somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘অপেক্ষা: ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদের সমকালীন বাস্তবতার চিত্রায়ণ’

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ থেকে অনেক বছর আগে বিখ্যাত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘রক্তবাহিত পথের কোনো সত্য ভিত্তি নেই। অন্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কেউ জীবন পেতে পারেনা’। শেক্সপিয়ারের এই কথার মাধ্যমেই কিন্তু বহুল আলোচিত জঙ্গিতৎপরতা ও জঙ্গি কার্যক্রমের অসারতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

জঙ্গিবাদ, বহুল আলোচিত একটি ইস্যু। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটি যেমন ঝড় তোলা একটি টার্ম, তেমনি বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বাস্তবতায়ও এটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, সংকটময় ও ভয়ংকর। আর এরই সফল রূপায়ণ ও চিত্রায়ণের মাধ্যম হিসেবে আমরা ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রকে দেখতে পাই।

চলচ্চিত্র হলো এমন একটি মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর একটা সচিত্র, সবাক (নির্বাক নয় এমন) ও চলমান ধারাবহিক চিত্র ফুটে ওঠে। চরিত্র-চিত্রায়ণ আর ঘটনার ক্রম রূপায়ণের একটা সাবলীল ও শক্তিশালী মাধ্যম বা মিডিয়া এই চলচ্চিত্র। বিভিন্ন বিষয়, ঘটনা, গল্প-কাহিনী বা প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ভিডিওগ্রাফি, নিখুঁত এডিটিংয়ের মাধ্যমে এমনভাবে এটি দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, যা দর্শকদের একটা ভিজ্যুয়াল প্লেজার দেয়, অনুভূতির দরজায় ধাক্কা দেয়, আঘাত হানে। আর উপস্থাপনার দিক থেকে বৈচিত্র্য তো আছেই।

প্রায় এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিটের ছবি ‘অপেক্ষা’। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ। আর তারই সৃষ্টি এই ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রটি, যার গল্প ও কাহিনী আবর্তিত হয়েছে জঙ্গিবাদকে ঘিরে। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে এ চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গিবাদের স্বরূপ। উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর বাস্তব চিত্র ও করুণ, মর্মান্তিক দৃশ্য। গ্রাম থেকে শহরে উঠে আসা একটি ছেলে জঙ্গিতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে; যা কিনা ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদের নামকে পুঁজি করে, অবলম্বন করে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের সমকালীন বাস্তবতায় ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ তথা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে এখানে। ‘অপেক্ষা’ ছবিটিতে আরও উঠে এসেছে কিভাবে ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদের নিষ্ঠুর আঘাতে, কালো ছায়ায় ধক্ষংস হয়ে যায় একালের তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রসমাজ ও তাদের ভবিষ্যত। তাছাড়া উঠে এসেছে কিভাবে বোমার আঘাতে লাশ হয়ে যায় কত শত শত প্রাণ, হারিয়ে যায় হাজারো স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা।

শুরুতেই বহমান এক নদীর অপরূপ দৃশ্য, চারিদিকে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির ছায়া। গ্রাম বাংলার এক চিরায়ত অপরূপ রূপ, সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এভাবেই শুরু ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন। এই ছবিটির গল্প-কাহিনীর বর্ণনার আগে একটা অবশ্যই বলতেই হয়। সেটি হলো ‘অপেক্ষা’র শুরুটাই অপেক্ষা দিয়ে। ভোরের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ, গ্রামের কোনো একটি গৃহের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। তারপর মুরগির খোয়ার থেকে ডিম সংগ্রহ। দৃশ্য নির্মাণে যেন এক দক্ষ, ভিন্ন যোজনা; সবই অসাধারণ।

‘‘উজান বাউয়ে পাল সাজাই, হাওয়ারে তোর দেখা নাই....’’। এমনিভাবে মন জয় করা এক ভাটিয়ালী গানের সুরে হারিয়ে যায় আমাদের হৃদয়। অতঃপর, গল্পের শুরু, কাহিনীর নির্মাণ, বাস্তবতার চিত্রায়ণ।

