somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরোজ স্যার ও আমাদের অনিল কাপুর

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার সেই বন্ধুটির নাম জানানো যাবে না, নিষেধ আছে। তার কর্মস্থল বাগেরহাটের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ। পশুর নদীর কোলে ছোট্ট একটা গ্রামে তাদের ফাঁড়িটি। ওপাশেই সুন্দরবন। প্রথম প্রথম যখন গিয়েছিল রাত-বিরাতে বাঘের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যেত। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। তার ভয় কিন্তু বাঘ-ভাল্লুকে নয়, এর চেয়েও ভয়ংকর ভয়ংকর জিনিস আছে সেখানে। মেট্রোপলিটন সিটির সুরক্ষিত খাঁচায় আমরা যারা বাস করি, বাগেরহাটের সেই ইউনিয়নটির অবস্থা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। তারপরও বলি, নদীর ওপাশে বন, বনে বনদস্যু; নদী চলে গেছে বঙ্গোপসাগর, সাগরে জলদস্যু, নদী ধরে তারা প্রায় চলে আসে উজানে; ডাঙায় চরমপন্থী; বছর দুয়েক হয় দেখা দিয়েছে জেএমবি’র আনাগোনা। এভাবেই চতুর্মুখী চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় তাকে।
নাহ, ব্যাপারটা আসলে উল্টো, কোন চাপের মধ্যেই নেই সে। সে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছে। তার ফাঁড়ি এলাকার সীমানা শহরের মাঝারি সাইজের একটা থানার সমান। পশ্চিমে দেড় মাইল, পূর্বে দু’মাইল, উত্তর-দক্ষিনে দু'থেকে আড়াই মাইল। এর মধ্যে আছে পশুর নদীর অনেকটা এলাকা। এ বিশাল এলাকা তাকে পাহারা দিতে হয়। তার ফাঁড়িতে আনসার-পুলিশ মিলে আছে দশজন। প্রতিদিন দুয়েকজন ছুটিতে থাকে। রাতে দুটি দল করে পাহারায় বের হয় তারা। বড়ো ধরণের কোন ডাকাতির খবর পেলে তারা যায় না, যায় না চরমপন্থীরা কোথাও এসেছে শুনলেও। তাদের ভয় প্রাণের চেয়ে অস্ত্রের বেশি। উপরমহল থেকে তাদের সেরকমই ইনস্ট্রাকশন দেয়া আছে। তাই বড়ো ধরণের কোন ঘটনা ঘটলে তাকে খুব একটা জবাবদিহি করতে হয় না। এ জন্যই বললাম, সে আছে অনেকটা চাপমুক্ত, অনেকটা নির্বিঘœ। ত্রিশ টাকা কেজির পাবদা মাছ আর দশ টাকা কেজির শিম খেয়ে তার চেহারা অনেকটা অনিল কাপূরের মতো হয়ে গেছে।
অনিল কাপূর ঈদে ছুটি পায় না। তাই ঈদের মাসখানেক আগেই বাড়ি এসে ঘুরে যায়। বন্ধুদের আড্ডায় আসে। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের দু’জন ‘ভাগ্যবান চাকরি বিজয়ী’র একজন সে। তাকে দেখে অন্যরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আমাদের মুক্তবিহঙ্গের মতো ওড়াওড়ি দেখে। আমার পত্রিকায় চাকরি হয়েছে শুনে ও মহাখুশী। পিঠ চাপড়ে বলল, তোদের তো মন্ত্রী-মিনিস্টারের পাওয়ার। লেগে থাক, অনেক দূর যেতে পারবি। আমার অবশ্য লেগে থাকা হয় না। তার আশাবাদের মাস না যেতেই মাথা গরম করে চাকরিটা ছেড়ে দেই।
সেদিন আড্ডায় সে তার কষ্টের কথাগুলো বলছিলো: এতো লিমিটেশনের মাঝে কি করে পাবলিককে সার্ভিস দেই! মানুষ আমাদেরকে নিয়ে এতো আশা করে, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি না, মাঝে মাঝে তাই নিজেকে বড়ো হীনজ্ঞান হয়। এসব বলতে বলতে তার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছিল। কথা আর চায়ে রাত সাড়ে ৯টা। সবাই নড়েচড়ে উঠল, বাড়ি ফিরতে হবে। আমাদের অনিল কাপূর ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলে, দোস্ তোরা দোয়া করিস, সামনে বড়ো কঠিন দিন, যেন সহিসালামতে ফিরে আসতে পারি। কিসের কঠিন দিনরে? তার এক শব্দে উত্তর, নির্বাচন।
সবাই যখন ঈদের জুতো-জামা কিনতে ব্যস্ত, বাজারে তেল-সেমাইয়ের দাম নিয়ে হাহুতাশরত, তখন আমাদের অনিল কাপুর বাসে কাঁঠাল-ঠাসা হয়ে ঢাকা যায়। অনিল কাপূরের ফাঁড়ির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় সব ফাঁড়ি গুটিয়ে পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। ক্ষমতার রদবদল হবে। দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের পাহারা দিতে হবে। সেবাই ধর্ম। তাই ধর্ম পালনে যাও ঢাকা। পশুরের কোলের সেই গ্রামটা, পশুরে মাছ ধরে যে মাঝিটা অরক্ষিত থাক, তাতে কিছু যায় আসে না।
