somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি নীল স্কুল ব্যাগের গল্প

০৬ ই আগস্ট, ২০১৩ ভোর ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

: না আমি স্কুলে যাবো না ।
: কেনো আব্বু ?
: তুমি খুব পচা আব্বু !
: কেনো আব্বু ? কী করেছি আমি ?
: সবাই কত্তো সুন্দর স্কুল ব্যাগ নিয়ে যায় । আর আমার কোনো স্কুল ব্যাগ নাই !
: আমি আজই তোমার জন্যে স্কুল ব্যাগ নিয়ে আসবো আব্বু; এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো স্কুলে যাও ।
: সত্যি আনবা তো ?
: হ্যাঁ আব্বু ।

রহমান সাহেবের আদরের ছেলে নাদিম । সবে মাত্র স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন । এই দু’দিন ঠিকই ছিলো, সমস্যাটা হয়েছে আজ সকালেই । নাদিম তার বাবার কাছে বায়না ধরেছে । তেমন বেশি কিছুর জন্যে নাহ, একটি স্কুল ব্যাগের জন্যে বায়না ধরেছে । এই বয়সে সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ে’দের কাছে নানা রকম বায়না ধরে । যেমন খেলনার বায়না, জামার বায়না । এইসবের তুলনায় একটি স্কুল ব্যাগ তেমন কিছুই না । বরঞ্চ এটা ওগুলোর চাইতে শতগুণ বেশি জরুরি । ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একটা স্কুল ব্যাগ এখনো কিনে দেননি । আসলে কিনে দিতে পারেননি । কেমন করেই বা দিবেন ? প্রাইভেট একটি ফার্মে স্বল্প আয়ের একটি ছোটখাট চাকরী করেন । এই মাসের বেতনের প্রায় অর্ধেকটুকু দিয়ে গতমাসের বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করেছেন । যা ছিলো তার অনেকটুকুই গেছে স্কুল ভর্তি, স্কুলের বই-খাতা আর স্কুল ড্রেসের পেছনে । একটা স্কুল ব্যাগ যে অপ্রয়োজনীয় ঠেকেছে রহমান সাহেবের কাছে, তা নয় । কিন্তু তার পকেটের যে অবস্থা ! ভেবেছিলেন কিছুদিন পরই দেবেন । নিজের অবস্থা নিজে বুঝেন ঠিকই, কিন্তু একটা শিশুকে বুঝাবেন কী করে ?

কিছু পলিথিন পাওয়া যায়, সাদা রঙের উপর কালো ডোরাকাটা । রহমান সাহেব প্রথম দু’দিন সেই পলিথিনে বই-খাতা ঢুকিয়ে দিয়ে তার আদরের সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন । প্রথম দিন কাঁধে পলিথিন ঝুলিয়ে অনেক আনন্দ নিয়েই স্কুলে গিয়েছিলো নাদিম । সবার ব্যাগের সাথে তার সাদা-কালো ব্যাগটার পার্থক্য প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিলো । ঐদিন বাসায় এসেই একটা ব্যাগের জন্যে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিয়েছিলো । দ্বিতীয় দিন কোনো রকমে বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন ছেলেকে । কিন্তু আজ ? আজ অবশ্য ছেলেকে একরকম প্রতিশ্রুতিই দিলেন যে আজই অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলের জন্যে একটা ব্যাগ নিয়ে আসবেন । রহমান সাহেব জানেন, তিনি এটা পারবেন নাহ । তারপরও তার তো কিছু করার নেই । তিনি যে নিরুপায় । পেটে দিলে পিঠে সয়না, আবার পিঠে দিলে পেটে সয়না । এটাই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের চিরাচরিত নিয়ম ।


দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে নাদিম । বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই খেলতে চলে গেলো । কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ঘরে ফিলো । ফরিদা বেগম আরও খেয়াল করলেন, ছেলে গোমড়া মুখে ঘরে ফিরে এসেছে । ছেলেকে কাছে ডেকে বুকে টেনে নিলেন ফরিদা বেগম ।
: কী হয়েছে আব্বু ? খেলতে যাওনি ?
: হু ।
: তো চলে এলে যে ?
: ওরা আমাকে গরীব বলেছে ।
: কেনো আব্বু ?
: আমি একটা পলিথিন নিয়ে স্কুলে যাই, তাই ।
: থাক আব্বু, ওদের সাথে খেলতে যাওয়ার দরকার নেই ।
: আচ্ছা আম্মু, গরীবরা কি খুব খারাপ ?
: না তো আব্বু ।
: আমরা গরীব কেনো আম্মু ?

ফরিদা বেগম তার ছেলেকে এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবেন ভেবে পেলেন নাহ । শুধু বললেন, “যাও আব্বু, পড়তে বসো গিয়ে । আমি আসছি ।”

মাগরিবের নামাজটা পড়ে ছেলেকে নিয়ে বসলেন ফরিদা বেগম । ডায়েরী খুলে বাড়ীর কাজগুলো করাচ্ছিলেন । ছেলের মেধা ততোটা ভালো না হলেও অন্তত খারাপ নয়, অল্পতেই পড়া বুঝে নিতে পারে । ছেলেকে কাজগুলো করতে গিয়ে ফরিদা বেগম আপন মনেই কিছু একটা ভাবছিলেন । ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন ।
: আম্মু শেষ ।
: সব ?
: হ্যাঁ আম্মু ।
: কই দেখি ?

