১ম ভাগঃ
সকাল সকাল বউ এর প্যাচাল ভাল লাগেনা।ছেলেটাও বায়না ধরছে ঈদ এর জামা কিনে দাও।ছেলেকে কষে ধমক লাগায় দেয় নুহু..."পড়ালেখা করবানা ঠিক মতো...আমার কাছ থেকে কিছুই পাবানা"।সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল বউ আর মা এর শাসন..."আমার ছেলিক বকো ক্য?...সারাদিন ছেলিক বইকপানা"।কুষ্টিয়া যেতে হবে;তাড়াতাড়ি নাস্তা করে মা এর হাতের চা খেয়ে বের হতে হবে;কালকে আবার কুরবানী ঈদ।ইদানিং কিছুই ভাল লাগেনা নুহুর।হেপাটাইটিস্ বি ধরা পরেছে কিছুদিন আগে।অবশ্য ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই বিপদ কেটে যাচ্ছে।সদর দরজা থেকে বের হলেই চেয়ারম্যান বাড়ির কল্যানে একটা বৈঠকখানার দিকে কিছুক্ষণ তাকায় থাকে নুহু...।অনেক দিনের বন্ধু কুদ্দুস এর বাড়ী রাস্তার ওপারেই...ডাক দিতেই কুদ্দুস তার স্বভাব সুলভ কায়দায় হাটতে হাটতে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,"কুষ্টিয়া যাবা না ক্য?...ব্যালা পইরি গ্যালোজে।কালকে ঈদ মুনে নাই?ককুন কি কইরবানি ক্য?"।নুহু তারা দেয়..."চলো চলো"।পথের মধ্যে আবার এক জায়গা থেকে জমি লিজ এর টাকা নিতে হবে।কেন জানি খালি মনে হচ্ছে মা কে একটু দেখা হল না বাইরে বের হবার আগে।কখনও তো এটা মনে হয়না।ছোট ভাইটা আবার কি যেন কাজে যাবে...মোটরসাইকেল পাঠায় দিতে হবে তাড়াতাড়ি।কার্ও কাছ থেকে মোটরসাইকেল পেলে ভাল হতো।জমি লিজের টাকা নিয়ে ভেড়ামার রউনা দেয় কুদ্দুস আর নুহু।খুব বেশি সময় লাগে না পৌছাতে।দুই বন্ধু মিলে সিগারেট ধরায়।
সিগারেট শেষ হলে নুহু বলে,"তালে আমি যাই",
কুদ্দুসঃ"কতখুন লাগবিনি আসতে?"
নুহুঃ "ঘন্টা দুই।দেরি কইরবোনাতো।"
কুদ্দুসঃ "তালে আমি এক ঘন্টা পরই মুবাইল কইরবনি"
নুহুঃ "আরে না...মুবাইল করা লাগবিনানে...আমি চইলি আসপনরে পাগল ছেলি"
কুদ্দুসঃ "তুমি যাওতো...আমি মুবাইল কইরবনি"
নুহুঃ "আচ্ছা কইরো..."
নুহু রওনা দেয়।বাসে ভিড় তাই দাড়িয়েই যেতে হয়।
কুদ্দুস অপেক্ষা করতে থাকে।ঘন্টাখানেক পর মোবাইল করে দেখে বন্ধ...ব্যাপার কি?...আবার দেয়...নাহ্ আবার বন্ধ বলছে।কুদ্দুস ভাবে হয়তো নেটওয়ারক পাচ্ছে না।কালকে আবার ঈদ,তাই হয়তো ঝামেলা করছে।এক ঘন্টা গেল,দুই ঘন্টা গেল...এভাবে আড়াই ঘন্টা চলে গেল...নুহুর মোবাইল বন্ধ।কি জানি কোন কজে ব্যস্ত হয়ে পরছে...এই ভেবে নিজের আর নুহুর বাড়ির জন্যে দুই হাঁড়ি দই কিনে নিয়ে বাসার পথে রওনা দেয়।বাসায় পৌছাতে এক হাঁড়ি দই দেখে নুহুর মা জিজ্ঞেস করেঃ"এক হাঁড়ি লিয়াইছসিশ ক্য?"কুদদ্দুস বলেঃ"দুই ঘন্টার কতা বুইলি...নুহুর খোঁজ ই নাইকো...মুবাইল করনু নুহুক...বন্দ পানুজে"।মায়ের টেনশন শুরু হয়ে যায়...কোথায় গেল ছেলে?মোবাইল বন্ধ কেন?।নুহু কে মোবাইল করে দেখে আসলেই মোবাইল বন্ধ।ছোট ছেলে নোমান কে মোবাইল করে জানানো হয় ব্যপারটা।চারিদিকে খোঁজ পড়ে যায় নুহুর।
২য় ভাগঃ
মহাসড়কের বাঁক।হঠাৎ একটা বাস রাস্তার বিপীরিত দিকে অস্বাভাবিক ভাবে চলা শুরু করে।বাসটার বিপরীত দিক থকে আসা একটা ট্রাক বাসটিকে মাঝ বরাবর সজোরে আঘাত করলো আর বাসটা এক নিমিষেই পাখির মতো উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে দুই তিনটা ডিগবাজি খেয়ে পুকুরে পড়ল।অবাক করার মতো ব্যাপার হলো বাসটা ঠিক সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে থাকল যেন কিছুই হয়নি শুধু কাঁচ ভাঙ্গা ছারা।এই সুযোগ বারবার আসেনা...আসলাম তাড়াতাড়ি কাজে হাত দেয়।দ্রুত আহত অথবা নিহত বাস যাত্রির যা আছে নিমিষেই নিজের করে ফেলে।কারন পুলিশ বা অন্য কেউ উদ্ধারে হাত দেওয়ার আগেই সব সরিয়ে ফেলতে হবে।ফরসা মতো একটা লোককে টেনে পাড়ে তুলে আনে আসলাম।পকেটে হাত দিয়ে দেখে অনেকগুলা ৫০০ টাকার নোট...।টাকা আর মোবাইল টা পকেটে রেখে আইডি কার্ডটা বের করে দেখে...জিল্লুর রহমান নুহু,পিতা- সাইদুর রহমান,গ্রাম-জগশ্বর,থানা-ভেড়ামারা।আস্তে করে পানিতে ফেলে দায় কার্ডটা।আবার ও দেখবে নাকি লোকটার পকেটে কিছু পাওয়া যায় কিনা?এবার দেখে হাত ঘড়িটা ভালই...খুলে হাতে পড়ে ফেলে...পরে ঠিক করে নিবে।তারপর দেহটা টেনে অন্যসব লাশ এর সাথে রেখে দেয়।আধা ঘন্টার মধ্যে উদ্ধার কাজ শুরু হয়ে যায়।যাকে যাকে হাসপাতালে পাঠানোর দরকার তাকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়।হঠাত মৃতদেহগুলো সরাতে যেয়ে দেখা যায় একজন আহত ব্যক্তিও আছে লাশ গুলার সাথে।দ্রুত ভ্যান ডেকে তাকে তুলে পাঠিয়ে দেয়া হয় ১০-১২ কিলমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাস্পাতালে।ঈদের আগের দিন...ডাক্তার পাবে কোথায়?...সেবিকা আর সহকারীরা মিলে কোন রকম চিকিৎসা দেয় আর অক্সিজেন দিয়ে তাকে ফেলে রাখা হয় হাস্পাতালের মেঝেতে।অতিরিক্ত ব্লিডিং এর কারনে আহত ব্যাক্তিটির সারা দেহ আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে।কিছুক্ষণ পর মুখ দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে যায়।
৩য় ভাগঃ
বিকাল ৪টা বাজে।সবাই দুপুরের খাওয়া খেয়ে রেষ্ট নিচ্ছে।বাসার ছোট মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।বাসার একজন কে সবাই মিলে আটকানোর চেষ্টা করছে..."কবির যাইসনা...ঈদের পরদিন যা।"একজন বলে উঠলো...আমি ভাবলাম তোর সাথে যাব...কিন্তু তা আর হলো না।হঠাৎ কবিরের মোবাইল এ একটা কল আসে...বারমাইল এ একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ১১ টায়...এরপর থেকে নুহুর মোবাইল বন্ধ।এখনি যেন হাস্পাতালে খোঁজ নেয়া হয়।দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যায় বাসার মেজো ছেলে,কবির আর মন্টু।হাস্পাতালে খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেল নুহু কে মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায়।দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে নিয়ে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলো।ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসতেই সবার আশা কে নিরাশার সাগরে ভাসায় দিয়ে পরপারে চলে গেল নুহু।সকাল ৭ টায় লাশ গ্রামে এসে পৌছে।ঈদের দিন সবার ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় নুহুকে সমাহিত করা হল গোরস্তানে।৭ বছরের ছেলে নাবিল আর ১ বছরের মেয়ে রাফিয়া জানল না তাদের বাবাকে তারা চিরতরে
হারিয়ে ফেলেছে।জগশ্বর গ্রামের কেউই আর কুরবানী ঈদটা ভাল করে পালন করতে পারবে না কারন যাকে তারা প্রবল ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে নিজেদের নেতা বানাতে চেয়েছিলো সে আজকে চরম কষ্ট নিয়ে চলে গেল।
৪র্থ ভাগ
এই ঘটনার কয়েক দিন পর নুহুর হারানো মোবাইল নম্বর দিয়ে তার এক মামার কাছে কল আসে।সে জানায় তার নাম আসলাম...এবং ঐ দিন সেই তাকে বাস থেকে টেনে বের করে।আসলাম নামক ঐ ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করে এখন সে কেমন আছে?...।আসলাম কে যখন জিজ্ঞেস করা হয় সেদিন মবিলটাই যখন নিলে তখন একটা মিনিট কোন একটা নম্বরে কল করে বললেইতো হতো ব্যপারটা...হয়ত বেঁচে যেতো সে অথবা আর কয়টা দিন বেঁচে থাকতো।আসলাম নামক মানুষরুপি নরপশু আস্তে করে মোবাইলটা কেটে দেয় এবং বন্ধ করে রাখে।
****এটা একটা সত্য ঘটনা যার সবগুলো চরিত্রকে ঠিক রাখা হয়েছে।এখানে ১ম এবং ২য় ভাগ কে লেখা হয়ছে নুহু ভাইয়ার মারা যাবার পর তার কাছের বন্ধু এবং পরিবারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থকে।আসলাম এখনও নুহু ভাই এর মোবাইলটা মাঝে মাঝে খোলা রাখে আর কল দিলে বলে রং নম্বর।বাংলাদেশ বলেই হয়তো এটা সম্ভব।আসছে ২৪ তারিখ নুহু ভাইয়ার চল্লিশা হবে।তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি****
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:২১