somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“মেঘে ঢাকা তারা”- অসীম অন্ধকারে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“দাদা, আমি বাঁচতে চাই। আমি বাঁচবো; আমার বাঁচতে বড় ইচ্ছে করে!” বড় ভাই শঙ্করের কাছে নীতার বাঁচতে চাওয়ার আকুতি শান্ত- স্নিগ্ধ- পাহাড়ের আকাশ- বাতাস ভারী করে তোলে। জীবনের ভারে ক্লান্ত, প্রতারণা আর সামাজিক বঞ্চনার আঘাতে যে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনেছে তার কীসের ভরসায় বাঁচার আকুতি? জীবন- মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নীতার বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ‘মৃত্যুই জীবনের শেষ পরিণতি’?- এই প্রশ্নটা দর্শকের মর্মমূলে গভীর অনুরণন তোলে।

ঋত্বিক কুমার ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা”র শেষ চিত্রকল্প এটি। শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য রচিত। উপন্যাসের কাহিনী দেশভাগের প্রেক্ষাপটে উদবাস্তু জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামকে ঘিরে আবর্তিত হলেও তা ঋত্বিক ঘটকের স্পর্শে হয়ে উঠেছে শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শলিপি। দেশভাগের কারনে ২১ বছর বয়সে পূর্ববঙ্গ ছাড়ার ঘটনা এবং সমকালীন বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট- দাঙ্গা- মন্বন্তর তার জীবনবোধকে তীক্ষ্ণ করেছে। এবং এই বোধের সার্থক চিত্রায়ন হয়েছে “মেঘে ঢাকা তারা”য়; যেখানে দেশ ছাড়ার হাহাকার আর বেঁচে থাকার সুতীব্র আকুতি চিত্রিত হয়েছে।

কাহিনীর গাঁথুনি রৈখিক। পঞ্চাশ দশকে কলকাতার এক বাঙালি পরিবার ঘিরে কাহিনীর আবর্তন। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পর এ শরণার্থী পরিবার আশ্রয় নেয় কলকাতা শহরের প্রান্তে। ছবির মূল চরিত্র নীতা, পরিবারের বড় মেয়ে। পড়াশোনার পাঠ চুকানোর আগেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। নীতার বৃদ্ধ বাবা স্কুলে পড়ায়; মা ঘরবাড়ি দেখাশোনা করে। নীতার দুই স্কুলপড়ুয়া ভাই-বোন, গীতা আর মন্টু। নীতার বড় ভাই শংকর; সংসারে মন নেই। শংকরের ধ্যান সুর নিয়ে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করে; বড় মাপের সঙ্গীত শিল্পী হতে চায় সে। আশা ছাড়ে না নীতা; স্বপ্ন দ্যাখে ভাই শংকরকে নিয়ে, প্রেমিক সনৎকে নিয়ে। পিইচডি শেষে ফিরে আসবে সনৎ তার কাছে; বিয়ে করবে তারা।

কাহিনী মোড় নিতে থাকে। নীতার বাবা আর মন্টু দুর্ঘটনায় পড়ে। শংকর চলে যায় বোম্বেতে, গায়ক হবার জন্য। পুরো সংসারের দায়িত্ব নীতার একার। আদর্শবাদী বাবা নীতাকে বিয়ের কথা কয়েকবার বললেও মা চান না নীতার বিয়ে হোক। কারন নীতার বিয়ে হয়ে গেলে সংসারের হাল ধরবে কে? প্রেমিক সনৎ তাকে প্রত্যাখ্যান করে বিয়ে করল তারই ছোটবোন গীতাকে, অসহ্য হতে শুরু করল সবকিছু। প্রতারণার এই সংসারে নীতা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যক্ষ্মায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে। অথচ এ মৃত্যু সে চায়নি। মা চায় রোজগেরে মেয়ে আইবুড়ো থাকুক, সনৎ চায় গ্লামার, গীতা চায় স্বাচ্ছন্দ্য, সততা-ন্যায়-সমতা থেকে সকলে বিচ্ছিন্ন। সকলেই নিজ নিজ নীড়ের সন্ধানে ব্রত। শেষমেশ মৃত্যুর দিন আসে। শংকর ফিরে আসে বোম্বে থেকে, পুরোদস্তুর ক্ল্যাসিকাল গায়ক হয়ে। নীতার চূড়ান্ত অসুস্থতা তার চোখ এড়ায় না। পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় নীতাকে। কিন্তু বাঁচার আকুতি তার জেগে ওঠে যখন দাদা হাসপাতালে নীতাকে বাড়ির খবর জানায়, জানায় গীতার ছেলের অসীম প্রাণ চঞ্চলতার কথা। তখন যক্ষ্মা রোগগ্রস্তা নীতা দাদাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, 'দাদা আমি বাঁচব, বাঁচতে আমার বড় ভালো লাগে। আমরা বুঝে যাই শিশুটির জীবনাবেগে নীতা মৃত্যুকে অস্বীকার করতে চায়। এ যেন মৃত্যু নয় জীবনের ঘোষণা। এ শিশু আত্মার দিক থেকে তার কিন্তু ঘটনার পাঁকে শারীরিকভাবে অন্যের তথা ছোটবোন গীতার। সামাজিক পটভূমিতে নারীর স্থূল ও ভঙ্গুর জীবনযাপন ঋত্বিকের এই চলচ্চিত্রে অসাধারণ ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে।

ঋত্বিকের চরিত্রগুলি আপাত দৃষ্টিতে জীবন বাস্তবতার কাছে, ঘটনার কাছে সমর্পিত মনে হলেও তার প্রতিবাদ অন্যজায়গায়। যে সমাজ বাস্তবতা তিলে তিলে নীতাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিবাদের সেই ভাষা দর্শক মনে জন্ম নিক- এই হচ্ছে ঋত্বিক সিনেমাটোগ্রাফির মূল কথা। মেঘে ঢাকা তারা নিভতে নিভতেও উজ্জ্বল জীবনের আলোয়।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

সততা হলে প্রতারণার ফাঁদ হতে পারে

লিখেছেন মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম নাদিম, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৯

বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। ক্রেতাদের মনে যে প্রশ্নগুলো থাকা উচিত:

(১) ওজন মাপার যন্ত্র কী ঠিক আছে?
(২) মিষ্টির মান কেমন?
(৩) মিষ্টি পূর্বের দামের সাথে এখনের দামের পার্থক্য কত?
(৪) এই দোকানে এতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×