পলাশতলী গ্রাম, সেই গ্রামেরই বৃদ্ধা দাদী। নাম মরিয়ম বেগম। নাতি রবিউল হাসান ঢাকা শহরে একটা মেসে থাকে, গান গায়। অনেক দিন ধরে দাদী তাঁর আদরের নাতিকে দেখেন না। নাতির কথা মনে পড়লেই দাদী ছুটে যান প্রতিবেশী এক মাস্টারের কাছে চিঠি লিখে দেয়ার জন্যে। চিঠির মাধ্যমে দাদীর যে বক্তব্য উঠে আসে তার সারমর্ম হলো এই- ‘‘প্রিয় রবিউল, তুমি শহরে গিয়া তোমার দাদীকে ভুলিয়া গিয়াছ। তুমি খুব দ্রুত সময় করিয়া গ্রামে আসিয়া তোমার হতভাগী দাদীকে দেখিয়া যাও।’’ এভাবেই এক আবেগী, মায়াভরা দৃশ্যপট ভেসে ওঠে এই বৃদ্ধার উপস্থিতিতে। বৃদ্ধা দাদী এক এক করে চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নাতির কাছে। কিন্তু কোনো চিঠির কোনো জবাব আসে না। এদিকে নাতি রবিউল স্বপ্ন দেখে, একদিন বড় শিল্পী হবে। সে দাদীর চিঠি পড়ে আর বন্ধুকে বলে, ‘‘এবারে গানের অ্যালবামের কাজটি শেষ হলেই গ্রাম থেকে একবার ঘুরে আসবো।’’ কিন্তু আসলেই কী রবিউল পারে গ্রামে গিয়ে একবার তার প্রিয় দাদীকে দেখে আসতে? নাকি প্রাণহীন একটি দেহ, একটি লাশ হয়ে ফিরে যায় গ্রামে?

অন্যদিকে আরেকটি গ্রামের ছেলে রেজাউল করিম। ডাক নাম রঞ্জু। শহরের একটি কলেজে পড়ে; থাকে কলেজ হোস্টেলে। পড়াশুনায় বেশ ভালো, রেজাল্টও ভালো। বাবার নাম আতাউল করিম। বাবা গ্রামের সহজ সরল মানুষ। এই মানুষটিই অনেক স্বপ্ন দেখেন তাঁর মেধাবী, ভালো ছেলেটিকে নিয়ে। রঞ্জু ১২ জুন বাড়ি আসে। আবার একদিন থেকে চলে যায়। যাবার সময় বাবা-মা বলে আর ক’টা দিন থেকে যেতে, বোনের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু কাজের কথা বলে রঞ্জু ওই দিনই চলে আসে বাড়ি থেকে।

‘‘ভব নায়ে চরলি একা, নামবি একা; মাঝ গাঙেতে রইলি তুই সঙ্গী ছাড়া....’’। তারপর গানের একটি আসরে হঠাৎ বোমা হামলা। বোমা বিস্ফোরণে সাতজন মারা গেছেন। পর্দায় ভেসে ওঠে রক্তাক্ত লাশ। প্রেসের সংবাদ উৎপাদন, সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টে বলা হয়, এতে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর এই বোমা হামলাতেই মর্মান্তিকভাবে মারা যায় রবিউল। গাড়িতে করে রবিউলের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের সবাই প্রথমে এই গরিব অজপাড়া গায়ে গাড়ি দেখে জরো হতে লাগলো। ভাবতে লাগলো, না জানি কি না কী এসেছে- হয়তো কোনো ত্রাণ সামগ্রী বা কোনো সরকারি সহায়তা। এরপর গ্রামবাসী দেখলো তাদের প্রিয় রবিউলের লাশ। আর দাদী দেখলেন তাঁর আদরের নাতির মৃত লাশ!!

এদিকে পুলিশ এসেছে আতাউল করিমের বাড়িতে। পুলিশ এসেছে তাঁরই ছেলে রেজাউল করিম রঞ্জুর খোঁজে। বাবা প্রথমে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন, কী হয়েছে? পুলিশ বলে, ওকে থানায় নিয়ে যেতে হবে; অভিযোগ আছে। তারপর পুলিশ রঞ্জুকে না পেয়ে রঞ্জুর রুম সার্চ করে। পুলিশ রঞ্জুর রুম থেকে জঙ্গি সংগঠনের অনেকগুলো জিহাদি বই পায়। ফলে পুলিশের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রঞ্জু জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। আর বাবাও জানেন যে, তাঁর ছেলে সন্ত্রাসবাদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। পুলিশ প্রথমে রঞ্জুর বাবাকে তাদের সাথে থানায় যেতে বলে। কিন্তু পরে বাবাকে থানায় না নিয়ে পুলিশ বলে যে, যদি আপনি একজন আদর্শবান পিতা হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই রঞ্জু আসার সাথে সাথে থানায় খবর দিবেন। ছেলে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত এটা মানতে চায় না বাবার মন, সংশয়ে দোলা দেয়। কত ভালো ছেলে, পড়ালেখায়ও কত ভালো। কত স্বপ্ন দেখি আদরের ছেলেকে নিয়ে। এসব প্রশ্নে দোলা দেয় বাবার মন। তাই জঙ্গি ছেলেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চায় বাবা। তারপর রঞ্জুর বাবা রঞ্জুর কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে পারে যে, রঞ্জু সাত-আট মাস যাবত কলেজে অনিয়মিত। ভালো রেজাল্ট ছিলো; কিন্তু লাস্ট পরীক্ষাটা দেয়নি। এসবের কিছুই জানতেন না রঞ্জুর বাবা-মা। তারপর কলেজের শিক্ষক রাকিব হাসানের মাধ্যমে রঞ্জুর বাবা ঢাকায় জোবায়ের নামের এক সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করে তাকে সব কিছু খুলে বলে। বাবার ধারণা, যদি তিনি তাঁর ছেলের সাথে একটু কথা বলতে পারেন, ছেলেকে বুঝাতে পারেন তাহলে অবশ্যই রঞ্জু সন্ত্রাসের পথ থেকে ফিরে আসবে। তাই রঞ্জুর বাবা সাংবাদিককে অনুরোধ করেন তাঁর ছেলের সাথে একটু দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে। এরই মধ্যে বাবা আতাউল করিম জানতে পারেন যে, তাঁর ছেলে রঞ্জু জেআরবি (JRB) নামক একটি জঙ্গি সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য। তাছাড়া জুন মাসে ঢাকায় বোমাবজির সাথে জড়িত। তারপর সাংবাদিক জোবায়েরের হাত ধরে একই পত্রিকার জঙ্গি বিটের সাংবাদিক আসিফের সাথে রঞ্জুর বাবার দেখা হয় এবং কথা হয় এ বিষয়টি নিয়ে। তারপর বাবা ফিরে যান গ্রামে। যাবার আগে সাংবাদিক জোবায়েরের কাছ থেকে ফোন নাস্বার নিয়ে বলে যান। আর বলে যান বাড়িতে গিয়েই একটা ফোন কিনেই ফোন করবেন।

আর এদিকে দাদী তার নাতির মৃত্যুর কথা ভুলে বসে আছেন। নাতিকে দেখার জন্য পথ পাণে বসে আছেন। কবে তার নাতি আসবে। অপেক্ষার প্রহর যে শেষ হতে চায় না। অবুঝ দাদী একে ওকে ডেকে বলেন, ‘‘নাতি যে তাঁকে একেবারে ভুলে বসে আছে। তোমরা তো শহরে থাকো। একবার আমার নাতির সাথে দেখা আমার কথা বলো।’’- ইত্যাদি নানা ধরণের কথা।

সেই সাথে পুরোদমে গোপনে গোপনে চলতে থাকে জঙ্গিতৎপরতা, প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি ও কার্যক্রম। সাংবাদিক জোবায়েরের ফোন পেয়ে রঞ্জুর বাবা আবারও ঢাকায় আসেন ছেলের সাথে দেখা করার প্রত্যাশায়। অন্যদিকে গোপন একটি আস্তানায় রঞ্জু একটি ফ্লাক্সে বোমার সার্কিট বসাচ্ছে। রঞ্জুর বাবা সাংবাদিকের কাছ থেকে জানতে পারেন রঞ্জুর সাথে দেখা করাটা একেবারেই অসম্ভব। সাংবাদিক বলেন, রঞ্জু একজন সক্রিয় জঙ্গি সদস্য, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলায় সে সরাসরি জড়িত, ওর তৃতীয় বোমাহামলার অভিযান ছিলো ঢাকায়। তিনি আরও জানান, ওরা বলেছে একটা চিঠি আমরা রঞ্জুর কাছে পৌঁছে দিতে পারি। বাবার মনে সায় দেয়, মায়ের অসুখের কথা শুনলে নিশ্চয় আসবে। তারপর বাবা রঞ্জুর কাছে একটা চিঠি লিখে দেন।

অতঃপর হঠাৎ করেই আচমকা আরেকটি বোমা বিস্ফোরণ। আবারও মিডিয়া, প্রেস-ছাপাখানা, টিভি পর্দায় জঙ্গি হামলার সংবাদ। গাজীপুরের আদালত পাড়ায় বোমা হামলায় নিহত ৩ ও আহত ২৫। আর রঞ্জুর বাবা পত্রিকায় সেই সংবাদ পড়ছেন।

বাবার দেয়া চিঠি রঞ্জু পায়। চিঠি পড়তে পড়তে রঞ্জু ফিরে যায় তার ছেলেবেলায়। ছোট্টবেলায় বাবার সাথে সেই লুকোচুরি খেলার দৃশ্য। বাবা সেই ছোট্ট রঞ্জুকে খোঁজে পায় না, বলে ওঠে রঞ্জু কোথায়। দুষ্টু, ছোট্ট রঞ্জু লুকিয়ে থাকে আর বলে, ‘‘বাবা আমি এখানে, আমাকে খুঁজে বের করো।’’ এদিকে বড় রঞ্জু বাবাকে জোরে জোরে বলে, বাবা আমি এখানে। কিন্তু বাবা এখনকার বড় রঞ্জুকে আর দেখে না, ডাকও শুনে না। অথচ অবস্থানটা সামনা সামনি। অবশেষে দেখা বাবা সেই ছোট্ট রঞ্জুকে গ্রহণ করে। ছোট্ট রঞ্জুকে কাঁধে করে চলে যায় বাড়িতে। এমনি একটি অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিমূলক দৃশ্যের পরিস্ফুট ঘটেছে এখানে।

কিন্তু বাবার চিঠি পেয়ে কি রঞ্জু আসলেই বাড়ি ফিরে যায়? না, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা এখানে পাইনি আর কখনো পাবো কিনা তাও আমরা জানি না। কারণ সব প্রশ্নের উত্তর হয়না, জানা যায় না।

এদিকে বৃদ্ধা দাদীর বয়স ফুরিয়ে যায়, আয়ু কমে আসে। কিন্তু তাঁর নাতির জন্য অপেক্ষার প্রহর আর ফুরায় না। বাস-স্ট্যান্ডে এসে বাস থেমে যায়, সবাই বাস থেকে নেমে আসে, কিন্তু রবিউল আর আসে না। অযথাই বৃথা আশায়, শূন্য মস্তিষ্কে ফিরে যায় দাদী।

শেষ পর্যন্ত রঞ্জুর কোনো খোঁজ নেই। জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে সে পেল একটা পদোন্নতি, বিশেষ এলাকার কমান্ডারের দায়িত্ব। রঞ্জু বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবলি কল্পনা করে তার ছেলেবেলার কথা। সে যেন ফিরে যেতে চায় তার নেই ছেলেবেলায়। অন্যদিকে রঞ্জুর বাবা-মার চোখে ঘুম নেই। থেমে থেমে কেবলি কান্না আর কান্না। এ কান্নার কি আর শেষ নেই?

অন্যদিকে এক বৃদ্ধা অসহায় দাদীর অপেক্ষা, নিষ্প্রভ বেদনার জীর্ণতা। নদী তীরে বিষন্ন মনে, আনমনা হতাশায় আছন্ন এক ভাবনার জগত। কিন্তু কবে শেষ হবে এসব কিছুর। এর কি শেষ নেই?

