এ আর নতুন কি যে ফি বছর শীত কিংবা গ্রীষ্মে আমাদের মনে হয় সেটাই বোধহয় স্মরণকালের তীব্রতম প্রকোপ। কিন্তু আমরা কি জানতাম, ২০১০ সাল সত্যিই গত দুই শতাব্দীর মধ্যে উষ্ণতম বছর ছিল? ১৮৮০ সাল থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতার যে রেকর্ড রাখা হয়, তাতে কেবল ২০০৫-ই গত বছরের সংগে টেক্কা দিতে পারে। ওই বছর যদিও উষ্ণতার বিষয়টি কমবেশি আলোচিত হয়েছে; জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে নানা দিক থেকে বিপন্নতম বাংলাদেশের সংবাদপত্রে এ বছরের রেকর্ড নিয়ে বাতচিত খুব সম্ভবত ছিলই না। কেবল আমরা নই, যুক্তরাজ্যেরও প্রায় একই দশা- গার্ডিয়ান ছাড়া আর কোনো দৈনিক সংবাদপত্রই ছাপা কিংবা অনলাইনে এ বিষয়ে খবর প্রকাশ করেনি। অবশ্য 'ডেইলি ক্লাইমেট' নামে একটি অনলাইন মাধ্যমের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপীই জলবায়ু সংক্রান্ত মিডিয়া 'কাভারেজ' আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমেছে।
জলবায়ু সংক্রান্ত 'সংবাদ মন্দা' সত্ত্বেও ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোতে কেন নাসা ঘোষিত ওই তথ্য অগ্রাহ্য হলো, গার্ডিয়ানে তার কড়া সমালোচনা করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের অন্যতম পরিচালক বব ওয়ার্ড। এমন ব্লাক আউটের অনেক কারণ থাকতে পারে। হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ইতিমধ্যে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন পাঠকদের আরও উদ্বিগ্ন করতে চাননি ব্রিটিশ মিডিয়া ম্যানেজাররা। তার মানে, 'ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ' বলে যে আপ্তবাক্য সাংবাদিকতায় চালু আছে, তা অগ্রাহ্যই করেছেন তারা।
আমাদের দেশে অবশ্য আপ্তবাক্যটিই যেন মূলমন্ত্র। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে এ দেশীয় সংবাদমাধ্যম সাধারণত নেতিবাচক বা রঙচড়ানো বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেয়। অন্তত বিশেষজ্ঞ মহলে এমন ধারণা রয়েছে। আমাদের সামনে হাজির দৈত্যকায় দুর্যোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দরকষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সম্মানিত এক সদস্য ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একবার খানিকটা ক্ষোভ নিয়েই বলেছিলেন যে তাদের ইতিবাচক অর্জনগুলো মিডিয়ায় আসছে না। কানকুন সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান ও অর্জন নিয়ে তিনি একটি সেমিনারে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে স্বভাবতই অনেক আশাবাদের পাশাপাশি খানিকটা সমালোচনামূলক কথাও ছিল। কিন্তু পরদিন দেখা গেল সংবাদপত্রে কেবল সমালোচনাই ছাপা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতি একই ধরনের অনুযোগ করেছিলেন আরেকজন বিশেষজ্ঞ। বলেছিলেন, কোপেনহেগেনের তিক্ত অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে কানকুনে যখন উন্নত-উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে যাওয়া প্রতিনিধিরা নূ্যনতম ঐকমত্যে পৌঁছার ব্যাপারে খুব সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক সাংবাদিক বারবার প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির অবস্থানের ব্যাপারে উস্কানিমূলক প্রশ্ন করছিলেন। চাইছিলেন, তার কাছ থেকে তির্যক কোনো বক্তব্য আদায় করতে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণায় অন্যতম পথিকৃৎ এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। বিশেষ করে অভিযোজন সংক্রান্ত গবেষণা সারা দুনিয়া শিখতে আসছে আমাদের কাছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কৃষি সংক্রান্ত যেসব গবেষণা হচ্ছে, তা সারা দুনিয়াকে পথ দেখাতে পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত আলোচনা নেই বললেই চলে।
আরেকজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ, যিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত, বলেছিলেন এই ইস্যুতে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের 'পলিটিক্যাল সিনড্রোম' নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেহেতু উন্নত বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণই প্রধানত দায়ী; সেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ 'আদায়' করতে হবে- এমন একটি সরল রাজনৈতিক অঙ্ক কমবেশি সারা দুনিয়ার অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের, তিনি বলছিলেন, এমন দাবিতে প্রভাবিত হওয়া চলবে না। সংবাদ ও বিশ্লেষণ পরিবেশনে আরও নির্মোহ হতে হবে। বুঝতে হবে যে আন্তর্জাতিক দরকষাকষি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দাবি আদায়ের মতো সরলরৈখিক নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কিছু বৈজ্ঞানিক জানাশোনাও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের জন্য জরুরি। যেমন ২০০৭ সালের আইপিসিসির চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যটি। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে। ইত্যাদি। আমাদের সংবাদমাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে এ কথাটাই ভাঙা রেকর্ডের মতো বারবার প্রচার করা হচ্ছে। আবার কিছুদিন আগে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সংবাদপত্রে বলা হল, আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে পলির পরিমাণ বাড়বে। এর ফলে দেশের বেশির ভাগ উপকূল ও নদী-তীরবর্তী এলাকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
অথচ, পরিস্থিতি এখন না আইপিসিসি, না সিইজিআইএসের ভাষ্য মেনে চলছে। একজন বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছিলেন, প্রকৃত চিত্র আসলে ভিন্ন। যোগ ও বিয়োগের ব্যাপার। সি লেভেল রাইজের হার থেকে সেডিমেন্টেশন প্রক্রিয়া বিয়োগ করতে হবে। সেডিমেন্টেশন বা পলি অপক্ষেপনের হার যদি বেশি হয়, তাহলে উপকূল স্বভাবতই ডুববে না। কিন্তু, তার মতে, এখন যে হারে সেডিমেন্টেশন হচ্ছে, যে হারে বরফ গলা পানি উজান থেকে আসছে, সমুদ্র উপরিতলের তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে- তাতে উপকূলীয় কিছু অংশ ডুবে যাওয়ার আশংকাই রয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যা আসছে, তা এককথায় ঢালাও।
সংবাদমাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংবাদের আধেয় ও পরিমাণ নিয়েও কারও কারও প্রশ্ন রয়েছে। কোনো কোনো সংবাদ পড়লে মনে হবে, বাংলাদেশে এখন যত নেতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে, সব কিছুর জন্য যেন জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ি তো উন্নত বিশ্ব। তাহলে আমাদের আর কী করার আছে! এমন খবর ও বিশ্লেষণে প্রভাবিত হয়ে যদি কেউ প্রকৃতিবিনাশী তৎপরতায় আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে কিংবা হাত গুটিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থের জন্য বসে থাকা ছাড়া পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় আর কোনো কিছু না করে, তার দায় কিন্তু সংবাদমাধ্যমকেও নিতে হবে। গঙ্গার পানির হিস্যার দোহাই দিয়ে নিজেরা দেশের আর সব নদ-নদীর বারোটা বাজানোর সর্বনাশা নজির কিন্তু আমাদের সামনে রয়েছে।
আমাদের মনে আছে, কোপেনহেগেন সম্মেলন সামনে রেখে সংবাদমাধ্যমে এমন ধারানা দেয়া হচ্ছিল যে ডেনমার্কে বাংলাদেশের জন্য টাকা ব্রিফকেসে ভরে রাখা হয়েছে; শুধু নিয়ে আসা বাকি। সাংবাদিকতা সংক্রান্ত ধ্রুপদী বিভিন্ন তত্ত্বে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে মদ, অর্থ ও নারী হচ্ছে সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সেই তত্ত্ব মেনেই কি-না জানিনা, কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে, জলবায়ু বিষয়ক সংবাদের হাট বসেছিল বাংলাদেশের মিডিয়ায়। এখন আবার কমে গেছে। অনেক সময় এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সংবাদও বাদ পড়ে যায়। জলবায় বিষয়ক সংবাদের এমন জোয়ার ও ভাটা- কোনটিই স্বাভাবিক নয়।
আলোচিত ব্লগ
মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়
১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷
চলুন গল্পটা শুনে আসি৷
বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই
রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।
ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!
~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো
রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন