somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেওবন্দের ফতোয়াঃ মুসলমান মেয়েদের বাইরে কাজ করতে যাওয়া ‘হারাম’

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হুজুর, এই কথা বললে তো আমাদের না খেয়ে মরতে হবে এই দেশে, কেননা [ মুসলমান ] বুয়ারা সব কাজ হারাবে। এমন ফতোয়া দিলে তো বাংলাদেশ অচল হয়ে যাবে! পাশাপাশি, গৃহকর্মের 'বিশাল' বাজারটি চলে যাবে অ-মুসলমানদের হাতে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু মেয়েরা বুয়া হিসাবে নিযোগ পাবে। আর তা হলে তো আমাদের দেশের ইসলামপন্থীরা বার বার বলবে, 'ভারতীয়রা আমাদের ঘরে ঢুকে পরতেসে'!

মুসলমান মেয়েদের ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করাকে ‘হারাম’ বলে ফতোয়া দিয়েছে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসা। গেল ১২-০৫-২০১০ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদের বরাতে এই নজিরবিহীন ফতোয়া সমন্ধে আমরা জানতে পারলাম। দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, “মুসলমান নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে যেকোনো সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে যোগদান শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ। চাকরির সময় ‘পর-পুরুষের’ সঙ্গে নারীর মেলামেশা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়”।

এখন একটি প্রশ্ন, এমন একটি মুসলিম দেশের নাম করুন, যারা তাদের জাতীয় বিমান সংস্থায় নারী বিমানবালা নিয়োগ দেয় না। এমনকি সৌদি আরবের মতো কট্টর মুসলিম দেশও তাদের জাতীয় বিমান সংস্থায় নারী বিমানবালা নিয়োগ দেয়। এবং দায়িত্ব পালনের সময় তাদের মুখমণ্ডলে কোনো নেকাব থাকে না। মনে রাখতে হবে, সৌদী আরবের বিমান সংস্থায় যারা কাজ করেন, তারা সকলেই বিদেশী। আর বিদেশি বেগানা আওরাত দেখতে তো দেওবন্দ নিষেধ করে নাই! [ তাই সেটা হালাল হিসাবে বজায় থাকল। ]

এটা ঠিক এক সাথে কাজ করা আর একই কাজ করার মাঝে অনেক পার্থক্য। মহিলারা তাদের কাজের জন্য পরিবেশ থাকলে বাইরের কাজও করতে পারেন। আর একসাথে কাজ করার মানেও আবার কোনরকম বাধা-নিষেধ ছাড়া মেলামেশা হতে পারেনা। সেভাবে পুরুষের সাথে কাজ করার মানে বিভিন্ন কন্সার্টে অংশ গ্রহণের আর বেলেল্লাপনা করাও হতে পারেনা। মেয়েদের জন্য পরিবেশ থাকলে তারা ঘরের ভিতরে-বাইরে তাদের সামর্থ অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এখানে ইসলাম বাধা দিয়েছে বলে কেউ বলেনি।

তবে বাইরে কাজ করা আর সমানাধিকার এ দুটোকে এক করা যাবেনা। তথাকথিত সমানাধিকার কখনোই সম্ভব নয়। এটা ধর্মীয় ভাবে শুধু নয়। প্রাকৃতিক ভাবেও সম্ভব নয়। সামানাধিকারের কথা আসলে সমান দায়িত্ব নেয়ার কথাও আসবে।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, নারী-পুরুষ কি সব দায়িত্ব সমান ভাবে ভাগ করে পালন করতে পারবে? যেমন নারী সন্তান ধারণ করা, জন্ম দেয়া সহ লালন পালনের যে কাজ করে তা কি পুরুষ করতে পারবে? আবার ঘরের সব কাজ করার পরও নারীকে বাহিরের সব কাজে পুরুষের সমান কাজ করতে দেয়াটা কি নারীর উপর ইনসাফ করা হলো? নারী অবশ্যই বাহিরে কাজ করবে। কিন্তু ঘরের সব করার পর নারীর উপর বাহিরের সব কাজের পরিশ্রম সমান ভাগ করে দিলে তাতে কি নারীর উপর কাজের প্রেসারটা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে গেলনা?

এভাবে হলে তো পুরুষই দায়িত্বটা কম নিয়ে নারীর উপর আরো বেশী জুলুম করছে। তাই সমানাধিকার সমাধান নয়। দরকার সুষম অধিকার। যার যেখানে যতটুকু প্রয়োজন তার সবটুকু দেয়াটাই প্রয়োজন। সব মিলিয়ে ঘরের বাইরে কাজ করা সম্পূর্ণ হারাম হওয়ার কথা নয়।

অস্পষ্ট অথবা স্বল্পস্পষ্ট সূত্র থেকে আহরিত তথ্যের ভিত্তিতে নারী ও নারী-পুরুষ সম্পর্ককেন্দ্রিক যেসব হাদিস ও মন্তব্য আমাদের আলেমরা সাধারণতঃ করে থাকেন, তাতে নারীকে মর্যাদাশীল মানুষ নয়, মনে হয়

