somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিন কালের সাক্ষী

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনের শুরুটা ভালোই ছিল, সূর্যস্নাত সকাল। তাই দেখে ভেবেছিলাম, প্রবাদবাক্যের কথাটাই হয়তো ঠিক—সকালই বলে দেয়, দিনটা কেমন যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না-যেতেই সে হিসাব বদলে যেতে শুরু করল। বান্দরবানের বালাঘাটা থেকে যখন হাঁটা শুরু করি, তখন ছিল রোদ। হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট ছড়ার ওপর সেতু পেরিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। আর আকাশেও মেঘ জমতে শুরু করল। পাহাড়ের সবুজ রং বদলে কালচে হতে শুরু করল। উঁচু সে পাহাড়ের চূড়ায় স্বর্ণমন্দিরের সোনালি শিখর ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে এল। বৃষ্টির আশঙ্কা, তবুও কুহালংয়ের পথ ধরলাম। পাশেই একটা টিনের ছাপরা মতো চায়ের দোকান। এর পেছনেই ঘোনাপাড়া গ্রাম।
ওখানে পৌঁছাতেই একজন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হলো। হাতে একটা ফুলের সাজি নিয়ে ফুল তুলছেন। কুশল জানিয়ে নাম জানতে চাইলে বললেন, নাম গুরুপদ দে, বয়স নব্বইয়ের ওপর। কথায় কথায় সেই প্রায় শতবর্ষী দাদুর সঙ্গেই আলাপ জমে ওঠে। এত বয়স, তবুও সোজা হয়ে হাঁটছেন, চোখে কোনো চশমা নেই, হাতে কোনো লাঠিও নেই। যা যা জিজ্ঞেস করছি, ঠিক ঠিক উত্তর দিচ্ছেন। তার মানে, কানেও কম শোনেন না। দাঁতও আছে। সামর্থ্যের রহস্যটা কী? জানতে চাইলে হেসে ফেলেন, বলেন, ‘বাপু রে, আমাদের জোয়ান বয়সে যা খেয়ে ফেলে দিয়েছি, তা এখন তোমরা চোখেও দেখো না। জোয়ান বয়সে সপ্তাহে এক পোয়া ঘি-মাখন আর দিনে এক সের দুধ খাওয়া ছিল বাঁধা। কাঁসার বাটিতে দুধে হাতের পাঞ্জা না ডুবলে খেতাম না। ফল যে কত খেতাম, তার কোনো হিসাব নেই। এখন কেউ একটা আম কেটে দুই ফালি আম খেতে দিলে রাগ হয়। আম খেতাম গামলা ভরে। নদীতে জাল ফেললেই মাছ উঠত জাল ভরে। কত আর খাব? এখন কি আর তোমরা এসব চোখে দেখো? তোমাদের শক্তিটা আসবে কোথা থেকে? আর যা খেতাম, তাতে ছিল না সাইত (বিষ)। সবকিছু টাটকা। এখন তো বাসি-পচা আর বিষ দেওয়া, ভেজাল দেওয়া খাবার খেয়ে তোমরা অম্বলের ব্যথায় মরচো। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলা—তিন কালই তো দেখলাম। কালে কালে কত যে ফারাক!’
গুরুপদ দাদুর কথায় চমক লাগে। এ রকম তিন কালের সাক্ষী এ দেশে নিশ্চয়ই আরও অনেকে আছেন। আলাপে আলাপে জানা গেল, দাদুর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের চন্দনাইশে। নদীভাঙনে সর্বহারা হয়ে চলে আসেন বান্দরবানের ঘোনাপাড়ায়। এখানেই চাষবাস করে বেশ আছেন। টুকিটাকি ব্যবসাও করছেন। আসার পর তাঁর অসিলায় আরও আত্মীয়স্বজনও এখানে চলে এসেছে। তবে এখনো মায়ের কথা ভুলতে পারেননি। মাকে তিনি পাহাড়ে আনতে পারেননি। রাত যতই হোক, মা ঠিকই জেগে থাকতেন, না খেয়ে বসে থাকতেন। বাড়ি ফিরলে যুবক বয়সেও মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতেন। পড়শিরা যে যা কথা দিত, সবাই সে কথা রাখত; সবাই খুব কম মিথ্যা কথা বলত। প্রতিবেশীদের মধ্যে যে সদ্ভাব ছিল, তা যেন এখন আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। কারও জামাই বাড়িতে এলে, সে হয়ে উঠত পাড়ার জামাই। আসল শাশুড়ি আর জামাইকে খাওয়ানোর সুযোগই পেত না। আর এখন কেউ জানেই না, কার মেয়ের কোথায় বিয়ে হলো। সেই মায়ের মমতা আর কুটুম-কুটুম পাড়া এখন নেই। সেসব দিন কোথায় যে হারিয়ে গেল!
ব্রিটিশ আমলে দাদুর স্মৃতিতে আমিও যেন হারিয়ে যাই। তারপর আবার ফিরে আসি পাকিস্তান আমলের কথায়। দাদু বলতে থাকেন, ‘চার আনা সের দুধ খেয়েছি, ১৬০ টাকা ছিল সোনার ভরি। দিন গেলে ১৮-২০ টাকা কামাই হতো। তার মানে আট দিনের কামাইয়ে এক ভরি সোনা কিনতে পারতাম। আর এখনকার কথা ভাবো! সারা দিন ছেলেরা খেটে কামাই করে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এক ভরি সোনা কিনতে ওদের না খেয়ে ছয় মাস টাকা জমাতে হবে।’
মেঘ আরও এঁটে আসছে। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর মুখটাও মেঘের মতো ভারী। ছেলেদের কথা জানতে চাইলে মুখটা আরও ভারী হয়ে ওঠে। তিন ছেলের এক ছেলেকে তিনি পাহাড়ে এসে হারিয়েছেন। তার মৃত্যু নিয়ে কোনো দিন কিছু বলতে পারেননি, বলবেনও না। বাংলা আমলের কথা জানতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে কেউ যে সাহস করেনি, এখন বাংলা আমলে এসে তা-ই দেখতে হচ্ছে। এখন অনেক কিছুই উন্নত হয়েছে, নাতি-নাতনিরা স্কুলে যাচ্ছে, চাকরি করছে। কিন্তু এ কোন কালে এলাম রে বাপু। এ কালে ডাকাতকে ডাকাত বলা যায় না। মানুষগুলো যেন আর আগের মতো সুন্দর নেই। দুর্নীতি ও প্রতারণা বেড়েছে বহুগুণ। মানুষ যেন বেশি রাগী হয়ে যাচ্ছে; মানুষের কেবল সম্পদ গড়ার নেশা। এসব করতে গিয়ে আমরা আসল অনেক সম্পদ হারিয়ে ফেলছি।’ এ কথা বলে দাদু চলে যান একটা টগর ফুলের কাছে। ফুলে শিশির জমেছে। ঠিক সে সময়ে নামল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল টগরের শিশির। দাদুর কষ্টের শিশির ধুয়ে গেল কি না বোঝা গেল না। তবে ভাবতে ভালো লাগে, এ রকম কোনো বৃষ্টিতে যদি দেশের সব কষ্টের অশ্রুবিন্দু ধুয়ে যায়, দেশটা হয়তো একদিন টগরের শুভ্রতা নিয়ে শুদ্ধ হবে।
http://digitalvillagebd.blogspot.com
মুলসুত্র্র: Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×