কাহিনীর পর এবার সার্বিক বিশ্লেষণের দিকে আসা যাক। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে বিষয়টি আসে সেটি হলো ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্ম আর ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতির জায়গাটিতে। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ স্যারও উপরোক্ত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শ ও নীতিগত দিক থেকে একটা দ্বন্দ্ব সবসময়ই কাজ করেছে, যা আজও কাজ করছে। এই ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শের ক্ষেত্রটি ত্রিমাত্রিক- প্রথমত, সুফিবাদী ইসলাম; দ্বিতীয়ত, শাস্ত্রীয় ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলাম। এ তিনটির মধ্যে আদর্শিক ও নীতিগত দিক থেকে যেমন দ্বন্দ্ব কাজ করে, তেমনি কাজ করে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে বৃহৎ দ্বন্দ্ব।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় অর্ধশত কোটিরও বেশি মুসলমানের আবাস। এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন সুফি সাধকরা। তখনকার দিনে এই সুফিবাদের বেশ জয়-জয়কার ছিলো। তবে এখন যে নেই তা বলা যায় না। এখনও অনেক এলাকায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর সমর্থন রয়েছে। এই সুফিবাদের একটি আদর্শগত দিক হলো এখানে আল্লাহ ও তার বান্দার সম্পর্ককে ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানো হয় বা প্রচার করা হয়। এই সুফিবাদের একটি শক্তিশালী জায়গা হলো এখানে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্তিক যোগাযোগের চর্চা করা হয়। সুফিবাদে বলা হয়, সৃষ্টা ও বান্দা একাকার হয়ে যায়। সুফিবাদের ইসলামী নামকরণ হিসেবে মারফতের কথা বলা যায়। পীর-ফকির-মুরীদ, মুর্শিদ ও মাজারকেন্দ্রিকভাবে এর প্রচারণা। বাউলদের মধ্যে আমরা সুফিবাদের প্রভাব দেখতে পাই। যেমন- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লালন দর্শন।

দ্বিতীয়টি হলো শাস্ত্রীয় ইসলাম বা শরিয়ত। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত হবে- এটিই এই মতের আদর্শিক মূলধারা। এই ধারাটির সাথে সুফিবাদের বৃহৎ একটা দ্বন্দ্ব আছে।

আর তৃতীয়টি হলো রাজনৈতিক ইসলাম। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বলা যায় মুসলমানদের উপর ব্রিটিশদের উৎপীড়ন ও হিন্দুপ্রীতির ফল হিসেবে গড়ে ওঠে মুসলিম লীগ। সেই থেকে এ উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক যাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলাম বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফল হিসেবে জামাত-ই-ইসলামীসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল আমরা দেখতে পাই।

রাজনৈতিক ইসলাম বলি আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই বলি এটা সুফিবাদকে অনুমোদন দেয় না। অন্যদিকে শরীয়ত বা শাস্ত্রীয় ইসলামও সুফিবাদকে গ্রহণ করে না বা মেনে নেয় না।

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী আক্রমণ যা বহুলভাবে ৯/১১ বলে পরিচিত। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে এই প্রেক্ষাপটের একটা ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এই আক্রমণের রেশ টেনে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পশ্চিমারা প্রথমে আফগানিস্তান পরে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে। তালেবানদের আশ্রয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে কেনিয়া ও তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে হামলার অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এ হামলা চালায়। কিন্তু এর পেছনে এদের একটা বৃহৎ স্বার্থ কাজ করেছে- মধ্য এশিয়ার মুসলিম বিশ্বের খনিজ সম্পদ তথা তেল সম্পদের উপর তাদের আধিপত্য কায়েম করা। এ প্রসঙ্গে একটি কনফারেন্সে দেয়া হেলিবার্টন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ডিক চেনির বক্তব্য উলেখযোগ্য- ‘ঈশ্বর এমন সব স্থানে তেল-গ্যাসের ভা-ার দিয়েছেন যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন নেই, এবং এরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয়। কখনও এমন জায়গায় আমাদের যেতে হয় সেখানে সাধারণত কেউ যেতে চাইবে না। কিন্তু আমরা ব্যবসার খাতিরে সব জায়গায় যাই।’ (Jon Flanders; Gas, oil and Afganistan, http://members.localnet.com)

আর এরই প্রেক্ষিতে ‘বুশ-সাম্রাজ্যবাদ’ এর বিরোধীতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ‘আলাহর আইন’ কার্যকর করার জন্য পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে, ইহুদী-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। জিহাদের অংশ হিসেবে চলে সন্ত্রাসবাদ, বোমাহামলা, নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। আর এরাই সমাজে জঙ্গি বলে স্বীকৃতি পায়। এভাবে জন্ম নেয় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও হিজবুত তাহরীর মতো নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো। বাংলাদেশে ইসলামি দলগুলোর অনেকেই এসব জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক। দৈনিক প্রথম আলোর ২১ আগস্ট ২০০৮-এ এবিষয়ে একটি প্রতিবেদনে ছাপা হয়। যাতে খেলাফতে মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোটের বিভিন্ন নেতার জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলা হয়।
‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রে চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। ছবিতে মাদ্রাসার হুজুরের কথার মাধ্যমে সে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। দেখা যায় বারবার হুজুরের কথায় কথায় উঠে এসেছে ইসলামের কথা, নিজেদের বানানো ভ্রান্ত ইসলামী নীতির কথা, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ ছাড়াও পশ্চিমা শয়তানদের বেলালাপনার কথা, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা। তাছাড়া হুজুরদের কথায় ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’, ‘মাশাআল্লাহ’, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’, ‘নাউযুবিল্লাহ’- ইত্যাদি নানা ধরণের ইসলামী শব্দের ব্যবহার দেখা গেছে।

প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে রবিউল, গান করে। স্বপ্ন দেখে জীবনে একজন বড়মাপের শিল্পী হবে। ‘অপেক্ষা’ ছবির শুরুর খানিক পর রবিউলকে দেখা গেল একটি বাউল গানের আসরে গান করতে। আর সেই আসরে ঘটলো বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। বোমার আঘাতে মারা গেলেন রবিউলসহ আরও ছয় জন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান হিসেবে আমরা জঙ্গিবাদকে দেখতে পাই। ধর্মের এই রাজনৈতিক ধারাটি সুফিবাদ, পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক ও বাউল সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয় না। আর এ কারণেই আমরা ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রে বাউল গানের আসরে বোমাহামলার ঘটনা দেখতে পাই।

ধর্মভিত্তিক বা ইসলামী জঙ্গিবাদের মূল কথা হলো জিহাদের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আর এ মূলমন্ত্র, মতবাদ প্রচারের জন্য, জিহাদী প্রচারণার অংশ হিসেবে পন্থা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে বিভিন্ন ধরণের জিহাদী বই, পোস্টার, লিফলেট তৈরি ও বিতরণ। আর এসব জিহাদি-মুদ্রণ মাধ্যমের সাহায্যে মানুষকে জিহাদের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। তেমনি ‘অপেক্ষা’য় আমরা দেখতে পাই পুলিশ যখন জঙ্গি সন্দেহে রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করতে তার বাড়িতে আসে, তখন রঞ্জুকে না পেয়ে তার রুম সার্চ করে অনেকগুলো জিহাদি বই পায়-‘জিহাদ শিক্ষা’ ও ‘জিহাদের ইসলামী নীতি’।

‘জিহাদ করবেন, বোমাবাজি কইরা নিরীহ মানুষ হত্যা করবেন। তারপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করবেন।’ এটা রঞ্জুকে ধরতে আসা এক পুলিশের বক্তব্য। আর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পরিচালক দক্ষতার সাথে জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও দর্শনের স্বরূপটি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তাছাড়া এর মধ্য দিয়ে সরকারের সাথে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরোধী অবস্থানের বিষয়টা উঠে এসেছে সাবলীলভাবে।

জঙ্গি সংগঠনগুলোর যাবতীয় কার্যক্রম, তৎপরতা চলে গোপনে। এদের কার্যক্রমের একটা অংশ হলো মজলিশ বসা। এই মজলিশে বিভিন্ন ধরণের আলাপ-আলোচনা হয়। এখানে কিভাবে কর্মপদ্ধতি, কার্যক্রম, প্রচার-প্রচারণা হবে ইত্যাদি বিষয়সহ জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। ‘অপেক্ষা’ ছবিতে এরকমই একটি চিত্র উঠে এসেছে যেখানে আলোচনায় মাদ্রার বড় হুজুর ও অন্য আরেক হুজুর কথা বলছিলেন। এখানে মাদ্রাসার অন্যান্য আরও হুজুর উপস্থিত ছিলেন। তারা বলছিলেন, ‘তবে মনে রাখিও সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দল ও দেশের টার্গেট ইসলাম। নালায়েকরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে....মুমিন-মুসলমানরা জিহাদের পতাকাতলে এসেছে। জিহাদ করে শহীদ হওয়া তো সৌভাগ্যের বিষয়।’ এসব চরিত্র-চিত্রণ ও দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।