ক। জড় ও ভোগ্যবস্তুঃ সমস্ত পৃথিবীটাই সুখভোগের বস্তু এবং যাবতীয় সুখভোগের বস্তুসমূহের মধ্যে সতী-সাধ্বী নারীই সর্বোৎকৃষ্ট ইত্যাদি,
খ। লুকিয়ে রাখবার জিনিসঃ শুন হে মোমিনগণ, খাট প্রাণপণে/পর্দা জারী রাখ, নারী রাখ সঙ্গোপণে ইত্যাদি
,
গ। স্বামী (প্রভু)-র দাসানুদাসঃ যে স্ত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের স্বামীর কাপড় ধৌত করিয়া দিবে, আল্লাহতাআলা তাহার আমলনামা হইতে দুইহাজার গুনাহ কাটিয়া দিবেন এবং স্ত্রীলোকের গমচূর্ণ বা ধান ভানাই ধর্মযুদ্ধস্বরূপ ইত্যাদি,
ঘ। ব্যক্তিস্বাধীনতাহীনঃ আপনাদের স্বামী যদি আপনাদিগকে কখনও কোন কাজে ডাকেন, তৎক্ষণাৎ চক্ষের ইশারায় আসিয়া হাজির হউন এবং যে মকছুদে ডাকিয়াছেন তাহা বিনা আপত্তিতে পুরা করিতে চেষ্টা করুন, যদি শরীয়তের কোন ওজর না থাকে। যথা : হায়েজ, নেফাছ বা বিমারী ইত্যাদি,
ঙ। ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা বোধহীনঃ আপনাদের স্বামীগণ আপনাদের যেইরূপ চালাইতে চাহেন, সেইরূপ চলিতে থাকুন এবং তাহারা যেইভাবে চলিতে থাকে আপনারা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুন। কোন কাজে ও কোন কথায়ই তাহাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করিবেন না,
চ। বেআক্বলঃ স্ত্রীলোকের ঈমান ও আক্বল পুরুষের ঈমান ও আক্বলের অর্ধেক মাত্র

এমন কি এও বলা হয়ে থাকে,
ছ। স্ত্রী নির্যাতন বৈধঃ স্বামী নিম্নলিখিত চারি কারণে স্ত্রীকে প্রহার করিতে পারে-- ১. স্বামী যদি স্ত্রীকে সাজ-সজ্জা করিয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইতে বলে, আর যদি সে তাহা অমান্য করে। ২. স্বামী ছোহবতের উদ্দেশ্যে তাহাকে ডাকিলে যদি সে উপস্থিত না হয়। ৩. যদি স্ত্রী নামায ও নাপাকীর গোসল ত্যাগ করে। ৪. যদি সে স্বামীর বিনা হুকুমে অন্য লোকের বাড়ী যায়
জ। স্বামীর একাধিক বিয়ে করাকে স্ত্রীদের মেনে নিতে হবেঃ যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহতাআলা শহীদের তুল্য ছওয়াব দান করিবেন

শুধু তাই নয়, স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হলেও তার রাগান্বিত বা বিচারপ্রার্থী হবার কোনো নিয়ম নেই। এও বলা হয়ে থাকে যে, “স্বামী যদি কোন সময় কোনও ক্রুটি পাইয়া আপনাদিগকে মারেন বা গালাগালি করেন তজ্জন্য চুপচাপ গাল ফুলাইয়া মনের রাগে দূরে সরিয়া থাকিবেন না ; বরং হাতে পায়ে ধরিয়া অনুনয়-বিনয় করিয়া ও নিজের দোষ স্বীকার করিয়া যাহাতে তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারেন তাহার ব্যবস্থা করুন”।

এমন মনগড়া বাক্যবিন্যাসে আমাদের প্রচলিত অনেক কিতাব আর তার অনুসারী আলেম-উলামারা যেসব নছিহত করেন, তা কিছুতেই নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয় না। মানুষ হলে তার ভালোমন্দ বোধ থাকবে, পছন্দাপছন্দ থাকবে।

কিন্তু আমাদের এই সব আলেম-উলামারা বলেন, “স্বামী বড় লোক হউক আর ছোট লোক হউক, ধনী হউক আর গরীব হউক, বিদ্বান হউক কি মূর্খ হউক, অন্ধ হউক কি কানা হউক, খঞ্জ হউক কি আতুর হউক, সুশ্রী হউক কি কুশ্রী হউক, সর্বদাই সন্তুষ্টচিত্তে তাঁহার পদতলে জীবনখানিকে লুটাইয়া দিতে থাকুন এবং সর্বদাই উভয়ে মিলে-মিশে মহব্বতের সহিত জেন্দেগী কাটাইতে” চেষ্টা করুন।

তাই আমার কাছে দেওবন্দের দেওয়া ফতোয়াটিকে মোটেও ব্যতিক্রম বলে মনে হয় নাই। তাদের থেকে শিক্ষা পেয়েই আমাদের বর্তমান কালের আলেম-উলামাদের একটা বিরাট অংশ আজ ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যাপারে ফতোয়া দিয়ে আমাদের সমাজজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন।
উনাদের বক্তব্য, ধর্মীয় পুস্তকের বক্তব্য, বক্তব্যের অতিরঞ্জন এবং মনগড়া কথার মাধ্যমে এ গ্রন্থ যেসব মতকে সামাজিকীকরণ করেছে ও করে চলেছে তা ভয়ানকভাবে নারীস্বার্থবিরোধী। এতদিনে আমাদের সমাজের এটুকু পরিবর্তন অন্তত সাধিত হয়েছে যে, নারী ও নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ক এসব মতকে আর অবশ্যপালনীয় বলে মনে করা চলে না। বাংলাদেশের সংবিধানও এসব মত সমর্থন করে না। এটি ও এ জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ দ্বারা মুসলিম সমাজের মধ্যে যে পশ্চাৎপদতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে, তা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৪০
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×