somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্পঃ সাদা গোলাপ-লাল গোলাপ

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শুভ্র ঘড়িতে সময় দেখল। ২টা ২০ বাজে। সে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে একটি গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই কলেজে মৌ পড়ে। কোন গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যে কী অস্বস্তির ব্যাপার সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আশেপাশের সবাই তার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন সে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় নারীলিপ্সু-লম্পট যুবক। সবচেয়ে বড় ইভ-টিজার। শুভ্র মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার ঘড়ি দেখল। মাত্র পাঁচ মিনিট গিয়েছে।

আচ্ছা মৌ তাকে চিনতে পারবে তো? শুভ্র ভাবতে লাগল। অবশ্য চিনতে না পারাটা দোষের কিছু হবেনা।গত আড়াই বছরতো সে শুভ্রকে দেখেইনি। আর আড়াই বছর আগে যখন দেখেছিল তখনো কোন কথা হয়নি ।শুভ্রও মৌকে শেষবার দেখেছিল আড়াই বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়টা শুভ্র মৌকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে নিরন্তর। ভুলতে তো পারেইনি, বরং তার ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। এই ডাল-পালা মেলে আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসার বীজ পুঁতেছে শুভ্র প্রায় পাঁচ বর্ষা আগে।

তখন শুভ্র পড়ত ক্লাস টেনে। ছিমছাম মফস্বলের এক প্রাইভেট স্কুলে। শুভ্রের পৈত্রিক বাড়ি সেখানেই। আর সেই সময় মৌ ছিল ক্লাস সেভেনে। মৌ-এর বাবা ঐ শহরে চাকরির সুবাদে গিয়েছিলেন।
শুভ্র ক্লাস টেনে পড়ার সময় বুঝতে পারে মৌ-এর প্রতি তার এক অস্বাভাবিক কিন্তু প্রগাঢ় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে । সে ছিল তার ক্লাসের ফার্স্ট বয়। লম্বা, শ্যামলা আর মাথার উপর ঘন কালো চুলের চুপচাপ এবং প্রচন্ড লাজুক এক ছেলে । ব্যাপারটা সিনেমার মত হলেও মৌ ছিল তার ক্লাসের সেরা ছাত্রী। দীঘির মত গভীর আর আয়ত চোখের অপূর্ব সুন্দরী এক কিশোরী, যে কিশোরী এক অজানা সংকোচে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করত। শুভ্র ভালো ছাত্র হলেও স্কুল তার খুব একটা পছন্দের জায়গা ছিলো না। তবে যখন থেকে তার মৌ-এর জন্য এক প্রবল আকর্ষণ জম্মায় তখন থেকে সে একেবারে নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে। মৌকে এক পলক দেখার জন্য সারাক্ষণ ছটফট করত সে। শুভ্র ছিল ধুবই ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির ছেলে। কথা বলা তো দূরের কথা, সে কখনোই মৌ-এর চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারতনা। কেবল দূর থেকে তাকে দেখত, আর কাছে এলে মাথা নিচু করে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। যেদিন মৌ স্কুলে যেতনা, সেদিন শুভ্র খুব অস্থির বোধ করত। বুকের বাম পাশে কিছু একটা হারিয়ে গেছে বলে মনে হত তার। বাসায় এসে সে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারতনা।

এভাবেই একের পর এক অস্থির বিষন্ন দিন যেতে থাকে। মৌ শুভ্রকে চিনত শুধু একজন ভাল ছাত্র হিসেবে। এর বেশি কিছু তার ভাবার কথা না, সে ভাবেওনি। মৌ কখনো বুঝতে পারেনি যে শুভ্র নামের এক ছেলে তাকে মনের বাসরে কিশোরী বধূ সাজিয়ে রেখেছে। শুভ্রও সাহস করে উঠতে পারেনি মৌকে এইসব কথা বলার। কারণ, সবার মত তারও খুব ভালোভাবে জানা ছিল যে, মৌ খুব পড়ুয়া মেয়ে, পড়ালেখার বাইরে কিছু সে ভাবত না। প্রেম-ভালবাসা নিয়ে ইচঁড়ে পাকামি করার মত মেয়ে সে মোটেই ছিল না। আর শুভ্রের নিজের ভীতি আর সংকোচ তো ছিলোই।
শুভ্র যে বছর এস.এস.সি দিবে সেই বছর অতর্কিত মৌ স্কুল ছেড়ে তার পরিবারের সাথে ঢাকা চলে আসে। শুভ্র ভেবে পেলনা কী করবে। তার কাছের বন্ধুর অভাব ছিলো না। কিন্তু লাজুক শুভ্র তার হৃদয়ের দহনের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারল না। ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের মত একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে সে। তার বুকের এক অংশ যেন কোন উত্তাল স্রোতে ভেসে গেছে। সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার কাছে। সামনে পরীক্ষা, অথচ পড়ালেখা করার মানসিকতা আর ইচ্ছে সবই নষ্ট হয়ে গেল তার। তবে পরবর্তীতে পরীক্ষায় ভালো করার একটা জ়েদ সৃষ্টি হয় তার মনে। কারন পরীক্ষা ভালো করলে সে নটরডেম কলেজে পড়তে পারবে...মানে ঢাকা যেতে পারবে। আর ঢাকাতেই তো তার স্বপ্নকণ্যা থাকে। খুব ভালো পরীক্ষা দিল সে। রেজাল্টও ভাল হল। নটরডেম কলেজে পড়ার সুযোগ পেল শুভ্র।

নটরডেমে পড়ার সময় শুভ্র মৌ এর এক বান্ধবীর মাধ্যমে তার স্কুলের আর বাসার ঠিকানা পায়। একদিন কলেজ শেষ করে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। প্রায় দেড় বছর পর সে মৌকে দেখতে পায় সেদিন। কিন্তু মৌ তাকে দেখলনা অথবা শুভ্র নিজেই ইচ্ছে করে তাকে দেখা দিল না। এরপর থেকে সে প্রায়ই মৌ-এর স্কুলের সামনে যেত। শুধু দূর থেকে চুপচাপ দেখত যাতে মৌ তাকে দেখতে না পায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন মৌ শুভ্রকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়, স্পষ্টভাবে চিনতে পারে তাকে। কিন্তু কোন কথা বলেনা তার সাথে। বরং কেমন নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রও কোন কথা বলতে পারেনা। বোবার মত নিশ্চুপ হয়ে যায় সে।
ঐদিন বাসায় এসে শুভ্র হতাশার অশুভ্র কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে ভাবে মৌ নিশ্চ্য় তাকে পছন্দ করেনা। পছন্দ করলে তো অবশ্যই কথা বলত। যদি বিন্দুমাত্র কোন অনুভূতি মৌর থাকত তবে তার চোখে সেই আবেগের প্রতিফলন থাকত। তার চোখেও কোন কথা ছিলনা। আবেগী আর অভিমানী শুভ্র পরাজয় মেনে নিতে চাইলনা। চাইলনা প্রত্যাখাত হতে। বরং সে সিদ্ধান্ত নিল মৌকে ভুলে যাবে। কিন্তু প্রথম প্রেম তো আর বাড়ির ঠিকানা অথবা ফোন নাম্বার নয় যে চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়। তবু শুভ্র প্রাণপণ চেষ্টা করল তাকে ভুলে যেতে। মৌর স্কুলের সামনে যাওয়াও বন্ধ করে দিল সে।
দেখতে দেখতে কলেজ জীবন চলে গেল তার। সারাক্ষন মনমরা হয়ে থাকে সে। কিছু ভালো লাগেনা তার, কিছুই ভালো লাগেনা।
কলেজের পাঠ চুকিয়ে শুভ্র ভর্তি হল বুয়েট এ। সময় চলে গেল খুব দ্রুত, কিন্তু প্রথম প্রেমের কিশোরী বধূকে ভুলতে পারলনা সে। চেইন স্মোকারের মতো দিন-রাত সিগারেট খায় আর মৌ-এর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
গতকাল ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার পর বন্ধুদের সংগে আড্ডা দিচ্ছিল শুভ্র। হঠাৎ এক বন্ধু বলল, আচ্ছা শুভ্র, যদি তুই এই মূহুর্তে মরে যাস, কী নিয়ে তোর সবচাইতে বেশি আফসোস হবে? আই মিন এনি রিগ্রেট?
শুভ্র কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল, আমি একজন কে খুব ভালোবাসি, কতটা ভালোবাসি তোরা বিশ্বাস করতে পারবিনা; কিন্তু কখনো তাকে সেই কথাটি বলতে পারিনি...এই কথা বলার পর শুভ্রের হঠাৎ মনে হল সে এতোদিন ভুল করেছে। খুব বড় ভুল করেছে। আসলেই তো, সে যদি এখন মরে যায়, তবে মৌ কখনো জানবেনা যে কেউ তাকে এতো ভালোবাসে। এত আবেগ দিয়ে তার জন্য কেউ কবিতা লিখে। রাতের পর রাত জেগে অশ্রুর অলংকার বুনে। নাহ, এই নিরব ভালোবাসার কোন মানে হয়না। হোকনা মৌ তাকে ভালবাসেনা, তাকে প্রত্যাখান করবে। সে যে মৌকে ভালোবাসে এটা জানাতেতো কোন দোষ নেই। শুভ্র সাথে সাথেই মৌ এর সেই বান্ধবীকে ফোন দিল। সে এখন কোন কলেজে পড়ে তা জেনে নিল। জেনে নিল কলেজ কয়টায় ছুটি হয়।

