গ্রেট ওয়াল অব ইন্ডিয়া টিকবে না
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিদ্যাপীঠ সারা বিশ্বের মেধাবীদের তীর্থক্ষেত্র। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিচ্ছেন বিদিশা ব্যানার্জি। ইয়েল স্কুল অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজের এই শিক্ষার্থী সমপ্রতি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিদর্শন করেন।
তিনি অবাক হন। তার চোখে ‘কাঁটাতারের বেড়া’ হলো ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব ইন্ডিয়া’। এই ‘মহাপ্রাচীর’ ভবিষ্যতের লাখ লাখ বাঙালি জলবায়ু উদ্বাস্তুর জীবনে কি প্রভাব ফেলতে পারে সেটাই বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। অনলাইন ম্যাগাজিন ‘স্লেট’ (ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউজ উইকের মালিকানাধীন) গতকাল তা প্রকাশ করেছে। এখানে তা অনূদিত হলো-
সুতিয়া ভারতে। ধান্যকুল্লা এলাকাটি বাংলাদেশে। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। আট ফুট উঁচু। জোড়া প্রাচীর। কিন্তু গত সপ্তাহে আমি যদি সুতিয়া থেকে ধান্যকুল্লায় যেতে চাইতাম তাহলে আমাকে কাঁটাতারের প্রাচীর টপকাতে হতো না। আমি এক বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর বাগানের ভেতর দিয়ে সহজেই ধান্যকুল্লায় যেতে পারতাম। আমি যাইনি। তবে আমার চোখের সামনেই একটি মোরগ দু’দেশের প্রাচীর অবলীলায় পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ১
পেরিয়ে গেল। মধ্য আশির দশকে দিল্লি বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং কাজও শুরু করে দেয়। ২৫৪৪ মাইল দীর্ঘ দু’দেশের সীমান্ত। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়া দিয়ে ফেলেছে। আরও ৬২১ মাইল আছে পরিবর্তনশীল নদী সীমান্ত।
উভয় সরকার ১৫০ গজ করে উভয় দিকে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ রেখেছে। এর ফলে কোন বাড়ির সামনের দিক পড়েছে হয়তো এক দেশে। একই বাড়ির পেছনের অংশ পড়েছে অন্য দেশে। এমন ধরনের বেড়া, যার অংশত উন্মুক্ত, অংশত সেনা প্রহারাধীন- সেটাই আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের আয়না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই উপমহাদেশের মানুষ কখনও আন্তর্জাতিক সীমান্ত দেখেনি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ভারতের দ্বারা ভাগ করা নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বলেছিলেন ‘পোকায় খাওয়া।’
সমুদ্র সন্নিহিত বাংলাদেশের ৮০ ভাগ জমিই ঘনবসতিপূর্ণ। আর এই দেশটি প্রায়ই জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় ‘গ্রাউন্ড জিরো’ হিসেবে গণ্য হয়ে চলেছে। সমুদ্র উচ্চতা এক মিটার বাড়লে দেশটির এক-পঞ্চমাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। এ সর্বনাশ এ শতাব্দীর শেষের দিকে ঘটতে পারে বলেই আশঙ্কা করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে নাজুক উপকূলীয় জেলাগুলোর অন্যতম খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অবস্থান ভারত সীমান্ত ঘেঁষে।
ভারত বলেছে, কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার লক্ষ্য হলো সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান এবং ‘অনুপ্রবেশ’ রোধ করা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কয়েক লাখ লোকের গৃহহারা হওয়ার হুমকি দেখা দিয়েছে। বিপদের সময়ে এই লোকগুলোর ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে কি হবে- সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তখন ওই কাঁটাতারের বেড়া তাদের আশ্রয় প্রতিহত করবে। এ কারণে ভারতের এই ‘মহাপ্রাচীর’ দেশভাগের মতোই পোকায় খাওয়া (মথ-ইটেন), স্বেচ্ছাচারী এক দুঃসহ আঘাত। এখন যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এগিয়ে আসছে, তাই কাঁটাতারের বেড়া আন্তঃসীমান্ত উত্তেজনা শুধুই বৃদ্ধি করবে। তাই এর ব্যাপকতা আর না বাড়াতে ভারতের উচিত হবে এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলার অববাহিকায় চাড়াই-উৎরাইয়ে পরিপূর্ণ এবং সে কারণেই রয়েছে অভিবাসনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ১৯৫০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ১২ থেকে ১৭ মিলিয়নের মতো মানুষ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে অবৈধ অভিবাসনের কথা চাপা পড়ে যায়। সেই থেকে কোন ভারতীয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই কেবল ভারতের নাগরিকত্ব মেলে।
সীমান্তে আমার সঙ্গে কথা হয় মজনু রহমান মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি একজন মুহুরি। তার গ্রাম ভীড়া। কাঁটাতারের বেড়ায় বিভক্ত। মজনু ভারতীয়। তার স্ত্রী বাংলাদেশী আহমেদা খাতুন। ভারতীয় অংশের গ্রামে তারা বসবাস করেন। কয়েক বছর আগে আহমেদার পিতা মারা যান। তখন এই দম্পতির দ্রুত বাংলাদেশে আসা দরকার পড়ে। রাজ্যের রাজধানীতে গিয়ে পাসপোর্ট করার সময় তাদের ছিল না। তাই তারা দালাল ধরেন। ৮০ ডলারের বিনিময়ে তারা বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে নেন।
মজনু ও আহমেদার কাহিনী দু’দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধনেরও নির্দেশক। এই সত্য উপলব্ধিতে নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ বহুকাল ধরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছিল। কিন্তু গত শতব্দীতে অভিবাসন তর্ক ও সীমান্তে উভয় বাহিনীর মধ্যকার প্রলম্বিত সংঘাত এবং অনুপ্রবেশ বিষয়ক অতিরঞ্জনের ফলে ওই বিরোধিতার গতিবেগ কমিয়ে দেয়।
দক্ষিণ এশিয়া হলো বিশ্বের অল্পসংখ্যক অঞ্চলের অন্যতম যারা কোন আঞ্চলিক অভিবাসন নীতি প্রণয়ন ছাড়াই দিন পার করছে। জলবায়ু-সংবেদনশীল নীতি প্রণয়নের কথাবার্তা কিছু মতবাদগত প্রশ্নকে সামনে এনেছে। প্রথমত বহু বাংলাদেশী ও ভারতীয় এলিটদের কাছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কথাটি সন্দেহজনক। পশ্চিমা অবিচারের কুফল ও বিদেশী সাহায্য লাভের ফন্দি হিসেবে দেখেন তারা। দ্বিতীয়ত ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ ও ‘পরিবেশগত অভিবাসী’- এই দু’টোর মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার আছে। ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ কথাটি গ্রীন হাউস গ্যাসের উৎপাদকদের ওপর একটি দায় সৃষ্টি করে। এই বিতর্ক বিভিন্ন আইনগত অবস্থা বেছে নেয়ার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আর সেটা হলো একজন বাংলাদেশীর যখন ভারতে আশ্রয় নেয়ার দরকার পড়বে, তখন তার মর্যাদা কি হবে। তখন একজন বাংলাদেশী কি জরুরি ভিত্তিতে ভিসা পাবে নাকি তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চোরাই পথে কাঁটাতারের বেড়ার প্রাচীর টপকে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে।
এশীয় বর্ষাকাল যদি আরও কঠোর রূপ নেয় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকে, তখন কাঁটাতারের বেড়ার বর্তমান অবস্থা ধাবমান বাংলাদেশী জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ঠেকাতে যথেষ্ট বলে গণ্য হবে না। তবে অভিবাসন বিরোধী মানসিকতা বরং পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে। উদ্বাস্তুদের কি করে ঠেকানো যায়, সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ভারতের উচিত হবে কি করে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের মোকাবেলা করা যায় তেমন পদক্ষেপ নেয়া। এক অর্থে রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের জন্য পরিকল্পনা করার চেয়ে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা অধিক সহজতর। ভারত এখনই অন্তত কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার উদ্বাস্তুদের জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট ব্যবস্থা চালু করতে পারে। একটি নতুন উদ্বাস্তু অভিবাসন নীতিসংবলিত আইন তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারের কোনও উদ্যোগকে ভারত সমর্থন দিতে পারে।
জলবায়ু অভিবাসন মোকাবেলা করার বাংলাদেশী প্রয়াসে ভারতের সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অবশ্য কিছু ইতিবাচক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বছরের গোড়ায় উভয় জাতি জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির শিকার হওয়া অভিন্ন ম্যানগ্রোভ সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষায় পরস্পরকে সহযোগিতা দিতে তারা অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে ভারত অবশ্য বাংলাদেশে একটি পেছনমুখী পরিকল্পনাও নিয়েছে। আর তা হলো- ভারত বাংলাদেশে কয়লাচালিত দু’টি বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা। পলি পড়া ঠেকানো। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। বরং, এই বাঁধ বাংলাদেশীদের সন্দেহ সংশয় তীব্র করেছে। ভারতেও অন্তত সাড়ে চার লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে ওই বাঁধ। সেই সঙ্গে অন্তত একটি বড় ধরনের বন্যার কারণ হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করতে দরকার নজিরবিহীন সহযোগিতা, কাঁটাতারের বেড়া নয়। বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ ইমতিয়াজ আহমেদের মতে- সীমান্তবাসীদের জন্য দরকার উভয় দেশের ভোটার অধিকার প্রদান। এতটা হয়তো কাল্পনিকতাবাদে দুষ্ট হতে পারে কিন্তু বেড়ে ওঠা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বিকল্পগুলোকে সমানভাবে অবাস্তব করে তুলতে পারে। আহমেদ বলেন- “ভারত-বাংলাদেশ কাঁটাতারের বেড়া ‘জলবায়ু উদ্বাস্তুর স্রোত’ ঠেকাতে পারবে না। চীনের গ্রেট ওয়াল মোঙ্গল হানাদারদের আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। পরে তার নির্মাণ পরিত্যক্ত হয়। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়েছে।”
ভারতের গ্রেট ওয়াল মনে হচ্ছে আরও ভঙ্গুর। ইমতিয়াজ আহমেদ বললেন, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, যা কি-না ছোট ছেলেমেয়েরা মাত্র ২০ সেন্ট দামের কাঁচি দিয়ে টুকরা করে ফেলতে পারে।
Click This Link
আলোচিত ব্লগ
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন