই বিপ্লবের অনুভব বা স্মৃতি কোনটাই আমাদের নাই । থাকার মধ্যে যেটুকু আছে শুধু রুয়ান্ডা গণহত্যার বিবমিষাকর অনুভুতি আর স্মৃতি । বাইরের খবর কম রাখা পাব্লিকের মধ্যেও তা-ও ছিলনা ।

নতুন সহস্রাব্দে আমাদের সেই খেদ মিটায়ে এখন বরং আর দিয়েন না খালাম্মা ধরণের অবস্থা হয়ে গেছে । সহস্রাব্দের শুরুতেই নাইন ইলেভেন, আফগান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ , দারফুর গণহত্যা এইসবে ত্যাক্ত হইলেও কেউ হয়ত স্বপ্নেও ভাবি নাই আরব দুনিয়ায় কিছু হবে কোনদিন । পৃথিবীর মধ্যভাগের এই ভূখন্ডটা আরো কয়েক শতক জুড়েই চৌদ্দশ বছর আগের স্ট্যান্ডার্ডে পড়ে থাকবে এই ছিলো মোটামুটি ধারণা ।

আমাদের হতাশার মুখে ঝাপটা দিয়া আরব দুনিয়া ফুঁসে উঠেছে দানবের মত । এক্কেবারে জর্ডান থেকে মরক্কো পর্যন্ত । কিন্তু ইরান বিপ্লবের বিশ্লেষণ যারা ইছলামি সানগ্লাস খুলে দেখেছে তারা হয়ত আমার মতই এর মধ্যেই ভিতরে ভিতরে টানাপোড়েন এ পড়ে গেছে । ইরান বিপ্লবের সংঘঠক ছিলো শাহ এর সামন্ত শাসণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা সাম্যবাদীরা । তাদের সাথে ছিলো পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণে ইছলামি কাঠামোর অবক্ষয়ে ক্ষিপ্ত হওয়া কিছু কট্টরপন্থী । সাম্যবাদীরা মনে করছিলো এরা হালে পানি পাবে না । কারণ ইরানের আছে হাজার বছরের পুরোনো নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি আদর্শ । কিন্তু বিপ্লবের শেষে ঠিকই খোমেনী বীরের খেতাব নিয়া দেশে ফিরলো আর ইরান শুরু করলো উল্টাদিকে পথচলা ।

মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবীরা / সেক্যুলাররা সম্ভবত বারবারই এই ভুল করে যাবে । সেইটা হলো আরব দুনিয়ায় ইসলামের মূলকে ছোট করে দেখা । ১৪০০ বছর একটা বিশাল সময় । একটা চাপায়ে দেয়া সংস্কৃতিই এই সময়ের মধ্যে মূলধারা হয়ে উঠতে পারে একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে । এমনকি নৃতত্বেও যোগ হয়ে যেতে পারে । দক্ষিণ আমেরিকা আর ওশেনিয়াতো মাত্র কয়েকশ বছরের মধ্যেই একশভাগ ভিন্ন জিনিস হয়ে গেছে ।

আমার একটা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ হইলো, মূল আরব ভূখন্ডের তুলনায় বরং তার আশেপাশের আরব অঞ্ছলগুলাতেই ইসলামের প্রভাব বেশি । মূল আরব উপদ্বীপে ধর্মটা একটা কালচার । কালচারে সাথে ব্লেন্ড হয়ে ধর্মের মৌলিকত্ব বা মৌলবাদীতা বা আদর্শটা হয়ে গেছে গৌণ । দিনে পাঁচবার নামায পড়া একজন ছৌদি বা ওমানিজ বা ইয়েমেনিজ এর কাছে তেমন বড় কোন ব্যাপার না । দিনে তিনবার খাবারের মতই ।

