এক বিকেলে রবীন্দ্রনাথ এলেন মৃণালিনীর ঘরে।শরীরটা একেবারে শুকিয়ে গেছে মৃণালিনীর।কন্ঠার হাড় প্রকট,মুখখানি রক্ত শূন্য,নির্জীবের মতন সারাক্ষন শুয়ে থাকতে হয় বিছানায়।রাতের পর রাত তার ঘুম আসে না।পেটের যন্ত্রনার জন্য কিছু খেতেও পারেন না।রবীন্দ্রনাথ শিয়রের কাছে এসে মৃণালিনীর একটি হাত মুঠোয় ভরে বললেন,চোখ চেয়ে থাকো কেন সর্বক্ষন?চোখ বুঝে থাকলে ঘুম আসতে পারে।মৃণালিনী তবুও স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।খুব ধীরে ধীরে তার চোখ জলে ভরে যায়।রবীন্দ্রনাথ এক আঙুল দিয়ে মুছে দিলেন সেই অশ্রু।মৃণালিনী ধীর স্বরে বললেন,তুমি শমীকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলে?আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলে না?রবীন্দ্রনাথ বললেন,স্কুল খুলে গেছে,ওর এখানে পড়াশোনার সুবিধা হচ্ছিল না।যাওয়ার সময় তোমার সাথে দেখা করে গেছে,দু'বার তোমাকে ডেকেছিল,তুমি শুনতে পাওনি।তুমি তখন একটু ঘোরের মধ্যে ছিলে।তাই বেশি ডাকাডাকি করিনি।মৃণালিনী বললেন,শমী কখনও আমাকে ছেড়ে থাকেনি,ও শান্তিনিকেতনে কি করে একা একা থাকবে?রবীন্দ্রনাথ বললেন,একা কেন?ওখানে ওর বয়সী আরও ছাত্র আছে,তারা যেমন থাকে,তাদের সাথে মিলেমিশে থাকবে শমী।মৃণালিনী বললেন,আমি চলে যাবো।আমার সময় খুব কম।শমীর সাথে আর দেখা হবে না?রবীন্দ্রনাথ বললেন,বালাই ষাট।ও কথা বলছও কেন?তুমি এবার ভালো হয়ে উঠবে।আমরা সবাই মিলে নীলগিরি পাহাড়ে বেড়াতে যাব।এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো।মৃণালিনী পাশ ফিরলেন।বেরিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ।আর মনে মনে বললেন,আমি আর তোমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাব না মৃণালিনী।রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন,মৃণালিনীর অভিমান খুব গভীর।শমীকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেওয়া খুবই ভুল হয়েছে।(শমী ফিরে আসার আগেই মৃণালিনীর বাক শক্তি হারায়।)
প্রতি মাসের শেষেই রবীন্দ্রনাথকে দারুন উৎকন্ঠার মধ্যে কাটাতে হতো।শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের বেতন চুকিয়ে দিতে না পারলে অসন্তোষের সৃষ্টি হবে।ছাত্রদের প্রতিদিনের খাদ্য সরবরাহ যদি ঠিকমত না হয়।আরও কত টুকিটাকি খরচ থাকে,ঝড়ে হঠাৎ কোনোও বাড়ির চাল উড়ে গেলে বড় খরচের ধাক্কা এসে পড়ে।সব দায়িত্ব একা রবীন্দ্রনাথের।কোনও উপায়ান্ত না দেখে রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন,ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হবে।রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঋনও কম নয়।বিলেতে মেয়ে জামাইকে টাকা পাঠাতে হয়।যতবার ব্যবসা করতে গেছেন ততবারই প্রথমে কিছুদিন একটু সোনালি রেখা দেখতে পাওয়ার পরই ক্ষতি শুরু হয়েছে।ঋনের কারণে রবীন্দ্রনাথকে মাসিক সুদ দিতে হতো একশো পয়তাল্লিশ টাকা তের আনা চার পাই!রবীন্দ্রনাথ ভাবেন,এই টানাটানির মধ্যেও মৃণালিনী সংসার চালাচ্ছে কোন মন্ত্র বলে!"পূন্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উথথানে/মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে/হে ন্সেহার্ত বঙ্গভূমি,তব গৃহক্রোড়ে/চিরশিশু করে আর রাখিও না ধরে/পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের দোরে/বেঁধে বেঁধে রাখিও না ভালো ছেলে করে/সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি করে,মানুষ করনি"।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতি বছরই দু-তিনটি বিয়ে হতো।ঘটক ঘটকিরা নিয়মিত যাতায়াত করতো ঠাকুর বাড়িতে।তারা নানান রকম সম্বন্ধ নিয়ে আসত।বেশি দেরী করলে মেয়ে অরক্ষনীয় হয়ে যাবে বলে তারা মৃণালিনীর কান ভারী করতো।রবীন্দ্রনাথ কল্পনা বিলাসী বলেই মৃণালিনীকে বাস্তববাধী হতে হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত থাকতেন 'ভারতী'পত্রিকায় ধারাবাহিক 'চিরকুমার সভা' ও 'নষ্ট নীড়', আর বঙ্গদর্শন-এ লিখতেন,'চোখের বালি' উপন্যাস।ওই সময় একসাথে তিনটি ধারাবাহিক লেখার কথা কোনো বাঙালি লেখক কল্পনাও করেননি।(ধারাবাহিক 'নষ্ট নীড়' লিখতে লিখতে বারবার নতুন বউঠানের(কাদম্বরী)কথা মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথ।এমনকি 'চোখের বালি' লেখার সময়ও।)কাদম্বরীর প্রিয় কবি ছিলেন বিহারীলাল।
রবীন্দ্রনাথ তার মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ে দিতে গিয়ে উপলব্ধি করেন- বিয়েতে পন দেওয়া,গরু ছাগল কেনা বেঁচার সমান।এ কু-পথাকে সমাজ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবার কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেকবার ভেবেছেন।দেবেন্দ্রনাথ এই প্রথার ঘোর বিরোধী।রবীন্দ্রনাথ মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে এইসব ভুলে গেলেন।তিনি বিহারীলালের ছেলেকে জামাতা হিসেবে পাওয়ার জন্য পন দিতেও রাজি হলেন।প্রথমেই পাত্রপক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পন চেয়ে বসলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে।পরে কুড়ি হাজার থেকে নামতে নামতে দশ হাজারে পৌছে পাত্রপক্ষ অনড় হয়ে থাকলেন।অনেক ঘটনার পর মাধুরীলতার বিয়ে সম্পন্ন হয়।জোড়াসাঁকোর পরিবারের সকলেরই বিয়ের কখচ দেন দেবেন্দ্রনাথ তার নিজস্ব তহবিল থেকে।
মাধুরীলতার বিয়ের মাস দেড়েক যেতে না যেতেই রবীন্দ্রনাথ তার দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা বাঁচানো যায়।দেবেন্দ্রনাথ চক্ষু বুঝলেই ভাইদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যাবে,তখন সব খরচই প্রত্যেকের নিজস্ব।
প্রেমতোষ বসু এক প্রেসের মালিক,তিনি রবীন্দ্রনাথের বই যত্ন করে ছাপেন।তিনি একদিন বললেন,তার এক বন্ধুর ভাইপো ডাক্তার।সে আবার হোমিওপ্যাথি পড়বার জন্য বিলাত যেতে ইচ্ছুক।কিন্তু বিলাত যাবার সঙ্গতি নেই,তাই কোন উচ্চ পরিবারের মেয়ে বিয়ে করার জন্য উৎসুক।রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষনাৎ সত্যেন্দ্র ভট্রাচার্য নামে সেই ছেলেটিকে দেখতে চাইলেন।কথাবার্তা শুনে পছন্দ হয়ে গেলে,ছেলেটিকে বিলেত পাঠাবার ও সেখানে পড়াশোনা চালাবার খরচ জোগানোর শর্তে রাজি হয়ে সম্বন্ধ স্থির করে ফেললেন রেণুকার জন্য।টাকা তো যাবে পিতার তহবিল থেকেই!
মাধুরীলতার বিয়ে হয়েছিল ১লা আষাঢ়,রেণুকার বিয়ে হয় ২১ শে শ্রাবন।রেণূকার বয়স মাত্র সাড়ে দশ।যে কবি এক সময় বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছিলেন,এখন প্রয়োজনের তাগিদে তা বিস্মৃত হয়েছিলেন।কবি নয়,কন্যার পিতা হিসেবে তার সম্বন্ধ করা নিঁখুত ও সার্থক!কিন্তু কবিকে তার মূল্য দিয়ে হয়েছিল।পরের দু'তিন মাস তিনি একটাও কবিতা লিখতে পারেননি।কন্ঠে আসেনি কোন নতুন সুর।
(চলবে...)
[তথ্যসুত্র শেষ পর্বে দেওয়া হবে]
আলোচিত ব্লগ
আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?
ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প
বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন
একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ
(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাড়ির কাছে আরশিনগর
বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।
কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমি ভালো আছি
প্রিয় ব্লগার,
আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন