somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুমি ভালো নেই দেখে মন ভরে যায়

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আশালতা রায়কে আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে। আশালতা রায়! ও, ও আমার বন্ধু ছিল। না না, বন্ধু ঠিক নয়। আমি ওকে বন্ধুবেসে ছিলাম। এটাকে ঠিক ভালবাসা বলে কী না, তা আমার জানা নেই।
আশালতার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বাসে। গেল বসন্তে। ও আমাকে চিনতে পেরেছিল কী না সে প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তবে আমি কিন্তু তাকে ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছিলাম। আশালতার সেই হাত! যে হাতের তর্জনীতে একদিন পরম মমতায় পরিয়ে দিয়েছিলাম সোনার অঙ্গুরী। ক্ষয়ে গেছে, তারপরও সেই অঙ্গুরী আশালতা এখনও তর্জনীতে পড়ে আছে। ভারী সুন্দর লেগেছিল সেদিন আশালতাকে। আগে তাকে এমন সুন্দর মনে হয়েছিল কী-না, তা অনেকদিন আগের কথা। কত আগের কথা, তা আজ আর মনে পড়েনা।
বাসে আশালতাকে দেখে আমি নির্বাক দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কী দোষ। ও যে দিনে দিনে এতো সুন্দরী হয়ে উঠবে তা কী আমি জানতাম না কি! বন্ধুকালেও মাঝে মাঝে এমন হতো। ওর কণ্ঠস্বরের আমি ভীষণ ভক্ত ছিলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে ফোনে ওর কথা শুনতাম। আশালতা হ্যালো বললেই মনের ভেতর কেমন একটা প্রশান্তির ছায়া এসে ভর করতো আমার। আশালতাও আমার খুব ভক্ত ছিল। এটা অবশ্য আশালতার বলা কথা। তবে আমি বিশ্বাস করেছিলাম ঢের। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি দারুণ লাগতো। আমি তখন রেডিও স্টেশনে। প্রতিরাতেই নিশি জেগে রেডিওতে আশালতা আমার আবৃত্তি শুনতো। আর আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করে একটু থেমে থাকলেই অমনি ও ফোন করে বসতো আমায়। কী যে দুষ্টু ছিল না ও! তবে ওর দুষ্টুমিটাই কিন্তু আমার খুব ভালো লাগতো।
ক্যাম্পাসে মাত্র দুই টাকার বাদামের জন্য ও যা জেদ ধরতো না! আজ তা ভাবলেই অবাক লাগে। দু’টাকার বাদাম যখন ওর হাতে তুলে দিতাম তখন আশালতার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠতো। ভারী মায়াবী মনে হতো তখন আশালতাকে। মনে হতো, আশালতা যেনো মায়া দিয়েই গড়া এক মেয়ে। আশালতা কিন্তু ক্যাম্পাসে অনেক সুন্দরী মেয়ে ছিল। এজন্য সবাই আমাকে ঈর্ষা করতো। আবার সুবিধাও হয়েছিল একটা। সেটা হলো, আশালতার কারণে ক্যাম্পাসের সবাই আমাকে এক নামে চিনত। আমি কখনো ক্লাস থেকে নিচে নেমে এসে দেখতাম ও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার ভবনের সামনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। আর এটা দেখে আমার বন্ধুরা খুব তোড়জোড় করতো, যে আমিও যেনো পরের ক্লাসগুলো ফাঁকি দিই। মাঝে মাঝে বন্ধুরা আমাকে আশালতার সঙ্গে ঘুরতে পাঠিয়ে দিয়ে তারা নিজেরাই ক্লাসে আমার হাজিরা খাতায় রোল নম্বরটা লিখে দিতো। বন্ধুরা যে আশালতার সঙ্গে আমাকে ঘুরতে দেখে কী আনন্দ পেতো তা আজও জানা হয়নি আমার। তবে আশালতা চলে যাওয়ায় আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি বোধ করি আমার বন্ধুরা তারও বেশি কষ্ট পেয়েছিল। এখন থাক সেসব কথা।
আশালতা সত্যি সত্যি খুব ভালোবাসতো আমায়। নইলে নিজের জীবন বাজী রেখে কী সেদিন আমায় গুলির হাত থেকে বাঁচাতে পারতো! শহীদুল্লাহ ভবনের দ্বিতীয় তলায়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমাকে জাপটে ধরে শুয়ে পড়েছিল বারান্দার মেঝেতে। খানিকবাদেই আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ্য করে পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি ঠিক আমার মাথার পাশে দেওয়ালে এসে বিঁধে গেল। সেদিন আশালতা কী বাঁচাটাই না বাঁচিয়েছিল আমাকে। উফফ্, ভাবলে এখনো গা শিরশির করে ওঠে।
এভাবেই হাতে হাত রেখে চলতে লাগল দিন। ঠিক বন্ধু কিংবা ভালবাসা নয় এটা। এটার নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আমাদের সংসার’। কারণ, আশালতা তার নিজেকেই সপে দিয়েছিল আমার কাছে।
ক্যাম্পাস জীবনের শেষের দিকেই হবে হয়তো। ঠিক যখন আমাদের ক্যাম্পাসের বাইরের জগতে এসে সংসার সাজাবার কথা। তখনি কী নিয়ে যেনো ক্যাম্পাসে দারুণ এক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে গেলো। শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে এলো সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচার। তত্ক্ষনাত্ বন্ধ হয়ে গেলো ভার্সিটি। হাজারো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে ফেলি আশালতাকে। ফোনেও যোগাযোগ করে পাচ্ছি না তাকে। অবশেষে সবাই চলে গেলো নিরাপদ স্থানে। শুধু আমি ছাড়া। আমিতো আশালতাকে না নিয়ে যেতে পারি না! চরম বিপদের মধ্যে দিয়ে একটি রাত কাটলো হাজারো ভয়ঙ্কর রাতের কল্পনা নিয়ে। সেনাবাহিনীর বুটের শব্দে একটি ভয়ঙ্কর রাত ভোর হয়ে আসে। শুরু হয় আবারও উন্মাদনা। খানিক পরে জানতে পারি আশালতা তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ভালোই আছে। স্বস্তি পাই মনে।
নিভন্ত দুপুর বেলা। কারফিউ কেবল শিথিল হয়ে এসেছে। এবারে আশালতা ও আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সঙ্গে জুটলো আশালতার এক বান্ধবী। গিনি তার নাম। কিন্তু পকেটে আমার ফুটো পয়সাটাও আর অবশিষ্ট নেই। তারপরও আশালতার হাত ধরে কখনো দৌড়াতে দৌড়াতে কখনোবা বাসের চালককে অনুরোধ করে যখন আশালতার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা বাজে। হুট করে বাস চালক গোঁ ধরে বসলেন। সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন এতো রাতে এখান থেকে গাড়ি আর যাবে না। কী আর করা! বাধ্য হয়ে অপরিচিত এক বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানোর আবদার করে বসলাম। কী মনে করে রাজিও হয়ে গেলেন ওই বাড়ির কর্তা। রাত কেটে ভোর হলো। ভোরে উঠেই রওনা হলাম আমার বাড়ির দিকে। তখন আশালতার দুচোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা দেখেছিলাম। কষ্ট লেগেছিল খুব।
এবারে শুধু গিনি আর আমি। কিছুদুর যাওয়ার পর পকেট হাতড়িয়ে দেখি বেশ কিছু টাকা। মোবাইল বের করে দেখি আশালতার একটি বার্তা। তাতে লেখা-‘কিছু টাকা তোমার পকেটে গুজে দিয়েছি। পথে কিছু খেয়ে নিও। ভালো থেকো আজীবন। পারলে মনে রেখো।’ বার্তাটি পড়ে আমিও চোখের জলকে আর বাধা দিতে পারি নি। মনে হয়েছিল-এতো কেন ভালবাসে আশালতা আমাকে!
এরপর আর আশালতার সঙ্গে আমার ভালো করে কোনো দিন কথা হয়নি। তবে দেখা হয়েছিল একদিন। ক্যাম্পাসে। শুনেছি ও ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক চিকিত্সককে বিয়ে করেছে। ও আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। আশালতাকে সুন্দর দেখতে আমার ভালো লেগেছিল সেদিন। কিন্তু কেন যেন আমার নিজের চোখের জলের ভাষাগুলো বড্ড অপরিচিত মনে হয়েছিল সেদিন। আজও তা জানতে পারি নি। আর আশালতার চোখে সেদিন দেখেছিলাম ভয় আর কষ্টের অপরিচিত অথচ অপূর্ব এক রূপ। এরপর আশালতাকে আর দেখিনি। মানে আশালতাই আসেনি বলেই হয়তো দেখিনি। কিন্তু প্রতিরাতেই আমি আশালতার সঙ্গে কথা কই। ও হাসে। আচ্ছা, আশালতারও কী এমন হয়? খুব জানতে ইচ্ছে করে, একদিন নিজের কানে শুনবো ও কেমন আছে?
তারপর....তারপর দীর্ঘ কয়েক বসন্ত পর গেল বার বাসে তার সঙ্গে দেখা। তাকে দেখে কেমন কেঁপে উঠেছিল শরীর। কথা হয়নি। চোখাচোখি মাত্র। কিন্তু তার চোখের নিচের কালি বলে দিয়েছিল যে, সে ভালো নেই। এরপর আসলে কেউ ভালো থাকতে পারে না।
দীর্ঘ কয়েক বছর পর সেদিন অমিত এসেছিল আমার কাছে। কয়েক ঘন্টা গল্প করেছিল। সারা ঘর সিগারেটের ধোয়ায় ধূসর করে দিয়ে তার জীবনের এই গল্পটিই আমাকে শুনিয়েছিল আর অঝোর ধারায় কাঁদছিল। আমি সেদিন অমিতকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারিনি। ও অনেক বেশি বদলে গেছে। ক্যাম্পাসের মেধাবী ছেলেটি এখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। তবে কবিতা তাকে ছাড়েনি। একটি পত্রিকা অফিসে অন্যের কবিতা ছাপানোর জন্য বাছাই করে অমিত। মানে কেরানীগিরি করে। তবে যাই হোক, অমিতের কষ্টটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঠিকই।
আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে একটি চিরকুটে কোনো এক কবির কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে গিয়েছিল অমিত —
‘বহুদিন পরে দেখা এক ডালিয়ায়
আশা করি ভালো আছ আশালতা রায়,
এ জগত্ নির্দয়- তাই ভালো থাকা দায়
তুমি ভালো নেই জেনে
মন ভরে যায়।’


আমার আজও জানা হয়নি আশালতার ভালো না থাকায় কেন অমিতের মন ভরে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩২
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×