somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মসমর্পণের সেই বিকেল

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


স্বতঃসিদ্ধ নিয়মেই রাত নামে পৃথিবীতে। সকাল হয়। পশ্চিমাকাশে সূর্যের হেলে পড়ার সুবাদে অবসান হয় দুপুরের। প্রতিবেশে জন্ম নেয় বিকেল। কিন্তু সব বিকেলই তো এক রকম নয়! আবহাওয়ার ভিন্নতা ছাড়াও কিছু কিছু বিকেল তো অবশ্যই সমুজ্জ্বল অনন্য মহিমায়, উদ্ভাসিত ব্যতিক্রমী দ্যোতনায়! হিমেল হাওয়া-মাখা শীতের বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে হয় আমাদের। কেমন ছিল বিজয় দিনের অসাধারণ সেই বিকেলটি?
বিকেলটি নিশ্চিতভাবেই স্বর্গীয় মত্ততায় পূর্ণ ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে যে স্থানটি আজ প্রতিষ্ঠিত ঢাকায়, সেই স্থানটি তখন ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানের অবিভক্ত অংশ। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত সেই ময়দান লোকে লোকারণ্য ছিল সে বিকেলে। মুক্তিকামী জনতার মুহুর্মুহু চিৎকারে মুখর ছিল ময়দানের চারপাশ। ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠানের অংশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছিল উপস্থিত বাঙালিরা। ঘড়ির কাঁটা চারটা অতিক্রম করল। অতিক্রান্ত হলো আরও কিছু সময়। ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের উল্লাস প্রবল হলো হঠাৎ! কেন? তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে একটা গাড়িবহর এসে থামল ময়দানের প্রবেশপথে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরাকে নিয়ে সেই গাড়িবহর থেকে নেমে এলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তাঁদের দুজনকে অনুসরণ করে ময়দানের মাটিতে পা রাখলেন ভান্তি অরোরা, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং, উইং কমান্ডার এ কে খন্দকারসহ আরও অনেকে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিদারুণভাবে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সামরিক রীতি অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল গার্ড অব অনার প্রদান করল বিজয়ী দলের অধিনায়ককে। অন্যদিকে বিজয়ী সেনাদলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত হলো বিজিত দলের সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে। গার্ড অব অনার গ্রহণ করে ছোট্ট একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন অরোরা ও নিয়াজি। পাশাপাশি বসলেন তাঁরা। টেবিলের ওপর রাখা হলো একটি মুদ্রিত কাগজ। ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার’ বা ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ শিরোনামে মাত্র তিনটি অনুচ্ছেদে যে বাক্যগুলো সন্নিবেশিত সেই কাগজটিতে, বঙ্গানুবাদে তার রূপ দাঁড়ায় অনেকটা এমন:
‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণে স্বীকৃত হচ্ছেন। এই আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের সব সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী এবং আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসব বাহিনীর সবাই—যারা যেখানে আছে, সেখানকার নিকটস্থ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ ও সব অস্ত্র সমর্পণ করবে।
‘এই দলিল স্বাক্ষরের সময় থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীনস্থ হবে। নির্দেশের অবাধ্যতা আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যুদ্ধের স্বীকৃত ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হবে। যদি আত্মসমর্পণের কোনো শর্তের অর্থ বা ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এই আশ্বাস প্রদান করছেন যে আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী একজন সৈনিকের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং তিনি আত্মসমর্পণকারী সব সামরিক ও আধাসামরিক ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সুব্যবস্থার অঙ্গীকার প্রদান করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনস্থ সেনাবাহিনী সব বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
আত্মসমপর্ণের দলিলে সন্নিবেশিত বাক্যগুলো সুলিখিত হলেও নিয়াজির মতো একজন সেনা অধিনায়কের জন্য ভীষণ অপমানজনক। কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর! কলম তুলে নিলেন। স্বাক্ষর করলেন দলিলের নিচের অংশের ডান দিকের নির্ধারিত স্থানে। বাঁ দিকে স্বাক্ষর করলেন অরোরা। তারপর নিয়াজি তাঁর কাঁধ থেকে এপালেট (সেনা অধিনায়কের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে দিলেন; ল্যানিয়ার্ডসহ (ছোট্ট দড়িবিশেষ) পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের রিভলবারটি তুলে দিলেন জগজিৎ সিং অরোরার হাতে। অস্ত্রসমর্পণের এই দৃশ্য অবলোকন করে অগণিত বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হলো। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই ব্যতিক্রমধর্মী বিকেলে শতাধিক দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন হলো পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ।
দীপংকর চন্দ | তারিখ: ১৬-১২-২০১০
মুলসুত্র: View this link

http://digitalvillagebd.blogspot.com/
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×