ওকে সবসময় মিস করি বলে মনে হয়না, তবে আমার অতি কষ্টের সময় আর আমার খুশির কোনো সময় ওকে খুব মিস করি। মিস করি ঈদ পুজা পার্বনে। খুব মনে পড়ে যখন গ্রামে যাই। যখন রাস্তায় হাটি, যে রাস্তা দিয়ে দুজনে হেটে স্কুলে যেতাম। বৃষ্টি হলেই স্কুল পালিয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি চলে আসতাম। যে ছিলো আমার সকল কষ্টের ভাগিদার। আমার মনমরা দেখলে ওর চোখজোড়া অশ্রুতে ভিজে যেতো। আমি একদিন স্কুলে না গেলে সেদিন ওর ক্লাসে মন বসতোনা। বাড়িতে এসেই আমাকে ফোন করতো, কেন আজ স্কুলে যাইনি। আমার শরীর খারাপ করলে ও আমার বাড়িতে দেখতে যেতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।
ওর সবচেয়ে প্রিয় মজার বিষয় ছিলো আমার সাইকেলের পিছনে বসা। খুব মজা পেতো। আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য সাইকেলে উঠে বসতাম, ও তখন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো যেনো, ওকে আমি ডাকি। স্কুলের পিকনিক বা কোনো অনুষ্ঠানে আমি থাকতে না পারলে ও কখনোই সেই ইভেন্টে অংশ নিতোনা। ---
দুজনে খুব মজা করতাম। মাঝে মাঝে ওর আমার বন্ধুত্বের গভীরতা পরীক্ষা করার জন্য আমি মাঝেমাঝে শুধু শুধু রাগ দেখাতাম ওর সাথে। ও খুব কান্না করতো। আমাকে কিছু বলতেও পারতোনা। অন্যসব বান্ধবীদের কাছে বলতো, তোরা ফজলুকে বল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ও শুধু শুধু রাগ করছে। ওকে তোরা বুঝা। ... আমি তখন খুশিতে অনেক হাসতাম। ও তখন আমাকে কিলঘুষি দেওয়া শুরু করতো। --
আমরা দুজন যখন স্কুলে যেতাম আর আসতাম (ওহ বলাই হয়নি, ওর বাড়ি আমার গ্রামেই, আর স্কুল ছিলো ১কি.মি দুরে।) তখন অনেক কথা হতো। আমার সব কষ্টগুলো ওর কাছে শেয়ার করতাম। ও আমাকে স্বান্ত্বনা দিতো। ভবিষ্যত সম্পর্কে ভাবতে শেখাতো। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হতো যে, আমরা দুজনেই প্রতিদিনই প্রতিজ্ঞা করতাম যে আমরা কেউ বিয়ে করবোনা। অথবা বিয়ে করলেও যাতে আমাদের বন্ধুত্ব চির অটুট থাকে সেরকম স্বামী আর স্ত্রী দেখে বিয়ে করবো। --- ওহ! বলাই হয়নি.. ওর নাম *“সুরুভী”*। সম্পর্কে আমার পাড়াতো মামাতো বোন। ওর বাবা মা খুবই ভালোবাসতো আমাকে । আমাদের গ্রামে ওর মতো ভদ্র নম্র কোনো মেয়ে আমার কেনো আমাদের এলাকার কেউ দেখেছে বলে আমার মনে হয়না। রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যেতো, তখন পিছনে কি হচ্ছে, আশে পাশে কি হচ্ছে সেগুলোও ও দেখতে কিনা সন্দেহ আছে।
যাহোক, আমরা দুজনে এভাবেই একসাথে ৫ বছর কাটাই। এস,এস.সি পরীক্ষা শেষ করি। যেদিন আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন ও আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলো। বলেছিলো, আজ স্কুল জীবন শেষ হলো। ইচ্ছে হলেই এখন আর তোমার সাথে দেখা করার, কথা বলার সুযোগ থাকবেনা। জানিনা, তুমি কোন কলেজে ভর্তি হব, আর আমিইবা কোথায়!? এসব বলে অনেক কেঁদেছিলো। তারপরে ও টাঙ্গাইলে ওর মামার বাড়িতে চলে গেলো। আর দেখা নেই। ফোনেও কথা হয়না। পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। রেজাল্টের পরে আসে ও । আমরা দুজনে মিষ্টি নিয়ে স্কুলে যাই। স্যারদের মিষ্টি মুখ করাই।