তারপর তো ফিলমের নায়কের মতো ঘন ঘন তার মুখ দেখা যায় টিভির পর্দায়। কখনো সে গজারি গাছের লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরোধীদলের নেতা কর্মীদের ওপর, কখনো তারকাঁটার ব্যারিকেডের ওপারে দাঁড়িয়ে ধ্বস্তাধস্তি করে, কখনো লেজ গুটানো বিড়ালের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে দু’দলের মারামারি দেখে। আমরা টিভিতে অনিল কাপূরকে দেখি। উৎকণ্ঠায় আমাদের বুকটা ধড়ফড় করে। অনিল কাপুর তুই সাবধানে থাকিস।
অনিল কাপুরের সঙ্গে কথা হয় মোবাইলে।
ফিরোজ স্যারের কথা মনে আছে তোর, ওই যে আমরা ক্লাস এইটে থাকতে হুট করে চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন ...
ও হ্যাঁ!
কেন চাকরি ছেড়েছিলেন তিনি, জানিস?
না তো। আর ওসব খবর তো তুই-ই বেশি রাখতিস।
আমাদের কেউ জানে না। আমিও জানতাম না। সেদিন জানলাম। স্যারকে নিয়ে সেভেনের বিকাশ একটা বাজে ছড়া লিখে ক্লাসের দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছিল। সেটা স্যারের চোখে পড়ে। স্যার কোন কথা না বলে পরের দিন চাকরি থেকে রিজাইন দেন। স্যাররা অনেক চাপাচাপি করেছিলেন কেন তিনি চাকরি ছাড়ছেন জানতে। তিনি কিছু বলেননি। তাই কেউ জানেনি কেন তিনি চাকরি ছাড়লেন। ১১ বছর পর আমি সেই রহস্যের কূল খুঁজে পেয়েছি।
তাই নাকি।
হুঁ। অনেকদিন পর গত বছর তার সঙ্গে আবার দেখা হলো আমার। সে ঘটনার পর তিনি আর শিক্ষকতায় ফেরেননি। এখন একটা সরকারি ব্যাংকে আছেন। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। আমাকে দেখে চিনতে পারেননি। আমি যখন পরিচয় দিলাম, তিনি মাথায় হাত রেখে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। জিগগেস করলাম, স্যার স্কুলের চাকরিটা ছাড়লেন কেন?
স্যার বললেন, শিক্ষকের সবচেয়ে বড়ো জিনিস হলো সম্মান। অর্থবিত্ত তো কম বেশি সবাই করতে পারে। কিন্তু সম্মান সেটা সবার কপালে জোটে না। এটার আশায় মানুষ শিক্ষকতা করে। সেটাই যদি না থাকল শুধুশুধু গলগ্রহ হয়ে লাভটা কি। তিনি একনাগাড়ে বলে গেলেন। আমি বল্লাম, স্যার তাই বলে কি মন্দ লোকের কথা শুনে চাকরি ছেড়ে দেবেন, তা কি মেনে নেয়া যায়। তিনি শুধু বললেন, মন্দ ছেলেটাও তো আমার ছাত্র ছিল। ওকে তো আমি ভালো করতে পারিনি।
শুনে খুব খারাপ লাগছে রে দোস।
আমার জানিস এখন কেবল ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। বঙ্গভবনের সামনে দাঁড়াই, প্রেসিডেন্ট স্যারের গাড়ি যায়, ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। মুক্তাঙ্গনে দাঁড়াই, দুপাশে দু’দলের বক্তৃত্বা চলে, আবার ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। জয়কালি মন্দির রোডে দাঁড়িয়ে থাকি, ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা, কোলাহলে চারদিক নরক গুলজার, এর মাঝে ফিরোজ স্যারের কথা মনে পড়ে। ইস, সব শিক্ষকের যদি ফিরোজ স্যারের মতো আত্মসম্মানবোধ থাকত!
মোবাইলে সব কথা বলা যায় না। টিভি খুললেই অনিলকে দেখা যায়। আমারা যখন ফার্স্ট ইয়ার-সেকেন্ড ইয়ারে, দুপুর দুটার পর জার্নালিজমের আতিক স্যার আসতেন হায়দারের দোকানে, দরাজ কণ্ঠে গাইতেন একটার পর একটা গান। তার একটা গান প্রায় গুনগুনিয়ে গাইতো অনিল।

... আমি নাইরে
আমার আমি নাই।
ছেড়া পলিথিনের মতো
উড়ি বাতাসে
বাদামের খোসার মতো
ঘুরি পার্কে পার্কে....
... কে আমারে খেয়ে দেয়ে
ফেলে রেখেছে ...
আমার আমি নাইরে
আমার আমি নাই।

টিভিতে দেখি, আমাদের অনিল পলিথিনের ঠোঙার মতো কখনো ডেমরায়, কখনো মুক্তাঙ্গনে, কখনো গণভবনের হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে। গায়ে বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট, মাথায় লোহার টুপি, তাই তার চেহারাটা দেখা যায় না। সেকি দাঁড়িয়ে এখন ফিরোজ স্যারের কথাই ভাবছে?
৫ ডিসেম্বর ২০০৬, দৈনিক আজাদী
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭



অনেক দিন পর আমি আজ এই হোটেলে নাস্তা করেছি। খুব তৃপ্তি করে নাস্তা করেছি। এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা। ঠিকনা: ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডম ভবেরচর, গজারিয়া, মন্সীগঞ্জ। দুইটি তুন্দুল রুটি আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×