কিন্তু আরব ভুখন্ডের আশেপাশের যে অঞ্চলগুলার নিজস্ব ইতিহাস আছে হাজার হাজার বছরের, তাদের কাছে ইসলাম ধর্ম হিসাবে তার পুরা মৌলিক গুনাগুন এবং আদর্শ নিয়াই অবস্থান করে । কালচারের জন্য তাদের ইসলামের কাছে যাইতে হয় না । এইটাই বিপরীতক্রমে কালচারে সাথে মিশায়া ধর্মের ঘনত্বরে পাতলা হইয়া যাওয়া থেকে বাঁচায় । ছৌদি পোলাটা পার্টির মাঝখানে বিয়ারের আধখাওয়া গ্লাস টেবিলে রাইখা চিপায় গিয়া গলার চাদরটা বিছায়া ওযুটযু ছাড়াই একটু ব্যায়াম কইরা আসতে পারে , কিন্তু সিরিয়ানটা বা মিশরীটা পারে না ।

মিশর বিপ্লবের সংঘটকদের এই জিনিসটা বুঝতে হবে যত দ্রুত সম্ভব । বিপ্লবের আনন্দের মাঝখানেই । ধর্মের কল্লাটার উপরে সামান্যতম আঘাত আসলেই জনজোয়ারের গতি উল্টা দিকে যাবে । মুসলিম ব্রাদারহুড ঘাপটি মাইরা আছে সেই সুযোগটার জন্যই ।

মুসলিম ব্রাদারহুডরে বাংলাদেশের জামাতের মত কইরা দেখার কোন উপায় নাই । এর বিস্তৃতি অনেক অনেক ব্যাপক । এবং সবচে বড় কথা এর কোন কলংকিত ইতিহাস নাই । মিশরীয় জনগণের সার্বিক চেতনার বিরুদ্ধে এরা এখনো কোন কাজ করে নাই । আল কায়েদা বা জানজাবিদের সাথে এরা নাম লেখায় নাই । এদের সমর্থক স্পেক্ট্রাম অনেক বিস্তারিত । কাঠমোল্লা থেকে শুরু কইরা এক্কেবারে রিভিশনিস্ট, মডার্ন ডিজুস পর্যন্ত । এরা ক্ষমতা কাঠামোর ভিতরে ঢুকা শুরু করলে , তোরা রাজাকার বা জংগী এমন কিছু বইলা থামায়া দেয়ার কোন সুযোগ নাই ।

কিন্তু আরো বুঝতে হবে এই মুসলিম ব্রাদারহুডের মাস্টারমাইন্ড কুতুব মিয়া কিন্তু কট্টরপন্থী কাঠমোল্লাই । সমর্থকের স্পেক্ট্রাম যত বিস্তীর্ণই হোক, মূলধারা কিন্তু আম্রিকার বিচে গিয়া ল্যাঙটা মাইয়া মানুষ দেইখা পশ্চিম ইকুয়েলটু মাইয়ারা ল্যাঙটা হইয়া রাস্তায় হাঁটে এই ধারণা থাইকা জন্ম নেয়া । সাধারণভাবে এ ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়া নবজন্ম পাওয়া মৌলবাদীটা স্থানীয় মাদ্রাসা পাশ মৌলবাদীটার তুলনায় হাজার গুন বেশি কট্টর হয় । ক্ষমতা কাঠামোয় মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশগ্রহণে এইজন্য আগ্রহের জায়গা মিশরীদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের চাইতে বরং পশ্চিম বিরোধীতা , ধর্মান্ধতার লালন এইসবের দিকেই থাকবে বেশি ।

যদি বিপ্লবের ফসল সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছাইয়া দেয়ার উদ্দেশ্য থাকে, যদি শোষণহীন জ্ঞানভিত্তিক যুক্তিমনস্ক মিশরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয় মিশর বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ডদের বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হইতে হবে মুসলিম ব্রাদারহুডের তুলনায় অনেক বেশি । পরিকল্পনা থাকতে হবে কমপক্ষে ৫০ বছর পরের মিশরকে কেমন দেখতে চায় সেই ভিত্তিতে ।

আম্রিকা ইসরায়েলি জোট আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক/জনগণের সার্বিক ইচ্ছাকে মূল্য দেয়ার মত সরকার চায় না । তারা বরং একনায়কতন্ত্রই চায় । কারণ তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের মানবতা বা স্বাধীনতা বোধের বড়ি বিশাল একটা জনগোষ্ঠীরে গেলানো সম্ভব না । মিলিয়নের উপরে মানুষরে ভুজং ভাজং দিয়া বুঝানো যায় না । একনায়করে ভুজং ভাজং বা ব্যক্তিগত লোভ দিয়া বুঝানো যায় । মোবারকের পতনে আম্রিকা বা ইসরায়েলের খুশি হওয়ার কোন কারণ নাই এইজন্য । শাহ এর পতনেও খুশি হয় নাই তারা এইজন্যই ।

ভয়ের জায়গা হইলো মিশরে বা তিউনিশিয়ায় বা কিছুদিন পরে জর্ডান , এবং সাহস কইরা বইলাই ফেলি - লিবিয়াতেও যদি গণজোয়ার আসে এবং সেই অনুসারে ক্ষমতা কাঠামো পরিবর্তন হয়, নতুন কাঠামোতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের আদর্শের জায়গাতে খুশি হওয়ার মত তেমন কিছু নাই । এখন পর্যন্ত আরব দুনিয়ার জোয়ারের ট্রিগার চাপছে হয় অর্থনৈতিক দুর্দশা অথবা চৌদ্দশ বছরের রদ্দি আদর্শের ঠেলা । এই দুইটার কোনটাই ফরাসি বিপ্লব বা বাংলাদেশ বিপ্লবের (ভাষা আন্দোলন থাইকা শুরু কইরা, নিজস্বতার চেতনা) মত জ্ঞানভিত্তিক আদর্শ না । এইটা ঠিক , যারা গণজোয়ারগুলা শুরু করছে তারা ঠিকই জ্ঞানভিত্তিক মানব-সাম্যভিত্তিক অবস্থান থাইকাই শুরু করছে । কিন্তু আমজনতার জোয়ার নামছে সেই পুরাতন ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক দুর্দশা বা ধর্মপ্রেমের ঠেলা থেকেই । এই জোয়াররে জ্ঞান-সাম্য-ন্যায়বিচারের আদর্শের সাথে মিলানির জন্য অনেক লেভেলে অনেকরকম বিপ্লবের দরকার । নাইলে কয়েকবছরের মধ্যেই একদিকে পশ্চিমের সাথে অর্থবহ এবং অনর্থক দুইরকমেরই খিটমিট আর নিজ জনগণের স্বাধীনতার ইচ্ছারে গুলি বারুদ ডান্ডা দিয়া দমানোর প্রবণতা মিলায়া ইরানের মত লেজেগোবরেগুয়েমুতে দশা হবে সবগুলা বিপ্লবের আফটারম্যাথে ।

আপাতত আরব দুনিয়ার মানুষের সুবিবেচনার উপরে আশা রাখি ।
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধে নিহত মনোজ দা’র বাবা

লিখেছেন প্রামানিক, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিয়ে থেতে ভাল্লাগে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৯

আমার বিয়ে বাড়ির খাবার খেতে ভালো লাগে। আমাকে কেউ বিয়ের দাওয়াত দিলে আমার খুসি লাগে। বিয়ের দিন আমি সেজে গুজে বিয়ে বাড়িতে আয়োজন করা খাবার থেতে যাই। আমাদের এলাকায় বর্তমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুর সামনের পাতার ৯টি পোষ্টে শুন্য (০ ) মন্তব্য।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০



আজকে সকালে একটু দেরীতে ( নিউইয়র্ক সময়, সকাল ৮:২১ ) সামুতে লগিন করলাম; লগিন করে আজকাল প্রথমে নিজের লগিন স্ট্যাটাস পরীক্ষা করি: এখনো সেমিব্যানে আছি। মোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

উসমানীয় সাম্রাজ্যের উসমান এখন বাংলাদেশে

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০



জনপ্রিয় ''কুরুলুস উসমান'' সিরিজের নায়ক Burak Ozcivit এখন বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছর ধরে তার্কির অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুলতানদের নিয়ে নির্মিত সিরিজগুলো বিশ্বব্যপী বেশ সারা ফেলেছে। মুসলিমদের মাঝেতো বটেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×