রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সত্যিকারের কবি এবং সুগায়ক।তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়,তিনি মূলত একজন রোমান্টিক রসের কবি হলেও ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে গভীর জীবনবোধ।কবিতা তো রোমান্টিক হবেই।শুধু আর্দশের কথা,শুধু উচ্চ ভাব ও নীতি কথায় ভারাক্রান্ত হলে তা হয়ে যায় নিছক নিরস অ-কবিতা।"বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে/শূন্য ঘাটে একা আমি/পার করে লও খেয়ার নেয়ে/এসো এসো শ্রান্তি হরা/এসো শান্তি সুপ্তি ভরা/এসো এসো তুমি এসো/এসো তোমার তরী চেয়ে।"।রবীন্দ্রনাথ একদিন জোছনাময় রাত্রে বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে চেয়ে ছিলেন আকাশের দিকে।নদীর ছলোচ্ছল শব্দ বাজতে থাকে সঙ্গীতের মতন।রবীন্দ্রনাথ তখন ভাবছিলেন,আমি কে?কী আমার পরিচয়?কারুর চোখে আমি ধনীর নন্দন,সংসারী,পাঁচটি পুত্র কন্যার জনক।কেউ ভাবে,আমি এক বিশিষ্ট জমিদার।কারুর কাছে আমি সম্পাদক,লেখক,গায়ক,কবি।একই মানুষের অনেক পরিচয় থাকতে পারে,কিন্তু যখন আমি সম্পূর্ন একা,তখন আমি শুধুই কবি।একজন কবির প্রকৃত পরিচয় কি কোনও মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব?রবীন্দ্রনাথ চেনাশোনা মহলে হাসি ঠাট্রা করতেন কিন্তু বাড়ির বাইরের সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পারতেন না।বাইরের মানুষদের সাথে কথা বলতেন মেপে মেপে,এত বেশি ভদ্রতা দেখাতেন যে তা কৃত্রিমতার পর্যায়ে চলে যেত।
বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব যখন ওঠে,তখন রবীন্দ্রনাথ বিশেষ সাড়া দেননি।তিনি হয়তো ভেবেছিলেন,ওটা একটা চমক দেবার চেষ্টা। ইংরেজ কি এতটা জবরদস্তি করতে পারে!চর্তুদিকে যখন প্রতিবাদ সভা,মিছিল শুরু হয়ে গেল,তার কোনটিতেই যোগ দেননি রবীন্দ্রনাথ।এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কলমও ধরেননি।তার এই অমনোযোগ অনেককে বিস্মিত করেছিল,কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।বছরের গোড়ার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ।সাতাশি বছর বয়েস হলেও দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু শুধু তিনটি ব্রাহ্মসমাজেই নয়,সারা বাংলাতেই মহাগুরু নিপাতের মতন।দেবেন্দ্রনাথ তার শেষ উইলে এক্সিকিউটর হিসেবে অন্য জীবিত পুত্রদের বাদ দিয়ে শুধু রবীন্দ্রনাথকেই নিযুক্ত করেছেন।সাথে দু'জন নাতি দ্বিপেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ।কনিষ্ঠ পুত্র ছাড়া অন্য পুত্রদের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি দেবেন্দ্রনাথ।এজন্য সম্পত্তির হিসেব নিকেশ,জোড়াসাঁকোর অত বড় বাড়ির ব্যবস্থাপনা,এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মাথা ঘামাতে হয়েছে।ত্রিপুরার রাজপরিবারের একটা সঙ্কট ঘনিয়ে এসেছিল,তা থেকেও বিযুক্ত থাকতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ।মহারাজ রাধাকিশোরও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শের ওপর নির্ভর করতেন।
বঙ্গভঙ্গ সত্যি সত্যি কার্যকর হতে যাচ্ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ হঠাত যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন।বাংলা সত্যি খন্ড বিখন্ড হবে,একি সত্যি সম্ভব!বাঙালিও তা মেনে নেবে!বাঙালির মধ্যে যে একটা জাতীয়তাবোধ জেগে উঠেছে দেটা ভেঙ্গে দেওয়াই ইংরেজদের উদ্দেশ্য শাসনকার্যের সুবিধের জন্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতন এত বড় রাজ্যকে ভাগ করতে হলে বিহার ও ওড়িশাকে পৃথক করে দেবার যুক্তি বোঝা যায়।কিন্তু বাংলা ভাষাভাষি জেলাগুলিকে কেন জুড়ে দেওয়া হলো আসামের সাথে?(স্যার হেনরি কটন ইংরেজ সরকারের দক্ষ প্রশাসক ছিলেন,তিনিও বলেছেন,এই বঙ্গভঙ্গ অন্যায়।)এযেন বাঙালির ঐক্যের কুঠারাঘাত।বাংলা ভাষা প্রসারের বিরুদ্ধতা।রবীন্দ্রনাথের মনে প্রবল প্রতিবাদ গুমরে ওঠে।সেই প্রতিবাদ প্রথম ধ্বনিত হলো গানে।এর আগে তিনি রচনা করেছিলেন- 'তবু পারি না সঁপিতে প্রান' কিংবা 'ভয় হতে তব অভয় মাঝে'র মতন গান।
শান্তিনিকেতনে এক নির্জন রাতে তার বুক থেকে উৎসারিত হলো অন্য রকম গানের কলি- "আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি''।(শিলাইদহের গগন হরকরা নামের ডাকপিওনটি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথকে গান শোনাতেন।তার একটি গান 'আমি কোথায় পাবো তারে,আমার মনের মানুষ যে রে, এর সুরটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয়েছিল।)সেই সুর লাগিয়ে দিলেন সোনার বাংলা গানটিতে।দু'একজনকে শোনাবার পরই গানটি মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল।রবীন্দ্রনাথের আর কোনও গান এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়নি,মিছিলে মিছিলে শোনা যেত এই গান।এরপর গিরিডিতে গিয়ে রচনা করতে লাগলেন একটার পর একটা দেশাত্মবোধক গান- 'ও আমার দেশের মাটি,তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা',এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী',যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক,আমি তোমায় ছাড়ব না মা','যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে',সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে',আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি','তুমি এই অপরুপ রুপে বাহির হলে জননী','ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি!এ রকম আরও অনেক গান।
প্রতিবাদ আন্দোলন বা বিপ্লবের সময় যে যার নিজস্ব অস্ত্র হাতে তুলে নেয়,কবির অস্ত্র তার কবিতা।কলমের বদলে অপটু হাতে বন্ধুক মানায় না।তবু কবিকে কখনও কখনও রণক্ষেত্রে যেতে হয়েছিল,যেতে হয়েছিল সভা-সমিতিতে,মিছিলে।সরকার থেকে ঘোষনা করা হয়েছিল ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন অনুযায়ী বলবৎ হবে।