somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে গল্পের কোন শিরোনাম নেই

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা গল্প লিখতে হবে।
কি লিখবো?
মানুষের জীবনের চেয়ে নিবিড় কোন গাঁথা কেউ কখনো লিখেছে কিনা, আমার জানা নেই। বাস্তবতার চেয়ে নিষ্ঠুর কোন ট্রাজেডি কোথাও পড়িনি আমি। হয়তোবা কমেডিও।

কবিতাদের কথা মনে পড়ে।

এক ভাই ২ বোন ছিলো ওরা। যে ফেব্রুয়ারীতে ওদের বাসার সাবলেটটা ছেড়ে আসি আমরা, তার আগের ডিসেম্বরেই আরো একটা বোন এলো ওদের ঘরে। সবচে বড় ছিলো ভাইটি, নাইম, ক্লাস সিক্সে উঠেছে মতিঝিল আইডিয়ালে। তারপর বিপ্লবী, স্কুলের জন্য কোচিং করতো। তারপর কবিতা, ঘরময় ছুটোছুটি করতো তার নতুন হাটতে-ছুটতে শেখার খুশিতে। তারপরে সেই নাম ভুলে যাওয়া পিচ্চিটি। সেই ফেব্রুয়ারীতেই, যখন বিডিআরের বিদ্রোহে গোটা শহর
থমথমে, ২৮ তারিখে বাসা ছাড়লাম আমরা। ঠিক তার পরের শনিবারেই ফোন এলো, মটরসাইকেলের ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে মাথায় পাওয়া সামান্য আঘাতের অসামান্যতায় সব ছেড়ে চলে গেছেন নাইম-বিপ্লবী-কবিতার বাবা।
ট্রাজেডির তখনও কেবল শুরু। আংকেল তার গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা-মা ভাই-বোনদেরও দেখাশুনা করতেন একাই।বাক-প্রতিবন্ধি ছোট ভাইটিকে পড়াশুনা করিয়ে চাকরীর সাথে সুন্দর একটা বউও জুটিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তার মৃত্যুর পরপরই সবাই কেমন বদলে গেল। সেই ভাইটি আর যেন এদের কাউকে চেনে না। আগের মাসে আঙ্কেল যে গাভীটি কিনেছিলেন বাড়িতে, সেটি বিক্রি হয়ে গেল। বিপ্লবী-কবিতারা কিছুই পেল না। মটর সাইকেল চালকের বিরুদ্ধে করা মামলাটিও আপষে ভেস্তে গেলো। কিন্তু নাইম-বিপ্লবীর পড়াশুনা কিংবা কবিতা আর তার ছোট্ট বোনটির বেড়ে ওঠা থেকে গেলো অনিশ্চিত। আন্টি অন্ধকার দেখছেন।
আঙ্কেলের একটা ছবিও ছিলো না ওদের কাছে।
আমার ফোনে কোন একসময় তোলা একটুকরো ছবি পৌছে দিতে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম শেষবার। আন্টির আহাজারি, নাইমের মাথা নিচু করে লুকোনো কান্না, বিপ্লবীর ভাষাহীন চোখ সব অগ্রাহ্য করেই ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
এখানে আমি নিজেও যে অনেক অসহায়।

গল্প লিখতে বসেছিলাম।
গল্প আমার আসে না।
কলম ধরলেই মনে পড়ে অতীতের মরচে ধরা আধছেঁড়া টুকরো স্মৃতি।
পার্থ কিংবা প্রদীপের মত কেউ না কেউ সবার জীবনেরই কমবেশি পরিচিত চরিত্র। ক্লাস নাইনে প্রদীপ বসে গেলো বাবার দোকানে। এসএসসি না দিয়ে পার্থ সেলস ম্যান বনে গেলো জ্যাঠার জুতোর দোকানে। যখন ছুটিতে বাসায় যেতাম, টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম সারাটা দিন, দেখা হলেই পার্থ চিৎকার জুড়তো "বন্দু, কেমন আচো..."। এখনো প্রদীপের দোকানে লুকিয়ে সিগারেট খাই। কেবল পার্থর ডাকটা আর শোনা হয়না। বছর পেরিয়ে গেছে, গলায় ফাঁস দিয়ে বেঁচেছে পাগলটা। চলে যাবার কদিন আগেও হঠাৎ ফোন দিয়ে বলেছিলো "বন্দু, সামনির অগ্রায়ন মাসে আমার বিয়ি(বিয়ে), তোমারে দাওয়াত দিবানি।" পার্থর বিয়ের দাওয়াত আর কোনদিন পাওয়া হবে না। যে শ্মশানে সন্ধ্যে-ভর আড্ডা দিতাম আমরা, সেখানেই পুড়েছিল ওর চিতা।