বাবা আতাউল করিম জঙ্গি ছেলে রঞ্জুকে ফিরে পেতে চায়। ফিরিয়ে আনতে চান ভুল পথ থেকে। সহজ সরল ধর্মপ্রাণ বাবাও বুঝেন জঙ্গিবাদ একটা ভুল পথ। বাবার কথায়, ‘ওরা কি বুঝে না যে এতে ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে।’ বাবা তাই অনেক চেষ্টার পর রঞ্জুকে শেষ পর্যন্ত একটা চিঠি পাঠায় সাংবাদিকের সাহায্যে। কিন্তু তাতেও রঞ্জু ফিরে না। কারণ সে এখন একজন জঙ্গি সদস্য। আর জঙ্গি সদস্যদের থাকতে হয় আতœগোপনে। এদের কার্যক্রম হয় গোপনে গোপনে। আর এদিকটাই ফুটে উঠেছে যখন রঞ্জুকে দেখা যায় একটি বাসায় গোপনে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নাম করে দরজা লাগিয়ে বোমা তৈরি করছে। গত ২ ফেব্রয়ারি ২০০৯ একটি জাতীয় সংবাদপ্রত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, জেএমবির জঙ্গিরা কৌশল পরিবর্তন করে সারাদেশে ছোট ছোট আকারে পাঁচশ’র বেশি গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় এরা গোপনে, ছদ্মবেশে বাসা, মেস ভাড়া করে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থানে থেকেছেন। আর এই অবস্থানের খোঁজ আমরা পাই রঞ্জুর বাবার উক্তিতে কিংবা পর্দার আড়াল থেকে উঠে আসা কণ্ঠের জবানিতে-‘কুটিল রাজনীতিকের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট জঙ্গিরা ধর্মের নামে এরা ইসলামের শান্তির বাণীকে নষ্ট করছে। ধর্মের নামে পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনি। তাই এরা তা এখনও পারবে না। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে এখানে জঙ্গিবাদের পেছনে যে একটা রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে সেটা বেশ জোড়ালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে ইসলামের শান্তির কথা বলা হয়েছে।

জঙ্গিবাদের যে একটা সাংগঠনিক ভিত্তি আছে সেটা এখানে বেশ ভালোভাবে উঠে এসেছে। সদস্য সংগ্রহ, জঙ্গিদের পদোন্নতি, নির্দিষ্ট একটা এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম, এলাকার কমান্ডার ইত্যাদি বিষয় এদের রয়েছে। আর ‘অপেক্ষা’ ছবিটিতে রঞ্জুর পদোন্নতির রূপটি ধরা পড়েছে। জঙ্গিদের জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়, প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পিস্তলচালনা, অস্ত্রচালনার দৃশ্য সংযোজন করে এটি আরও বেগ পেয়েছে এখানে। তাই এখানে জঙ্গিবাদের সামরিক ব্যাপারটা অনেক স্পষ্ট।

‘অপেক্ষা’ ছবিটিতে যে জঙ্গিবাদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যে জঙ্গিবাদ মূলত পশ্চিমাবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী। বড় হুজুরের বক্তব্যে মধ্য দিয়ে এটি বেশ শক্তভাবে উঠে এসেছে। এই জঙ্গিবাদ ভিন্ন কায়দায়, ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে মানুষ হত্যা করে, বোমাবাজি করে, সন্ত্রাসী কর্মকা- চালায়। আর এই জঙ্গিবাদের যে একটা বৈশ্বিক রূপ আছে, সেটাও এখানে বেশ স্পষ্ট। ছবির এক পর্যায়ে দেখা যায়, পাকিস্তান থেকে সামদানি নামের এক লোক এসেছে বিদেশী সাহায্য নিয়ে। দশ ডলারের আর্থিক সাহায্য ছাড়াও এসেছে দুই হাজার রাউন্ডের পিস্তল, গুলিসহ নানা ধরণের অস্ত্র ও রসদ-সরঞ্জাম। এর ফলে এটিই বুঝা যায় যে, জঙ্গিবাদের পেছনে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন শক্তি কাজ করেছে; এর রয়েছে শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক। তাছাড়া সাংবাদিক জোবাায়েরের কথায়ও জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক রূপটি এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রের জঙ্গিবাদ পুঁজি করে প্রযুক্তিকে, নিত্য নতুন কৌশলকে। পুঁজি করে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাগামী তরুণ, মেধাক্ষী ছাত্রের মাথাকে। এখানে মেধাবী ছাত্র রঞ্জুকে দেখা যায় একজন জঙ্গি হিসেবে, একজন বোমা তৈরির কারিগর হিসেবে। রঞ্জু একটি ফ্লাক্সে বোমা ফিট করে। আর সেই বোমা দিয়ে গাজীপুরের আদালত পাড়ায় দশ বছরের এক ছেলেকে চা বিক্রেতা সাজিয়ে ফ্লাক্সে ফিট করা টাইম বোমা বিস্ফোরণ করানো হয়। এটি ছিলো আতœঘাতী বোমা বিস্ফোরণ। এতে ৩ জন মারা যায় ও ২৫ জন আহত হয়। তাছাড়া এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ভেতরে বিরুদ্ধ সঠিক মতের আসাদুজ্জামানের মতো লোক রয়েছে যে মাদ্রাসা ত্যাগ করতে চায়। আর এ দলত্যাগের শাস্তি হিসেবে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নিজেই আসাদুজ্জামানকে মেরে ফেলে। এমনি বর্বর জঙ্গিবাদ!! এভাবে মাদ্রাসাভিত্তিক জঙ্গিবাদ দেখা যায়।

‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রে মিডিয়াকে বিশেষ করে প্রেস বা মুদ্রণ মাধ্যমকে ফোকাস করা হয়েছে। সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে যে একটা আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে সেটি এখানে বেশ ভালোভাবেই ধরা পড়েছে।

এই ছবিটির সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো চরিত্র-চিত্রায়ণ, দৃশ্যায়ন ও কাহিনীর নির্মাণ। দাদীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিরানা জামান, রঞ্জুর বাবার চরিত্রে করেছেন পীযুষ বন্দোপাধ্যায়। তাছাড়া রঞ্জুর চরিত্রের অভিনেতাকে আগে কখনো দেখা যায়নি। এমন একজনকে দিয়ে এ চরিত্রটি বেশ সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ। সাংবাদিকের চরিত্রটিও এক অনন্য মাত্রার যোজনা।

দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রেও ছবিটি প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশ থেকে শুরু করে দাদীর ডিম সংগ্রহ আর নাতির জন্য অপেক্ষার স্পর্শকাতর চিত্রায়ণ পর্যন্ত সর্বত্রই নামকরণের সার্থকতাকেই মনে করিয়ে দেয়। তাছাড়া ছোট্টবেলার রঞ্জু আর বড় রঞ্জু যে এক নয়, সেটা বেশ দক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা সবচেয়ে স্পর্শকাতর। বাবা ছোট্ট রঞ্জুকে গ্রহণ করেন, কোলে করে বাড়ি চলে যান। আর জঙ্গি রঞ্জুর ডাক বাবা শুনতে পান না। অথচ অবস্থানটা সামনা-সামনি। যেন ছোট্টবেলার রঞ্জুকেই বাবা ফিরে পেতে চান। কি অপূর্ব আর অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিমূলক দৃশ্যায়ন! তাছাড়া রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা আবার ঐক্যের প্রবাহ চিত্র। এছাড়াও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এটি বেশ উজ্জ্বল। ছবিটিতে সঙ্গীতে আছেন ফোয়াদ নাসের।

তারপর একটি বিষয় চোখে পড়েছে; সেটি হলো রঞ্জু কিভাবে জঙ্গিবাদের পথে গেল সেটি উপেক্ষিত হয়েছে এখানে। তাছাড়া ছবিটি অমীমাংসীতভাবে শেষ করা হয়েছে যেখানে রঞ্জু আর ফিরে না বা চাইলেও ফিরে আসতে পারে না। সে কেবলি ভাবে ছোটবেলার কথা, বাবার সাথে লুকোচুরি খেলার কথা। অন্যদিকে বাবা-মার চোখে ঘুম নেই, আছে শুধু জল। আর এদিকে নদী তীরে দাদীর অপেক্ষা।

২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান। জেএমবি, বাংলা ভাইয়ের একে একে সিরিজ বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ, রমনার বটমূলে বোমাবাজি- সবই জঙ্গি হামলার নজির। ইসলামের নামে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফায়দা লুটতে এ সমস্ত বোমাবাজি করে মানুষ হত্যার রাজনীতি মোটেও কাম্য নয়। আর এরই প্রেক্ষিতে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অপেক্ষা’-এক্ষেত্রে বেশ সফলভাবে এই ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদের সমকালীন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে, যাকে চলচ্চিত্র অঙ্গণে একটি ভিন্ন মাত্রার সংযোজন বলা যায়।


আহমেদ সাঈদ
২৫ জানুয়ারি ২০১১


৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×