ভজন সরকার
আবারও আমার সেই বন্ধুটির টেলিফোন , কানাডায় তার ভাগ্যে কি আছে তা জানার জন্যে অতি উৎসাহী । ব্যাকুল বন্ধুর আকুল জিজ্ঞাসা,‘‘ তুই না সেদিন বললি আমি অনেক কিছুই হইতে পারবো । সে সম্বন্ধে কিছু বল না শুনি ?’’
আমার এই মহাঘাউরা বন্ধুটি যে কিনা সুক্ষ্ণ যুক্তির নিক্তিতে পরখ করে তবেই সব কিছু বিশ্বাস করতো একদিন , সে আমার এই ব্যঙ্গোক্তিটিকে বিশ্বাস করছে দেইখ্যা আমি এক তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । বললাম ,‘ পারবি বন্ধু, সবই হইতে পারবি । এই দেখ না আমি লেখক হইছি । অনেকে কবি হইছে । আর আমার মত অনেকেই বছরে এক হালি করে বই ছাপাইয়া ফেলতাছে । আর তোর শ্বশুর বাড়ি যখন সংবাদপত্র অফিসের আশে পাশে , তখন সাংবাদিকতার বাতাস একটু হইলেও গায়ে লাগছে । ওই বাতাসটারে সুগন্ধি মাখাইয়া নিয়া আসবি । এখানে এসেই সাংবাদিক না হইলে, পত্রিকার সম্পাদক হইয়া যাবি ।’’
আমার মহাযুক্তিবাদী বন্ধুটি ‘ধ্যুৎ তাই কি হয় ’ বললেও মনে হইলো কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখলো । কণ্ঠে একটা গদগদ ভাব নিয়া কইলো,‘ তুই না এক সময় কইছোস যে, তুই ই- ম্যাগাজিনে লিখস । ওইটা আবার কি ?’’
‘ ই-ই হউক , আর ঈ-ই হোক , সেইট্যা তোর বড় বিষয় না । বিষয়টা হইলো তুই কি হইছোস সেইটা।’, আমি কইলাম ।
দরিদ্র মানুষের পক্ষে আজীবন লড়ে যাওয়া আমার বন্ধুটি নিজে দরিদ্র হওয়ার ভয়ে মহা ভাবনায় পড়ছে বুঝতে পারলাম ।
বললাম,‘ তুই তো পেটের চিন্তা করতাছিস, পেট চালাইবো মামু । মামু বাড়ি থাকবি । খাওন পড়ন সব পাবি । হাতে অফুরন্ত অবসর । খালি প্রতিভা বিকাশে ব্যস্ত থাকবি । আর বৌয়ের কথা চিন্তা করণের কোন দরকার নাই । আত্মীয় স্বজন যখন আছে পর-নিন্দা পরচর্চা কইরা সময় মহা আমুদে কেটে যাব। আর ভাবীর তো একটু গানবাজনার অভ্যেসও ছিলো । উনার জন্যে কানাডা তো অতি উর্ব্বর ভূমি । গান গাইতে গাইতে কাহিল হইবো কিন্তু শ্রোতারা কইবো‘ওয়ান মোর’ । আর বছর বছর দেশে গিয়া একখানা সিডি বাইর করতে পারবো । ফলটা কি দাঁড়াইলো ? প্রবাস জীবনের এক বছরের মধ্যেই সৃষ্টিশীলতায় জ্বলজ্বলে এক তারকা দম্পতি ।’’
আজীবন রাজনীতি করা আমার বন্ধুটির নিজের এইসব সম্ভাবনার কথা খুউব একটা মনে ধরলো বইল্যা ঠাউওর করা গেল না । আড়ে ঠাড়ে খালি রাজনীতির কথা জিগায় । আমি কইলাম ,‘ কানাডার রাজনীতিতে নিজে কতটুকু সুবিধে করতে পারবি সেটা বলা মুস্কিল । তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘দাদাভাই’ না হইলেও‘ মিয়াভাই‘ হইতে পারবি সেটা এক শত ভাগ নিশ্চিত ।’’
বন্ধুটির পায়ের তলায় একটু কাঁদামাটি পড়ছে বইল্যা মনে হইলো এইবার । খরগোশের মত কান খাড়া কইরা আমার কথা শুনছে । আমি বললাম ,‘ তুই তো গাঁয়ের পোলা । বটতলায় যখন কেউ চুল কাটতে বসে , আশে পাশে যে রকম বিজ্ঞ মানুষের ভিড় সেই রকম এখানেও কোন দাওয়াতে কিংবা সমাবেশে যাবি , দেখবি আশে পাশে কত রাজনৈতিক পন্ডিত । বাংলাদেশে হেনো রাজনীতি নাই যে তেনারা করেন নাই । আর হেনো নেতা নাই তেনাদের সাথে খাতির নাই । মনে মনে ভাববি প্রধানমন্ত্রী এই ‘জিনিস’টারে কেনো এতদিন চেনেন নাই , সেই ব্যাপারে তীব্র আফসোস ! শুধু একজন হইলে কথা আছিল । এই রকম গন্ডায় গন্ডায় ,ডজনে ডজনে পাবি । আর সে তুলনায় তুই তো আসল জিনিস । লেঃজেঃ হোঃমোঃ এরশাদের ঠোলায় তোরে চিনছে , আর এই সব প্রবাসী রাজনীতিবিদেরা তো নস্যি । আমার কেনো জানি মনে হয় , তোর জন্যে এই মাঠটা এখনো খালি পইড়্যা আছে , বন্ধু । কত দিন থাকে সেইটাই কথা । সময় নষ্ট করণ ঠিক হইবো না !’’
