somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুখবন্ধ ঃ
‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকছে না’
‘গণতন্ত্রের নবযাত্রা’
‘বাহাত্তরের সংবিধান ফিরে এলো’

পত্রিকার এরকম শিরোনাম সম্প্রতি আমাদের চোখে প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে। মূলত এ সংবাদগুলোর মূল বিষয় ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী’। সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও তা বাতিল নিয়ে আমাদের সমাজে তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। কেউ একে বলছে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’, কেউ বা বলছে জাতির কলঙ্কমোচন ঘটলো পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে।


। সংবিধানকে অনেকে শাসনতন্ত্র বলেও সংজ্ঞায়িত করেন। গণতান্ত্রিক সরকার বা রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো সংবিধান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটাল বলেন,
“রাষ্ট্র নিজের জন্য যে জীবন ধারা বেছে নেয় তাই হলো সংবিধান।”
ম্যাকবেইনের ভাষায়,
“যেসব মৌলিক আইন ও রীতিনীতি অনুসারে সরকার বাস্তবে কাজ করে তাই সংবিধান।”
অধ্যাপক হরম্যান ফাইনারের মতে,
“মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষম ব্যবস্থাই সংবিধান।”
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর প্রেক্ষিতে সংবিধান বলতে আমরা রাষ্ট্রের মৌলিক বিধিমালা ও রীতিনীতিকে বুঝি যা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতাবণ্টন করে, ক্ষমতা চর্চার পদ্ধতি নির্দেশ করে এবং জনগণের উপর সরকারের কর্তৃত্ব নির্ধারণ করে। অর্থাৎ সরকারের মৌলিক বিষয়াদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানই সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত। সংবিধানের উদ্দেশ্য হলো, সরকারের ক্ষমতার উপর কার্যকর বাধা নিষেধ আরোপ করা ও নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
গণতন্ত্রে সংবিধান সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সত্য হলো ঃ
ক্স সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন
ক্স সংবিধান যেহেতু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন তাই। এর মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল জনগণের।

বাংলাদেশের সংবিধান ঃ

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমের বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই সময় ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তবে স্বাধীন বালাদেশে ১৯৭২ সালে ‘অস্থায়ী’ সংবিধান আদেশ, ১৯৭২- এ জারি করা হয়। এর ভিত্তিতে তৈরি হয় গণপরিষদ। গণপরিষদ ৩৪ জন সদস্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল একটি খসড়া সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করে। তখনকার আইনমন্ত্রী ড: কামাল হোসেনকে এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এই কমিটি একাধিক বৈঠকে আলোচনা করার পর ১০ জুন একটি প্রাথমিক খসড়া সংবিধান অনুমোদন করে। পরে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ড: কামাল হোসেন সেই খসড়া সংবিধানকে বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন। তখন থেকেই গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের উপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। ঐ সময়ে বিলটিতে মোট ১৬৩টি সংশোধনীর প্রস্তাব আনা হয় যার মাধ্যমে ৮৪টি সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে সংবিধানের খসড়া বিলের উপর তৃতীয় ও সর্বশেষ আলোচনা হয়। এরপর ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের সদস্যগণ হাতে লিখিত সংবিধানের মূল অনুলিপিতে স্বাক্ষর করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর করা হয়। এই সংবিধানকে আমরা বাহাত্তরের সংবিধান বলি। পরে বিভিন্ন সরকার এই সংবিধানের ১৪টি সংশোধনী আনে।
সংবিধান সংশোধন ঃ

সংবিধানের কোন অংশের পরিবর্তন করাকে সংবিধান সংশোধন বলা হয়। সংবিধানের সংশোধনের ক্ষমতা শুধুমাত্র সংসদের আছে। আমাদের সংবিধানের ১৪২নং অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদকে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও সংবিধানের বৈশিষ্ট্য স্থায়ী, কিন্তু ভবিষ্যতের উন্নতি ও জনকল্যাণের স্বার্থে স্থায়ী, কিন্তু ভবিষ্যতের উন্নতি ও জনকল্যাণের স্বার্থে তা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে সংশোধনের নামে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর কোন পরিবর্তন করা যাবে না।

পঞ্চম সংশোধনী কী?
১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের সংবিধানে যে সংশোধনী আনা হয় তাই পঞ্চম সংশোধনী। এই সংশোধনীকে “সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯”- নামে অভিহিত হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসন আমলের সকল কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়া হয়।


পঞ্চম সংশোধনী আনার কারণ ঃ
সংবিধানের কোন বিধান সংশোধনের জন্য ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়নি, বরং এই সংশোধন আইনের বলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের মধ্যে (উভয় দিনসহ) প্রণীত সকল আদেশ, সামরিক আইন, প্রবিধান, সামরিক আইন বিধান, ঘোষণা এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন আদেশ ধারা সংবিধানে যেসব সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হয়েছে তা বৈধ বলে অনুমোদন করা হয়। তাছাড়া সামরিক শাসনামলে গৃহীত সকল শাসন বিভাগীয় কার্যব্যবস্থা এবং আদালত ও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ ও দণ্ডাদেশকেও বৈধ বলে অনুমোদন করা হয়। অর্থাৎ সামরিক সরকারের সকল কার্যবলীকে বৈধ করার জন্যই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়েছিল।

পঞ্চম সংশোধনী প্রণয়নের প্রক্রিয়া ঃ
১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশের সংবিধানের ৭২ (১) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের আহ্বান করেন। সংসদ অধিবেশনে সংসদ নেতা শাহ্ আজিজুর রহমান ‘পঞ্চম সংশোধন আইন, ১৯৭৯’ বিলটি উত্থাপন করেন। এই বিলটি নিয়ে জাতীয় সংসদের তৃতীয় দিনের অধিবেশনে তুমূল বিতর্ক, সুদীর্ঘ আলোচনা, সমালোচনা হয়; এমনকি বিরোধী দলের কিছু সংসদ সদস্য সংসদ কক্ষ ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনবার ডিভিশান ভোটে বিলটি যথাক্রমে ২৪৩-৪৫, ২৩৪-৩৬ ও ২৪১-০ ভোটে গৃহীত হয়। তবে বিলটির বিরোধিতা করে ২০ জন সংসদ সদস্য ভোট দানে বিরত ছিলেন।



সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন,
১৯৭৯ সালের ১নং আইন (৬ এপ্রিল, ১৯৭৯)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত আইন।
যেহেতু নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য- পুরাকল্পে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধন সমীচীন ও প্রয়োজনীয়,
সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হলো :
১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম- এই আইনকে সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ নামে অভিহিত হইবে।
২। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের সংশোধন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে, ১৭ অনুচ্ছেদের পর নিম্নবর্ণিত নূতন ১৮ অনুচ্ছেদ সংযোজিত হইবে :
“১৮। ফরমানসমূহ, ইত্যাদির অনুমোদন ও সমর্থন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, এবং অনুরূপ কোন ফরমান, সামরিক আইন প্রতিষ্ঠান, সামরিক আইন আদেশ দ্বারা বা অন্য কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতা বলে, অথবা অনুরূপ কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রচন্ড কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
পঞ্চম সংশোধনীর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ঃ
পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হবার সময় থেকেই বিরোধী দলগুলো এর বিরোধীতা করে। সর্বপ্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ২০ এপ্রিল, ১৯৭৯ তারিখে ‘দেশে স্বৈর একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করাই ৫ম সংশোধনীর উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা করে এবং দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে সকল প্রগতিশীল শক্তিকে এই হীন প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে এবং অবিলম্বে এই সংশোধনী বাতিলের দাবি জানায়।
এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোতে এর বিরোধীতা করে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি পঞ্চম সংশোধনীর বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে ঘোষণা করে যে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা পরেও সামরিক শাসনের জের স্থায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন পঞ্চম সংশোধনীকে বেসামরিক পেশাকে সামরিক শাসন ও তার কুফলগুলো বাঁচিয়ে রাখার সরকারি অপচেষ্টা বলে ঘোষণা দিয়ে এর বিরোধীতা করে।
জাতীয় লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান এবং মুসলিম লীগ প্রধান খান এ সবুর উভয়ই পঞ্চম সংশোধনীর তীব্র বিরোধীতা করে।
কিন্তু সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর প্রতি বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধ চারণ থাকলেও তারা এটি বাতিলের জন্য কোন একক বা সমন্বিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে সরকার স্বার্থকভাবে শাসন ব্যবস্থায় পঞ্চম সংশোধনীর প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন।

পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ ঃ
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের প্রথম উদ্যোগটি নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জাতির পিতা হত্যা সম্পর্কিত আইনে সংশোধন আনে। কিন্তু তখনও এমন উদ্যোগটি সফলতা পায় নি।
পরে ২০০৫ সালের জন্য আগস্ট মাসে রাজধানীর মুন সিনেমা হলের মালিক মাকসুদুল হকের দায়ের করা একটি রিট আবেদনের রায়ে বিচারপতি এবি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এই রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসকদের জারিকৃত বিভিন্ন ফরমান, আদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়।
হাইকোর্টের এমন রায়ের পর তৎকালীন জোট সরকার রায়টি স্থগিত করার আবেদন করলে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি ঐ দিনই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। এরপর সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকার আপিল অনুমতির আবেদন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরই প্রত্যাহারের আবেদন করা হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় গত ৩ জানুয়ারি সরকারের আবেদনে লিভ টু আপিল প্রত্যাহারের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের উপর যে স্থগিতাদেশ আছে তাও তুলে নেয়া হয়। পরে বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী সুপ্রীম কোর্টের অনুমতি নিয়ে আপিল অনুমতির আবেদন দাখিল করেন। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্র“য়ারী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল অনুমতির আবেদন খারিজ করা হয়। এভাবে গত ২৭ আগস্ট ২০১০ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের মাধ্যমেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়কে বহাল করেছে।

পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত “আপিল বিভাগের রায়” ঃ-

আপিল বিভাগের ১৮৪ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোঃ তোফাজ্জাল ইসলাম। এ রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন অপর পাঁচজন বিচারক; এরা হলেন- বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, বিচারপতি মোঃ আবদুল মতিন, বিচারপতি বিজয় কুমার দাস, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস.কে. সিনহা। আপিল বিভাগের রায় দানকারী বিচারপতি রায়ে সই করেন ২৭ জুলাই ২০১০ তারিখে।
আপিল বিভাগের রায়ে যেসকল বিষয় বলা হয়েছে ঃ
১। ধর্মভিত্তিক দল ঃ
বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মসংক্রান্ত কয়েকটি বিধান ছিলো। পঞ্চম সংশোধনীতে তা বিলোপ করা হয় । এ সূত্র ধরে ১২ নং অনুচ্ছেদটি পুরোপুরি আর ৩৮ নং অনুচ্ছেদের কিছু অংশ বিলুপ্ত হয়। আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে ১২ নং অনুচ্ছেদটি ফিরে এলো ফলে ১২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র দ্বারা কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্ম পালনের কারণে ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হলো। আবার ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদের বিলুপ্ত অংশ ফিরে আসায় সংবিধান অনুসারে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। তবে হাইকোর্টের রায়ের পাশাপাশি আপিল বিভাগের রায়েও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নিয়ে কিছু বলা হয় নি।
২। সামরিক শাসন ঃ
হাইকোর্টের রায়ে যেভাবে সামরিক শাসনকে অনন্তকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা করা হয় তেমনি আপিল বিভাগের রায়েও তাই বলা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোন অবস্থাতেই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল কোন গ্রহণযোগ্যতা বা বৈধতা পাবে না।
৩। প্রস্তাবনা ঃ
সংবিধানের প্রস্তাবনাকে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে ‘ধ্র“বতারা’। কারণ এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। সংসদ এটা বদলাতে পারে না। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এখানে পরিবর্তন আনা হয়। অর্থাৎ ৫ম সংশোধনীর আলোকে মূল সংবিধানের ‘জাতীয় মুক্তি ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ মুছে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে ৭২’এর সংবিধানের প্রস্তাবনাটি ফিরে আসে।
৪। সংবিধানের মূলনীতি ঃ
পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস- ব্যবহার করা হয়, আর ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বলা হয় সমাজতন্ত্র মানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। তবে আপিল বিভাগের রায়ের পর এসকল পরিবর্তন আর থাকছে না।
৫। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ ঃ
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল জাতীয়তাবাদ, তবে পঞ্চম সংশোধনীতে তা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হল। তবে হাইকোর্টেও আপিল বিভাগের রায়ের ৯ নং অনুচ্ছেদ ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। -অবিকল ফিরে আসলেও আপিল বিভাগ জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশী বলে অভিমত দেয়।
৬। পররাষ্ট্র ঃ
মূল সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ পূর্ণ বহাল রেখে পঞ্চম সংশোধনীতে একটি বাক্য যুক্ত করা হয় তা হলো- ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের¡ সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ, ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ এ বাড়তি বাক্যটির বিলোপ ঘটায়।
৭। গণভোট ঃ
বাহাত্তরের সংবিধানে সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান ছিল না। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানের যে কোন অনুচ্ছেদ পরিবর্তন ও সংশোধনের পথ খোলা ছিল। পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয় হয় সংবিধান সংশোধনের জন্যে গণভোটে পাস করতে হবে। ৯২ (ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটা করা হয় যা ’৯১ এর দ্বাদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়। তবে পরেও সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৮, ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হয়, যা আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল করা হয়।
৮। বিচারক নিয়োগ ঃ
মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করার বিধান রয়েছে। চতুর্থ সংশোধনীতে তা বিলুপ্ত হলে পরে বিচারপতি সায়েম একটি সামরিক ফরমান দিয়ে সেই অংশটি ফিরে আনেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান পরে তা রদ করেন। হাইকোর্ট বিচারপতি সায়েমের সামরিক ফরমানটি পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দিলেও আপিল বিভাগ এ বিষয়ে একমত হয় নি।
৯। ক্রান্তিকাল ও অস্থায়ী বিধানবলী ঃ
হাইকোর্টের দেয়া ২৪২ পৃষ্ঠার রায়ে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ১৫০ অনুচ্ছেদ (ক্রান্তিকাল ও অস্থায়ী বিধানবলী)নিয়ে বলা হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে এর মাধ্যমে যোগ হয় চতুর্থ তফসির, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ধারাবাহিকতা, গণ পরিষদের কার্যক্রমকে সুরক্ষাদেয়া হয়। কিন্তু পরে সামরিক শাসকেরা এর অপব্যবহার করে এবং বলে সামরিক আইনে যা কিছু করা হোক না কেন আদালত তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, এর কোন আইনগত ভিত্তি নেই বলে এ ধরনের বাক্য সংযোজন সংসদের এখতিয়ার বহির্ভূত। তবে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয় একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই তফসিলে নতুন ধারার সংযোজন করার হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত যাবতীয় পর্যবেক্ষণ অপ্রয়োজনীয়।
১০। প্রশংসা ও সমালোচনা ঃ
আপিল বিভাগের রায়ে পঞ্চম সংশোধনীর কিছু প্রশংসা ও সমালোচনা করা হয়-
ও) বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে বিধান ছিল তা চতুর্থ সংশোধনীতে বাতিল করা হলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা ফিরিয়ে আনা হয়। একে আপিল বিভাগের রায়ে আইনের শাসনও জনকল্যাণমুখী বলে বলা হয়।
ওও) মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারক অপসারনে সংসদের মাধ্যমে অভিশংসনের বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে তার বদলে অসদাচরন ও অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়। তাই এক্ষেত্রে পঞ্চম সংশোধনীতে আনা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ‘অধিকতর স্বচ্ছ” বলে ঘোষণা করা হয়।
ওওও) বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ১০২ (১) অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার কার্যকারে হাইকোর্টের অধিকার বিলোপ করা হয়। ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে হাইকোর্ট সেই ক্ষমতা ফিরে পায়- যা পঞ্চম সংশোধনীর একটি ইতিবাচক দিক।
ওঠ) চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৭ ৯ক) অনুচ্ছেদে বাকশাল করার বিধানটি যুক্ত হয় যা সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্য ছিল। তাই পঞ্চম সংশোধনীর অধীনে পঁচাত্তরের ৮ নভেম্বর এ সংক্রান্ত ফারমানটি মার্জনাযোগ্য।


১১।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঃ
আপিল বিভাগের রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কারণ এটি ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পূর্ণ অর্জন সম্ভব নয়। এছাড়াও এ দুই অনুচ্ছেদে অবস্থিত আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি বদলি ও শৃঙ্খলার বিধান বর্ণিত আছে।

ফলাফল ঃ
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নাই। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে ৩৫ বছর পরে বাহাত্তরের সংবিধানের চারটি মূলনীতি অবিকল পুনরুজ্জীবিত হতে দেখা যায়। সর্বসম্মতিতে আপিল বিভাগ শুধু সামরিক শাসনকে বেআইনি নয় বরং সব ধরনের সংবিধান বহির্ভূত রোমঞ্চপনাকে ‘গুডবাই’ জানিয়েছে। অর্থাৎ কাগজে কলমে বাংলাদেশের সংবিধানের কলঙ্কিত অংশটুকু মুছে ফেলা হয়েছে।
তবে, সে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের কথা ৭২’ এর সংবিধানে বলা হয়েছিল আপিল বিভাগের রায়ে তার পুন:বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রকে সমর্থন জানানো হলে বাস্তবে আমাদের দেশে এর গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই পরিবর্তিত সংবিধানের এ অংশের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আপিল বিভাগের রায়ের যে অংশটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে তা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে বিষয়টি খুবই স্ববিরোধী কারণ সংবিধানের শুরুতেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাক্যটির পরিবর্তন বা অপসারণ হয় নি। আবার আপিল বিভাগের রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে না। ফলে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিরর্থক হয়ে গেল।

এছাড়াও পঞ্চম সংশোধনীর বেশ কিছু পরিবর্তনকে আপিল বিভাগের রায়ে অনুমোদন দেয়া হয়। তাই বলা যায় আপিল বিভাগের যায় ও সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চম সংশোধনীর আংশিক পরিবর্তন হয়েছে। উপরিউক্ত সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা দেখার জন্য আমি ১০ জন ব্যক্তির উপর তিনটি প্রশ্ন নিয়ে জরিপ চালাই ঃ

ক) পঞ্চম সংশোধনীকে কী আপনি অবৈধ মনে করেন?
(র) হ্যাঁ (রর) না
খ) পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
(র) হ্যাঁ (রর) না
গ) আপনি কি মনে করেন পঞ্চম সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল হয়েছে?
(র) হ্যাঁ (রর) না

এখানে,
প্রথম প্রশ্নের জবাবে ৯ জন ‘হ্যাঁ’ কে উত্তর হিসেবে বেছে নেয়;
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে ৭ জন ব্যক্তি ‘হ্যা’ এবং ‘৩’ জন ‘না’ উত্তর কওে;
তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে ১০ জনই ‘না’ উত্তর করে।
অর্থাৎ, আপিল বিভাগের রায় অবৈধ পঞ্চম সংশোধনীকে সম্পূর্ণ বাতিল করতে পারে নি।

আপিল বিভাগের রায়ের পরবর্তী অবস্থা ঃ
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৫ম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে;
ক্স অবৈধ ক্ষমতা দখল ঠেকানোর জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় ধারা সংযোজন,
ক্স ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, বিসমিল্লাহ উঠে যাবে
ক্স ধর্ম নিরপেক্ষতা ফিরে আসবে
ক্স ৭২’ এর সংবিধানে ফিরে গেছি
-এসব বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ফলে সবকিছু বিচেনায় রেখে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করার জন্য সংসদ উপনেতা সৈয়দ সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিকে কোন চেয়ারম্যান করে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ সদস্য বিশিষ্টক এই বিশেষ কমিটি সংসদে ‘সংবিধান সংশোধন বিল’ উত্থাপন করবে। এই লক্ষ্যে কমিটির সদস্যরা কাজ করছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সংবিধান পুনঃমুদ্রনের কাজ শুরু হয়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে । তারপরও এই কমিটির দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের সংবিধান একটি নতুন রূপ পাবে যেখানে অতীতের কিছু কলঙ্কময় অনুচ্ছেদের ইতি টানা হবে ।


সমালোচনা ঃ
‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য উপকারী’ বলে আখ্যায়িত করে ৭৫’ পরবর্তী সময়ে জারিকৃত কতিপয় সামরিক ফরমানকে বৈধতা দেবার জন্য ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২’ এর মূল সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। যা কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাম্য নয়। তবে এই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর কারণে লুপ্ত ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা- সংবিধানের এসকল ক্ষমতার মৃত্যু ঘটে যা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়। আপত দৃষ্টিতে অবৈধ ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসন আর কিছু কালো আইনকে বৈধতা দেবার জন্য পঞ্চম সংশোধনী আনা হলেও এর কিছু ইতিবাচক দিকও ছিল, তাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করেছেন।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের যে ইস্যু বারে বারে আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে তা মূলত একটা রাজনৈতিক ইস্যু। কারণ এই বাতিলের উদ্যোগ যে মামলাকে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশ করেছে তা আদালতের কাগজপত্রের ভাষায় ‘মুন সিনেমা হল মামলা’। শুধুমাত্র রাজনীতির অঙ্গনে যেন এই মামলাটি বেশি কদর পায় তাই একে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলা হিসেবে বলা হয়। অর্থাৎ একটি মামলা সিভিল বিষয়ক মামলাকে কনস্টিটিউশনাল মামলার ইস্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। তাই বলা যায়, সরাসরি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইনকে অবৈধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে দায়ের কোন রিট মামলার রায়ে সংবিধানের নতুন সংশোধনীগুলো আনা হয় নি। তবে সে মামলার কারণেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ‘পঞ্চম সংশোধনী’ বাতিলের যে রায় দেয়া হয় তা সময়োপযোগী। তবে উচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন সচেতন মহলকেই উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। ফলে আপিল বিভাগের রায়ে ৭২’ এর সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও তার বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটেনি। অর্থাৎ বাঙালি জাতি প্রায় ৩০ বছর পরও বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে পারলো না। তবে পঞ্চম সংশোধনীর যেটুকু অংশ বাতিল করা হয়েছে তার মাধ্যমে জাতি ভবিষ্যতে যে কোন সামরিক সরকার বা অবৈধ ক্ষমতা দখলের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।

উপসংহার ঃ
গণতন্ত্রের জন্য রক্ত ঝরেছে বাঙালির - ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অপরিসীম । স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ আর নির্যাতিত ২ লাখ নারী মুক্তিযোদ্ধার অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি স্বপ্নই ছিল ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ’ ভিত্তিতে একটি আদর্শ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা । স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল বটে , কিন্তু বাঁধ সাজলো ১৯৭৯ সালে প্রণীত পঞ্চম সংশোধনী । প্রণয়নের পর থেকেই দেশ তথা বিশ্বের সচেতন মহল এটি বাতিলের দাবি জানায় , যদিও অনেকে ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন এই সংশোধনীকে সমর্থন জানাচ্ছিল । সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে স্বাধীনতার সেই ঘুনে ধরা স্বপ্ন গণতন্ত্রমনা ব্যক্তির মনে আশার সঞ্চার করছে ।তবে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন আসন্ন সংসদ অধিবেশনের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করছে ।













তথ্যসূত্র ঃ
১। দৈনিক প্রথম আলো, ২০১০ সাল
২। দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০১০ সাল
৩। দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৯৭৯।
৪। চিন্তা পত্রিকা, ৩০ নভেম্বর ২০১০
৫। চলমান রাজনীতি, সংখ্যা ৭
৬। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
৭। শীর্ষ কাগজ।
৮। আমাদের সংবিধান, তুরিন আফরোজ
৯। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সিরাজুল ইসলাম
১০। ইন্টারনেট।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×