somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিমির খালা

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১০ ভোর ৪:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তরুণী সোজা এসে আমার গাড়ির জানালায় মুখ নামিয়ে বললেন, ‘এটা বাবলুদের গাড়ি না?’
বললাম, ‘হ্যাঁ’।
‘আমি মিমির খালা, আমাকে মোমিন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে একটু নামিয়ে দিন তো।’
আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই উঠে বসলেন গাড়িতে। শীতাতপযন্ত্র চালু ছিল, পারফিউমের একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল গাড়িটা। বুঝলাম মিমি নামের একজন সহপাঠিনী আছে আমার ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ভাইপোর। কিন্তু মিমির খালা আমাকে কী ভেবেছেন?
সকালে শেভ করব কি, নাশতা করার সময়ও পাইনি। সকালের দিককার চিনিঘুমটা খুব তারিয়ে উপভোগ করছিলাম। কিন্তু বাংলা সিনেমার নায়িকা সচরাচর যেমন বলে, ‘এত সুখ কী আমার কপালে সইবে?’—আমার বেলায়ও তা-ই ঘটল, সুখনিদ্রায় পানি ঢেলে দিয়ে রুনু ভাবি বললেন, ‘শিহাব ভাই, ড্রাইভার তো আসেনি...।’
চোখ না খুলেই বললাম, ‘বাবলু আজ স্কুলে না যাক, এক দিন না গেলে অশিক্ষিত হয়ে যাবে না।’
‘কিন্তু আজ যে ওর পরীক্ষা, না হলে কি এই সকালে তোমাকে কষ্ট দিতাম, শিহাব ভাই।’
আমার এই ভাবিটা যেমন ন্যাকা, তেমনি কর্মোদ্ধার-পটিয়সী। ঘুমের বারোটা বাজল। পরনে ছিল ঢিলেঢালা একটা পাজামা আর দুমড়ানো-মুচড়ানো টিশার্ট। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা গলিয়ে কোনো রকমে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছি। মিমির খালা মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী। কাঁধ পর্যন্ত শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের মতো চুল, গাঢ় সবুজ সালোয়ারের সঙ্গে হালকা সবুজ কামিজ আর গলা পেঁচিয়ে পেছন দিকে ফেলে দেওয়া মুঠো-প্রস্তের ওড়না। এক জোড়া ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরেও দশটি বাঙালি মেয়ের চেয়ে লম্বা। আমার পেছনে তো আর মাছির মতো চোখ নেই, তবু এত বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি কী করে ভাবছেন? কোনো ব্যাপার না, এ রকম সুন্দরীদের একবার দেখলে যে কেউই এ রকম বর্ণনা দিতে পারে; আপনিও পারবেন।
মিমির খালা গাড়িতে উঠে বসেছেন তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু শুধু সানগ্লাসটা চোখ থেকে কপালে তুলে ‘একটু নামিয়ে দেবেন’ বলার মধ্যে একটা উদ্ধত ভঙ্গি কিংবা অবজ্ঞা ফুটে ওঠে। কী আর করা! সুন্দরীরা ভাবেন, তাঁরা যে ধরার ধুলায় পা রাখছেন, তাতেই ধরিত্রী ধন্য।
পুরো রাস্তা একটি কথাও বলেননি, বরং সেলফোনটার বোতাম টেপাটেপি করে ব্যস্ততার ভান করেছেন। তাতেও আমার মনে করার কিছু ছিল না। অপরিচিত লোকের সঙ্গে কী-ই বা কথা বলবেন, আর কতটুকুই বা পথ। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটল ব্র্যাক ব্যাংকের পাশে নামিয়ে দেওয়ার পর। ধন্যবাদ-টাদ কিছু নয়, সোজা আমার জানালার পাশে এসে কাচটা নামাতে বললেন ইশারায়, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতব্যাগ থেকে একটা বিশ টাকার নোট বের করে ধরিয়ে দিলেন হাতে। ‘চা খাবেন’ বলে গট্গট করে সরে পড়লেন দৃষ্টিসীমা থেকে।
বিশ টাকার নোট এত দর্শনীয় মনে হয়নি কোনোদিন। কিন্তু এই নোটটার দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে কখন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছি খেয়াল ছিল না নিজেরই।
সব রাগ আমার গিয়ে পড়ল রুনু ভাবির ওপর। এই মহিলা আমাকে আজ সাতসকালে এই চেহারা-পোশাকে বাবলুর স্কুলে না পাঠালে এই অপমানটা হজম করতে হতো না। নিজের মুখে কী বলব, আমি দেখতে শুনতে ভালো, ফর্মাল প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে ব্লেজার আর মানানসই টাই, ক্লিন শেভ্ড মুখ থেকে লোশনের ভুরভুর গন্ধ ছড়ালে কার বাপের সাধ্য আমাকে ড্রাইভার ভাবে!
রুনু ভাবিকে এসব কিছুই জানালাম না। শুধু নাশতা করার সময় বললাম, ‘ভাবি, এত কিসিমের মেয়ে দেখাও আর বিয়ে করো বিয়ে করো বলে কান ঝালাপালা করে দাও, মিমির খালার মতো একটা মেয়ে তো দেখালে না আজ পর্যন্ত।’
ভাবি চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মিমির খালা! মানে তানিয়া? কোথায় দেখলে? ওই মেয়ের তো খুব নাক উঁচা...।’
‘সুন্দরীদের নাক এ রকমই হয়, বিয়ের আগে তোমারও ছিল, তুমি খবর নাও, পারিবারিকভাবে একটা প্রস্তাব দাও।’
কয়েক দিন পর রুনু ভাবি বললেন, ‘তানিয়ার মাকে বলেছিলাম, উনি বললেন, ছেলে তো ভালো, বিদেশে পড়াশোনা করেছে, ভালো চাকরি করে, কিন্তু মা, আমার মেয়ের মতামত ছাড়া তো হবে না, খুব জেদি মেয়ে।’
‘তাহলে মেয়েকে বলো।’
‘বলেছি, তানিয়া বলল সে আগে নিজে ছেলে দেখবে, কথা বলবে, তারপর ডিসিশন।’
আশ্চর্য কী জমানা এলো, মেয়ে আসবে ছেলে দেখতে! ব্যাপারটা একটু অপমানজনক। তবে নিজের ওপর বিশ্বাস আছে আমার; বললাম, ‘আমি রাজি।’
শুক্রবার ছুটির দিন তানিয়া এল ছেলে দেখতে। সরাসরি বাসায়। এই জীবনে আরও কত কী দেখতে হবে! একটু নার্ভাস লাগছিল।
তানিয়া বলল, ‘আপনাকে আগে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে...।’
‘দেখে থাকবেন, একই শহরে থাকি।’ আমার সপ্রতিভ উত্তর। গাড়িতে লিফ্ট দেওয়ার ব্যাপারটির ধারে-কাছে গেলাম না। এরপর নানা প্রশ্ন—বিদেশে কোথায় পড়াশোনা করেছি, এখন কত বেতন পাই (রীতিমতো অভদ্র কৌতূহল), গান শুনি কি না, কী ধরনের গান পছন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা-নাশতা খেয়ে, ভাবিকে নিচু স্বরে ‘পরে জানাব’ বলে চলে গেল তানিয়া। আমি একটু চুপেস গেলাম।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আর ধৈর্য ধরতে না পেরে মাস যাওয়ার আগেই ভাবিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খবর কী, ভাবি?’
ভাবি একটু বিব্রত, বললেন, ‘বলেছি না মেয়েটার একটু নাক উঁচা...।’
‘কী বলেছে সেটা বলো।’
আমাকে প্রায় অতল জলের ঘূর্ণিস্রোতে ফেলে দিয়ে ভাবি বললেন, ‘পছন্দ হয়নি।’
ধরণী কেন দ্বিধা হয় না! রাগে-দুঃখে-অপমানে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। তানিয়া সুন্দরী, স্মার্ট সন্দেহ নেই, তাই বলে আমি কি ফেলনা? কত মেয়ের জীবন ধন্য হয়ে যাবে আমাকে পেলে। পরদিন সকালে একটা বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সকালে মিমিকে স্কুলে দিতে আসে ওর খালা। সোজা সেখানে গিয়ে হাজির হলাম তার সামনে।
হাসিমুখে তানিয়া বললেন, ‘কেমন আছেন?’
উত্তর না দিয়ে সোজাসুজি বললাম, ‘আমাকে পছন্দ না করার কারণটা জানতে পারি?’
একটুও অপ্রস্তুত হলো না তানিয়া, বরং একটা বাউন্সার ছুড়ল যেন আমার কাঁধ ও মুখ বরাবর, ‘শুনেছি এর আগে তিনটা মেয়েকে পাত্রী হিসেবে আপনি বাতিল করেছেন, তারা কি কেউ এসে আপনার কাছে এসে জানতে চেয়েছে কারণটা কী?’
আমার মুখে কথা জোগাল না কয়েক মুহূর্ত, তারপর একটু কাঁচুমাঁচু হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সিদ্ধান্তে অটল?’
এবার এক অসাধারণ হাসিতে মুখ ভরিয়ে তানিয়া বলল,‘সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারি এক শর্তে।’
‘কী শর্ত?’
‘আর কোনোদিন পাত্রী দেখে বেড়ানো আর বাতিল করা—এসব করতে পারবেন না।’
‘কেন করব? একবার পছন্দ হলে আর দেখার কী আছে?’
‘ঠিক আছে যান আমি রাজি...।’
যেন দয়া করলেন আমাকে। আমি প্রাথমিক সাফল্য নিয়ে ফিরে আসছিলাম। পেছন থেকে ডাক দিলেন, ‘শুনুন।’
কাছে যেতেই বললেন, ‘তোমাকে কোট-টাই এসবে একদম ভালো লাগে না, বরং প্রথম যেদিন দেখেছিলাম উস্কুখুস্কু চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি... সেটাই ভালো। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘কী বলছো! ড্রাইভার ভাব নি? তাহলে বিশ টাকার নোটটা?’
‘সেটা ছিল বুকিং মানি, বুক্ করে রেখেছিলাম তোমাকে।’
আমি কী গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেব? না, সেটা এখানে শোভন হবে না। তবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখন থেকে শেভ করব দশ দিনে একবার।

লেখক----বিশ্বজিৎ চৌধুরী

সূত্র--- রস- আলো
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:০২
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×