শুভ্র একটি চিঠি আর এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আড়াই বছর আগে সে মৌকে দেখেছিল, কিছু বলতে পারেনি। আজ সে সব বলবে। বলতে তাকে হবেই। ঐ তো কলেজ ছুটি হয়েছে। অনেক মেয়ের ভীড়ে মৌকে খুঁজতে লাগল সে। কিন্তু না, মৌকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। আজব, কোথায় গেল মেয়েটা? আজ কী তবে সে কলেজে আসেনি? কলেজে না আসার মতো মেয়েতো সে না। তবে কি তার কোন অসুখ হয়েছে? অথবা তার বান্ধবী তাকে ভুল তথ্য দিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে প্রিয়মুখটিকে খুঁজে পেল শুভ্র। যেন ঘাসের মাঝে হারিয়ে যাওয়া হীরের আংটি খুঁজে পেল সে। মানসিক ভাবে প্রস্তুত হল শুভ্র। যা হবার হবে, আজ সে বলবেই। রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়ালো শুভ্র...চোখ তার মৌ এর উপর...বুক দুরুদুরু...কতদিন পর রাজকণ্যাকে দেখছে সে...

মৌ বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে কলেজ গেট দিয়ে বের হচ্ছিল। হঠাৎ টায়ারের তীব্র কর্কশ শব্দ শুনে চমকে উঠে তাকাতেই সে দেখল একটি ছেলে বিকৃত লাশ হয়ে পড়ে আছে রাস্তার উপর। ছেলেটির হাতে তখনো একটি রক্তাক্ত কাগজ আর তার পাশে রাস্তায় পড়ে আছে কিছু লাল গোলাপ। রক্তে সাদা গোলাপও যে লাল হয়ে যায়।
মৌ সেই বিকৃত লাশটিকে চিনতে পারেনি। সে রক্ত সহ্য করতে পারেনা তাই ঐ লাশের কাছেই সে যায়নি। মৌ কখনো জানতে পারেনি শুভ্র নামের একটি ছেলে তাকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভালোবেসেছিলো।


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১১ ভোর ৫:১৯
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×