ফরিদা বেগম ছেলের খাতা দেখছেন ।
: আম্মু, আব্বু কখন আসবে ?
: কিছুক্ষণ পরই আসবে ।
: আজ কি আব্বু ব্যাগ আনবে ?
: আনবে আব্বু, অবশ্যই আনবে । আব্বু, তুমি এখন এই পড়াগুলো একটু পড় তো । আমি আসছি ।

ছেলেকে পড়তে বসিয়ে ফরিদা বেগম রান্না ঘরে এলেন । ছেলের পিঠে ব্যাগ উঠুক বা না উঠুক, পেটে অন্তত কিছু পড়তে হবে । ছেলেকে কিছু মুড়ি দিয়ে আবার রান্না ঘরে চলে এলেন । রাতের উদরপূর্তির বন্দোবস্ত করতে হবে । ‘উদরপূর্তি’ শব্দটা বোধহয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে একদমই বেমানান । শব্দটা শুনলেই কেমন জানি মনে হয়ে এর সাথে ঐশ্বর্য জড়িত । ঐশ্বর্য যেমন ঐ উঁচু আসন ছেড়ে কখনো নিচে নেমে আসবে না, এই শব্দটিও তেমনি ঐ জাঁকজমক পরিবেশ ছেড়ে এই সাদামাটা, চুন খসে পড়া চার দেয়ালের মাঝে আসবে নাহ ।


মানুষটা সাধারণত রাত ন’টার মাঝেই চলে আসে । দশটা বেজে গেলো, এখনো মানুষটি আসার নাম-গন্ধও নেই । কোথায় যে গেলো ? কাজের চাপ কি খুব বেশী ? নাকি খারাপ কিছু ঘটলো ? ছি ! ছি ! এইসব আমি কী ভাবছি ! আল্লাহ্‌, তুমি মানুষটাকে সহিহ সালামতে ফিরিয়ে আনো । ফরিদা বেগমের অশান্ত মনের বিক্ষিপ্ত চিন্তায় ছেদ পড়ে ছেলের ডাক শুনে ।
: আম্মু, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ।
: ঘুমিয়ে যাবে ?
: না আম্মু, আব্বু এলে ঘুমাবো ।
: ঘুমিয়ে পড় আব্বু, কাল সকালে স্কুল আছে ।
: আর একটু অপেক্ষা করি ।
: না আব্বু । এখনি ঘুমিয়ে পড় ।
মায়ের চোখ রাঙানোয় আর কিছু বলার সাহস পেলো না নাদিম । বাধ্য ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়লো ।

মানুষটা যে কী ! সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো, এখনো আসছে নাহ । কোনো ভাবে যে একটা খোঁজ পাবে, তার উপায়ও নেই । এমনি ভাবতে ভাবতেই আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন ফরিদা বেগম ।


সকাল সাড়ে ছয়টা । নাদিমের ঘুম ভাঙলো তার মায়ের ডাকাডাকিতে । নাদিম কোনোরকমে চোখটা খুলে চারপাশে তাকালো । প্রথমেই নজর গেলো টেবিলের দিকে । অনেক আশা নিয়ে তাকিয়েছিলো সে । না, ওখানে কোনো ব্যাগ নেই । ঘুম থেকে উঠেই মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেলো নাদিমের । হঠাৎ বিছানায় তার পাশে তাকিয়ে দেখলো তার বাবাও নেই ! খানিকটা অবাক হলো । তাহলে কি বাবা কাল রাতে আসেনি ? মা’কে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে, ওমনি দরজায় তাকিয়ে দেখে তার বাবা ঘরে ঢুকছে, হাতে নীল রঙের কী জানি একটা । ভালো করে তাকিয়ে দেখতো পেলো ওটা একটা স্কুল ব্যাগ । ওমনি মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে বাবার কোলে উঠে গেলো নাদিম । রহমান সাহেবও পরম আদরে ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “যাও আব্বু, মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নাও । দেরি হয়ে যাচ্ছে ।”

রহমান সাহেবের এলাকায় একটা ব্যাগের দোকান আছে । কাল রাতে ফিরতে দেরি হয়ে যাওয়াতে দোকানটা বন্ধ পান । তাই আজ সকালেই বের হয়ে তার আদরের ছেলের জন্যে একটা ব্যাগ কিনে নিয়ে আসলেন । আসলে বাবা-মা’রা কখনোই চাননা যে তাদের সন্তানের কোনো ইচ্ছা অপূরণ থাকুক । কিন্তু সবার তো আর একরকম সামর্থ্য নেই । অনেকেরই সাধ থাকে, থাকে না সাধ্য । রহমান সাহেব তাদেরই একজন । অফিসের এক সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে ছেলেকে ব্যাগটা কিনে দিয়েছেন । টাকা ধার করতে যেয়ে হয়তো আত্মসম্মানে বেধেছে, তারপরও চেয়েছেন তার ছেলে অন্তত হাসি-খুশি থাকুক । এটাই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা’দের একমাত্র চাওয়া ।

নাদিম পিঠে নীল ব্যাগটা ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে । ব্যাগটা তার খুব পছন্দ হয়েছে । রহমান সাহেব আর ফরিদা বেগম নাদিমের গমন পথের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । কেউ খেয়াল করেনি যে তাদের দু’জনের চোখ দিয়েই টপ টপ করে পানি পড়ছে । এই অশ্রু দুঃখের অশ্রু নয়, এই অশ্রু একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আনন্দের অশ্রু ।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×