চারুকলায় পড়ার স্বপ্ন ছিলো রুবেলের। খুব ভালো আঁকতো, যদিও কপালে কোন টিচিং-কোচিং জুটেনি কখনোই। রুবেল এখন সেনাবাহিনীর সেপাই। ক্যান্টনমেণ্টে গিয়েছিলাম একবার, দেখা করতে। দেখা হয়েছিলো। সিএমএইচের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো, ডিউটিতে। এখন দেখা হয় এলাকায়, যখন দু'জনের ছুটিতে ছুটিতে মিলে।
আর আমার সেই ছেলেটি (নাম বলছি না), মা'র মৃত্যুর পর বাবা বিয়ে করে আগাগোড়া বদলে যাওয়ায় পার্টটাইম কাজ করে এখন পড়াশুনা চালাচ্ছে।
আর মঞ্জুর(ডাক নাম নয়), আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুটি, যার বড়ভাই প্রাবাসে পলাতক, অবৈধ অভিবাসী। বাবা রিটায়ার্ড। স্বজনরা দিনে দিনে দুর্জন হয়ে পড়ছে। ডায়বেটিস আর হাইপারটেনশনের দাপটে পানি জমা যকৃত, হৃৎপিন্ডের বিকলপ্রায় বাল্ব আর দুর্বল কিডনী নিয়ে কোন এক সরকারী মেডিকেলে ভর্তি বাবার পাশে বসে আছে এখন। অথচ চেহারায় চিন্তার ছাপ নেই, কন্ঠস্বরে ভীতি নেই। হাসতে হসতে আগের মতই বলে চলছে, "টেনশন নিচ্ছিস কেন ইয়ার..."

জানি, কারো জীবনই থেমে থাকবে না, যেমন থাকছে না, থাকেওনি কখনও। পার্থর মত হঠাৎ ফুরিয়ে যাবে নয়তো ছুটে চলবে.. কখনো সামনে, কখনো পিছনে। নিয়ম করে নাইম-বিপ্লবী-কবিতারা বড় হতে থাকবে। যদিও কোন সন্ধ্যেতেই আর কোনদিনও কলিংবেলের শব্দে দরজায় ছুটে যাবে না ওরা। প্রদীপ-রা ভুড়িদার গৃহস্থ হয়ে যাবে। পার্থদের চিতাভস্ম ধুয়ে দেবে কপোতক্ষ। সংকটাপন্ন বাবার বিছানার পাশ থেকে মঞ্জুর ফোন দেবে "দোস্ত, খাওয়া দাওয়া করছিস তো ঠিকমতো?"

তারপর একদিন, কেউ আর কাউকে চিনবো না, মনে রাখবো না।

মানুষ নিজেই জানেনা সে কি চায়। অথবা কোন প্রাপ্তিই তাকে পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারে না। কিংবা প্রাপ্তিই প্রত্যাশাকে বহুঘাতে বাড়িয়ে তোলে। সবচে ভালো থাকা মানুষগুলোও তাই অনেক দুঃখে থাকে প্রায়ই। আর শেষমেশ কেউই ভালো থাকি না আর।

সত্যিই, জীবনের চেয়ে বড় আর কোন কৌতুক নেই, হতে পারে না।


[বছর দুই আগে বিপ্লবীদের বাসায় গিয়েছিলাম। কবিতা আর আমাকে চেনেনা। আঙ্কেলের মৃত্যুর পর আন্টির একটা চাকরি হয়েছে একই অফিসে। সেই সুবাদে সরকারী বাসাটা আর ছাড়তে হয় নি। নাইম এবার এসএসসি দিয়েছে বা দেবে।
প্রদীপের ব্যবসা জমজমাট, আমাদের তুখোড় আড্ডার তুমুল আশ্রয় প্রদীপের ছোট্ট দোকান।
রুবেল মেডিকেল-কোরে আছে। সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় কাজের ক্ষেত্রটা বদলে নিতে পেরেছে।
মঞ্জুরের বাবা বাঁচেন নি। এই লেখাটা লিখবার রাতেও আমি যে কি প্রচন্ড কেঁদেছিলাম, আঙ্কেলের জন্য নয়, আমার অতি-সরল বন্ধুটির ভবিষ্যত আশঙ্কায়। ছেলেটা এখন একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে আছে, দুদ্দাড় প্রোগ্রামিং করে বেড়াচ্ছে। পুরোপুরি কাটিয়ে না উঠলেও, অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে সব আশঙ্কা থেকে।
জীবন থেমে থাকে নি। জীবন কখনো থেমে থাকে না। এক সময়ের প্রতিটা বিধ্বস্ত মানুষ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, প্রত্যেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ভালো আছে ওরা, তুলনামুলক, তবুও।
আমি জানি,
আরো, আরো ভালো থাকবে, প্রত্যেকে ওরা :)
অনীক, ১৮/০৪/২০১৩ ]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ ভোর ৬:০২
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×