তখন ও বলে, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমি রাগ করি। কারণ ও বিয়ের আগে বা বিয়ের সময় আমাকে কিছু জানাইনি বলে। আসলে ওরা মামাতো ভাই টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বিরাট ধনী। টাঙ্গাইলে তাদের বাসাবাড়ি আছে। সমবায় মার্কেটে কয়েকটা শোরুম রয়েছে। সুরুভীকে ওর মামা খুব পছন্দ করতো। তাই ওরা মামার ইচ্ছাতে ওর বিয়ে হয়েছে। ওদের চেয়ে মামারা অনেকবেশি ধনী। তাই ওর বাবামাও সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। তাই সম্পূর্ণ ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়।। তবে প্লান ছিলো পরে ধুমধাম অনুষ্ঠান করবে। এর পরে ওর সাথে আরো কয়েকবার দেখা হয়েছিলো আমার।
আমি ভর্তি হই আমার পাশের গ্রামে হেমনগর ডিগ্রী কলেজে। আর ও ভর্তি হয়, টাঙ্গাইলের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাহমুদুল হাসান কলেজে। মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলো। বিয়ের পর ওর সাথে আমার যোগাযোগ একেবারে কমে যায়। তবে যেকোনো বিশেষ দিনে ও আমাকে উইশ করতে ভোলেনি কখনো। ২০১১ এর শেষ দিকে আমার জীবনে একটা বড় ট্রাজেডী হয়ে যায়। সেসময় ও আমার পাশে থাকতে না পারলেও সকাল বিকাল ফোন করে খোজ খবর নিতো। আমাকে উৎসাহ যোগাতো।
২০১২’ এপ্রিলে এইচ.এস.সি পরীক্ষা শুরু হলো। সুরুভীও পরীক্ষার্থী। ও আমাকে ফোন করে খুব করে বুঝিয়ে শুনিয়ে মন দিয়ে পড়তে বললো। জীবনে অনেক ভালো কিছু করতে হবে। স্বপ্ন দেখালো। যথারীতি পরীক্ষা দিলাম। ও প্রতিটি পরীক্ষার খোজ খবর নিতো। পরীক্ষার জন্য সাজেশন দিতো। যাহোক ভালোয় ভালোয় পরীক্ষা শেষ হলো। আরেকটা কথা যেটা বলা হয়নি, তা হলো পরীক্ষা চলাকালীন সময় ও সন্তানসম্ভবা ছিলো। ঐ অবস্থায়ই ও পরীক্ষায় অংশ নেয়।
আমি ঢাকা চলে আসি। বেচে থাকার তাগিদে একটা চাকরী তখন খুবই দরকার। চাকরী যেনো সোনার হরিণ। শেষমেষ একটা কার্টুন ফ্যাক্টরিতে আমার চাকরী হয় হেল্পার হিসেবে। বেতন ২২০০ টাকা। সারাদিন গাধার মতো খাটতে হতো। ঐ সময়টাতে খুব মিস করতাম আমার বন্ধুবান্ধবীদেরকে। তখন কেনো জানি আমার সব বন্ধুরাই আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। এইতো! কলেজ জীবনের শেষ দিকেও অনেক বন্ধু –বান্ধবী ছিলো। অনেকেই সকালবিকাল আমাকে কল দিতো, মিস দিতো, মেসেজ দিতো। কিন্তু আমার চরম অবস্থায় সবাই যেনো আমাকে ছাড়তে পারলে বাঁচে। শুধু আমাকে ছেড়ে থাকতে পারেনি আমার সেই প্রিয় বন্ধু সুরুভী। প্রতিদিন না পারলেও প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও আমাকে ফোন করে খোঁজখবর নিতো। এরপরে পরীক্ষার রেজাল্ট হলো আগষ্টের শুরুর দিকে (সম্ভবত)। ও রেজাল্টের আগের দিন। বললো, ভয় করছে, জানিনা পাশ করতে পারবো কিনা। তবে তোমার জন্য দোয়া করি সারাক্ষণ। তুমি যেনো একটা সম্মানজনক রেজাল্ট করতে পারো। আমি বলি, পরীক্ষা ভালো দিতে পারলে তো সম্মানজনক রেজাল্ট আসবে? এইসব নিয়ে অনেক হাসাহাসি করি দুজনে।
পরের দিন রেজাল্ট। ও আমার রেজাল্ট জেনে খুবই মন খারাপ করলো। (আসলে আমার এস.এস,সি তুলনায় এইচ.এস.সি’র রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়) আমাকে অনেক শাসনমুলক কথা বললো। যেনো ও আমার শিক্ষয়িত্রী, আমার বড় বোন। ওর রেজাল্ট মোটামুটি ভালো ছিলো। সংসারের কাজ করতে হতো, তারমধ্যে আবার গর্ভবতী থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়া। সে তুলনায় ভালো রেজাল্ট। ওর পয়েন্ট ছিলো ৩.৯০। আমারও তাই। সমান সমান। ওর এস.এস,সি রেজাল্টও ছিলো ৩.৯০।
যাহোক, শেষে বললো, এই সপ্তাহের যেকোনো দিন ওর ডেলিভারী হবে। আমি তো মহাখুশি। কবে মামা হবোরে... ।সেদিন আর ওর সাথে কথা হলোনা। আমি এলাকার আমার এবং ওর প্রিয় এক বন্ধুকে ফোন করে এই খুশির সংবাদটা দিলাম। বন্ধুকে বললাম, আমি আর তুই মিলে দুজনে মিলে ওর বাচ্চাকে দেখতে যাবো। আমি দিবারাত্রি ভাবতে শুরু করি, কিভাবে কি করবো। আমার কাছে তো টাকা নাই। আমি ভাইয়ের কাছে ৮০০ টাকা চেয়ে রাখলাম। বললাম, যেকোনো দিন তোমার কাছ থেকে এই টাকা নেবো। আমার প্লান ছিলো ৩০০ টাকা আমার যাতায়াত ভাড়া। আর ৫০০ টাকার ওর ছেলে বা মেয়ের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাবো। আমি আমার বন্ধুরা সবাই এটা নিয়ে ফোনে আলোচনা করলাম দুইরাত্র।
তখন রোজার মাস। একদিন সকালে আমি অফিসে গেছি। এরই মধ্যে আমার এক বন্ধু ফোন করলো, গ্রাম থেকে... বন্ধুর ফোন পেয়ে ওর গলার আওয়াজ শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে.. ও বলতে আমতা আমতা করছে। শেষে কেঁদে দিয়ে বলে, ফজলু.. সুরুভী আর নেই। .. আমি তো ধপ করে বসে পড়লাম। একি বলিস তুই.. এটা কিভাবে মেনে নেবো। আমার সাথে ৩ দিন আগেও কথা হলো। বললো, “দোয়া করো। আমার ভয় করছে।“ .. তাহলে ওর এই ভয়ই কি ওর কাল হলো। --
আমি একটু শক্ত হয়ে বিস্তাড়িত জানতে চাইলাম, বন্ধু বললো, গতকাল সকালে ওর ডেলিভারী হয়। একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে সে। পড়ে তাকে হাসপাতাল থেকে সেদিনই বাড়িতে আনা হয়। বাড়িতে তাকে কেউ কেয়ার করেনি। সেদিন সন্ধ্যায় ওর রুমে ও একাই ছিলো। হাতের কাছে পানি ছিলোনা। ও পানি খাবার জন্য বিছানা থেকে উঠলে মেঝেতে পড়ে যায়। অনেক বমি করে। আর পড়ে যাওয়াতে ওর সিজার করার পরে পেটে দেয়া সেলাই ছুটে যায়। ওর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে। তাকে হাসাপাতালে নেয়া হয়। ততোক্ষণে সে ইন্তেকাল করেছে। আজ সকালে ওর লাশ বাড়িতে আনা হয়েছে। ১১ টার সময় মাটি দেয়া হবে।
আমি শুনে তৎক্ষনাৎ স্যারের কাছে গিয়ে ছুটি চাইলাম। ছুটি দিলোনা। শেষমেষ না বলেই চলে আসি বাসায়। এসে দেখি ভাই বাসায় নাই। সেও অফিসে। তাকে ফোন করে ছুটে গেলাম তার অফিসে। তখন ভাই আমাকে টাইম দেখালো। বললো, এখন বাজে প্রায় ১০ টা। তুই এতো কম সময়ে কিভাবে যাবি। গিয়ে তো ওকে দেখতে পারবিনা। তার চেয়ে বাসায় যা। ওর জন্য দোয়া কর। আমি কিছুই ভাবতে পারলাম না। ভাইয়ের কথামতো বাসায় চলে আসলাম। আর ভাবতে থাকি ওর সাথে আমার স্মৃতিগুলো। নিজের অজান্তেই দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে।
আমি আজো খুব বেশি মিস ওকে। আমার কষ্টের মুহুর্ত গুলো শেয়ার করার মতো কাউকে পাইনা। পাইনা আমার ভালো কোনো কাজ ওকে দেখাতে। আমি খুব মিস করি ওকে। খুব বেশি। ওর স্মৃতিগুলো আমাকে এখনো এখনো হাসায়, এখনো কাদায়। সবকিছুই চলছে সময়ের আবর্তে। আমিও চলছি। কেটে যাচ্ছে আমার দিনগুলো। শুধু ও নেই। আমার প্রিয় বন্ধুটি নেই। বাল্যবিয়ের বলি হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যাকে আমি বন্থু হিসেবে আমার হৃদয়ের গহীনে জায়গা করে দিয়েছিলাম। বন্ধু হিসেবে ওকে আমি কান্না ছাড়া কিছুই দিতে পারি নাই। তবে ও আমাকে দিয়েছে উজাড় করে। আমি ভালোবাসি বন্ধু। খুব বেশি।
এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমার আবেগ অনুভুতি হয়তো সেভাবে বুঝাতে পারিনি। তবে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতাবোধ লিখনীতে প্রকাশ করারমতো শব্দজ্ঞান আমার নেই। সে আমার জীবনে চিরসবুজ হয়ে থাকবে। আমি ওকে ভুলতে পারবোনা কখনোই।
সর্বশেষ, সকলের কাছে আমার এই বন্ধুটির আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া প্রার্থনা করছি। আল্লাহ ওকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন।