আজ হতে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা, একদিন সন্ধায় বাড়িতে কাউকে না বলে বেরিয়ে পড়ি হাতে ছিল মাত্র ৬০০ টাকা। সময়টা ছিল আমার এস এস সির রেজাল্ট আউটের আগের। বাড়ি হতে বের হয়ে টেম্পু যোগে গেলাম আমাদের রাস্তার মাথা থেকে ১ কিঃ মিঃ দূরে পদুয়া, সেখান থেকে ঢাকার একটি নৈশ বাস চেপে যখন রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম তখন মন ছিল নানা চিন্তায় বিভোর। ভাবছিলাম আমার নিরুদ্দেষ হওয়ার খবরে আম্মুর অবস্থা কেমন, প্রিয় শামিমকেও খুব মনে পড়ছিল, এভাবে আমাদের গাড়ি রাত ৮টায় ঢাকায় গিয়ে পৌছল। ঢাকা আমার কাছে একেবারেই নতুন, তাই বাড়তি টেনশনও ছিল। সায়েদাবাদের একটি মসজিদে ইশার নামাজ পড়ে মুয়াজ্জিনের কথামত রাজশাহির অজানা ঠিকানায় হারিয়ে যেতে গাবতলি যখন পৌছলাম ততক্ষনে রাত ১১টা। আর এতো রাতে ওদিকে কোন গাড়ী না থাকার খবরে একেবারেই মুষড়ে পড়লাম। কারন ঢাকা আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত, কোথায় যাব, কি করব এই ভেবেই অস্থির। আনমনে হাটছিলাম, কাধে ছিল ছোট্ট একটি ব্যাগ, ঠিক ওই সময় দুজন লোক আমাকে পিছন থেকে ডাক দিল, আমিতো ভাবলাম চোর ডাকাত কেও হবে। আমার ভাবনার জাল ছিড়ে তারা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কই যাবা, আর কেনইবা এত রাতে এভাবে ঘুরছ। আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিলামনা। রাজশাহীর কোন জায়গার নাম বলাতো দূরের কথা কখনো শুনিওনি, তাই উত্তর দিতে ইতস্তত করছিলাম, এতে তারা বুঝে গেল যে, আমি ঘর ছেড়ে পালিয়েছি। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম বলে তাদের ধারনা আমুলক ছিলনা। তারা আমাকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেনি, শুধু বাড়ির নাম ঠিকানাই জানতে চেয়েছিল, হয়ত চেহারা দেখে ভদ্র মনে হয়েছে বলে। আর আমিও মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। আসলে তারা ছিল উন্নত একটি নৈশ কোচের ড্রাইভার ও সূপার ভাইজার যারা আচরনে ছিলেন ভদ্র ও নম্র। আমাকে তাদের গাড়িতে নিয়ে এই বলে ভরসা দিল যে, আমাদেরকে তোমার খারাপ মানুষ মনে হলে তুমি নেমে যেতে পার। আর বিলিভ করতে পারলে নিরাপদে বাসেই থাকতে পার। তারপর পিছনের দিকের আসনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। চিন্তার জটলায় ঘুম আসছিলনা, তারা আমাকে নিয়ে ভাল ভাল মন্তব্য করতে লাগল। এক ফোটা ঘুম ও হইনি সারা রাত। পরদিন ব্যাস্ততম ঢাকার কোলাহলে জেগে উঠলাম। আমি গেলাম নাস্তা করতে আর এই ফাকে তারা আমার জন্য রাজশাহির টিকেট করে নিয়ে আসলেন ও গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল অজানার ঠিকানায়, এর ভিতর আমার পরিচয় হল তাবলিগ জামাতের একটি দলের সাথে, পরিচয় হওয়াতে ভাবলাম ভালই হল, তাদের সাথে দুই একদিন থেকে এলাকাটা পরিচিত হয়ে সেখানে থাকা যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে আর রাস্তার দুই পাশের প্রাক্রিতিকে উপভোগ করে এগিয়ে চল্লাম। আমাদের গাড়ি যখন ফেরিতে গিয়ে উঠল তখন বোধ হই দিনের বারটা হবে। এই ফেরিতে ছড়াও আমার জীবনের প্রথম, তাই ভালোও লাগছিল বেশ। দুই তলায় উঠে খাবার সেরে কেবিন তথা ফেরির ৩ তলায় বসে নদীর বয়ে চলা ঢেউ উপভোগ করছিলাম। এভাবে করে আমাদের গাড়ি সন্ধার ঠিক আগে রাজশাহী শহরে গিয়ে পৌছল। ওখান থেকে বাসের ঐ তাব্লিগ জামাত সহ রাজশাহীর বিখ্যাত শাহ মাখদুম মসজিদে আসরের কাযা ও মাগরিব আদায় করলাম। তারপর আমরা তাব্লিগ জামাতের মারকাজ মসজিদে গিয়া উঠলাম। তাদের দলভুক্ত না হওয়ায় ওখানে থাকতে তারা আমার ব্যপারে আপত্তি তুলল। বিশেষ করে আমীরের সাথে মিথ্যা বলেচিলাম বলে তাদের সন্দেহ আরো প্রকট হল। যেহেতো এখানে আমি নতুন, কোন জায়গার নাম ঠিকানা কিছুই জানিনা, তাই মিথ্যা বলা ছাড়া কোন উপায় ও ছিলনা। যার প্রেক্ষিতে তারা ধরে নিল আমি ঘর পালিয়ে আসা চাওয়াল। তারপর তারা আমাকে অনেক ভয় ও উপদেশ দিয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার কথা বলল।তাদের কথা মত পর দিন ঢাকায় আসার জন্য টিকেট না পেয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম, যেখানে ঘটল আরেকটি ছোট্ট ঘটনা। কিছ দূর যাওয়ার পর একটি মেয়ে উঠল ও বসল ঠিক আমার পাশেই। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল বেশ বিপদে পরেছে সে। সে তার চাচা সহ ঢাকা যাওয়ার কথা, কিন্তু মন্দ ভাগ্য তার চাচা বাসের চাদে উঠে ভাবলেন সে ভিতরে উঠেছে, কিন্তু সে উঠতে না পেরে আমাদের গাড়িতেই উঠতে বাধ্য হয়।তারপর দুজনে একে অপরকে নিজেদের করুন কাহিনী শুনালাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার ঢাকায় পৌছার আগেই ঘুমের ঘোরে সে মেয়েটি যে কখন নেমে গেছে টেরও পাইনি।ওদিকে বাড়িতে চলছে অন্য কান্ড, চার দিকে চলছে আমার খোজ খবর, আব্বাতো পত্রিকায় খবর চাপানোর কথা পাকা করে পেলেছিলেন। আর আম্মুতো কেদে কেটে একাকার অবস্থা। যাই হউক এমনি এক হুলুস্থুল অবস্থার মাঝে আমি এসে হাজির হলাম। ওরে আললাহ আমাকে জড়িয়ে আম্মুর সেই কান্না আজো মনে পড়লে চোখ লোনা পানিতে ভিজে উঠে…………