বন্ধুটি ‘ইউরেকা ’ বইল্যা প্রকাশ্যে চিৎকার না দিলেও মনে মনে বঙ্কিম উল্লাসে পুলকিত হইছে এইটা সহজেই বোঝন গেলো । আমি তার দ্বিধার ঘরে আরেকটা পেরেক ঠোকার জন্যে বললাম ,‘ আরেকটা সম্ভাবনা ছিলো আজ থেকে দশ বছর আগে ,আমি যখন আসি তখন । তখন ভাবছিলাম , লোক বাড়বো ,সমস্যা বাড়বো ,হতাশাও বাড়বো । লোক জন অদৃষ্টে-অদৃশ্যে বিশ্বাসী হইয়া ধর্মকর্ম আকড়াইয়া ধরবো। ফলে ধর্মস্থান বাড়বো হু হু কইরা । তারপর ধর বাঙ্গালী যখন, নানা কুতুবের আগমন ,দলাদলি , কলহ বিবাদ তো আছেই । ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও গজাইয়া যাইবো গন্ডায় গন্ডায় । তাই এই লাইনে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সেইটা বুঝতে পারছিলাম । কিন্তু এখন সেই শূন্য স্থানটা পূরণ হইয়া গেছে মনে হয় । আর জীবনের শেষ চিকিৎসার মত শেষ উপদেশ একটা আছে ,সেইটাও বইল্যা ফেলি । আজকেও সময় বেশী নাই । দৌঁড়ের সময় হইয়া গ্যাছে এখনি কাজে যাইতে হইবো । ’
বন্ধুটি একটু ধান্ধায় পড়ছে মনে হইলো কাজে যাইতে হইবো শুনে । আমি কইলাম ,‘ এখানে সবাই কাজে যায় । ছাত্রজীবনে আকাশ ভাই অর্থ্যাৎ কমরেড অধ্যাপক এম,এম, আকাশের শ্রেনীতত্ত্ব ক্লাশের কথা মনে নাই ? কানাডা আইস্যা ভাববি, তখন থিউরি ক্লাশ করছিলাম আর এখন সেইটার প্র্যাকটিক্যাল করতাছি । সেটা মনে না থাকলেও কোন ক্ষতি নাই । মাধ্যমিক পরীক্ষায় শ্রমের মর্যাদা রচনা মুখস্থ কইরা পাশ করছিলি কিন্তু সেইটার ব্যবহারিক পরীক্ষা বাকী ছিলো মনে কইরা কাজ চালাইয়া যাবি ।’
এইবার বন্ধুটির ঘাউরামির পুরানো রোগ আবার দেখা দিলো বইল্যা মনে হইলো । হঠাৎ টেলিফোনের ওপার থেকে হতাশা আর ক্ষোভ মিশিয়ে খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় বইল্যা উঠলো,‘ এইবার বুজছি । বৌয়ের ইজ্জত বাঁচাইতে গিয়া নিজের ইজ্জত খোয়াইতে হইবো । খ্যাতা পুড়ি তোর কানাডায় যাওয়া । হ্যালায় যুদ্ধেই যামু না ।’
টেলিফোন লাইনটা কেটে গিয়ে এক বিরক্তিকর একঘেয়ে শব্দ শ্রবনেন্দ্রিয় বেয়ে হৃদয়ের গভীরে ঢুকে গেলো । তার সাথে যোগ হলো চারদিকের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা । এক ফালি মেঘ কোথা থেকে যেন নেমে আসলো আমার দুই চোখে । এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে মুখে পরতেই এক নোনতা বিস্বাদে ছুঁয়ে গেলো মনে । এটা কী কান্না না, বৃষ্টি ? সেটাও বোঝা গেলো না। কারণ, আমি এখন বিভূঁই বিদেশে যুদ্ধরত এক সৈনিক । আমার তো ফেরার আর কোন পথ নেই । সময় নেই চোখের জল ফেলবারও । এখন সময় শুধু সামনে যাওয়ার !
Click This Link