somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খোকা তো এলো না (কবিতা)

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই কবে খোকা যুদ্ধে গেলো!
যবার সময় বললো, ‘মা দোয়া করো,
দেশের মাঝে কিছু হায়েনা বেঁধেছে বাসা
তাদের না তাড়ালে যাবে না আর বাঁচা।’

আমি বললাম, ‘ওসবের মাঝে যাসনে বাবা
তোকে ছাড়া যে বুকটা সারাক্ষণ লাগে ফাঁকা!’

খোকা তখন বিস্মিত হয়ে বললো,
‘প্রতিদিন কতো মায়ের বুক ফাঁকা হচ্ছে জানো!
কতো স্ত্রী বিধবা হচ্ছে, কতো সন্তান এতিম হচ্ছে,
কতো বোনের সম্মান যাচ্ছে জানো!

আমি বললাম, ‘জানি না, জানতেও চাই না
তোকে ছাড়া আমি একমুহূর্ত থাকতে পারবো না।’

খোকা আমায় ধমকে দিয়ে বললো,
‘অমন করে বলো না তো মা, না গেলে আমার চলবে না।
এসব দৃশ্য আমি ঘরে বসে দেখতে পারবো না।’

খোকার বাবা ছুটে এসে বললো,
‘খোকার মা, ওকে দিচ্ছো কেনো বাঁধা!
ওরা ছাড়া কারা আমাদের ভরসা!
ওরা না গেলে হাতছাড়া হবে যে দেশটা!
পরাধীন দেশে বলো কোন ভিটেয় গুঁজবো মাথা।
যেতে দাও খোকার মা যেতে দাও ওদের,
তারপর অপেক্ষা করো নতুন একটা সূর্যের।’

খোকা আমায় কদমবুচি করে বললো,
‘এবার তাহলে আসি মা,
আমায় নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেবো না।
স্বাধীন বাংলার একটা পতাকা নিয়ে,
তোমার কোলেই আবার আসবো যে ফিরে।

সেকি মা! কাঁদছো কেনো মিছে!
তোমায় কাঁদতে দেখলে আমার,
বুকটা যায় যে ফেটে।’

খোকা চোখের পানি ছুঁয়ে বললো,
‘তোমার চোখের পানির কসম
ওদের আমি করবোই যখম।
তোমার কোলে আসবো ফিরে
স্বাধীন একটা বাংলা নিয়ে।
তুমি শুধু দোয়া করো জায়নামাজে বসে
ওদের সাথে যুদ্ধে যেনো উঠি আমি পেরে।’

তারপর খোকা চলে গেলো
গ্রাম পেড়িয়ে বহুদূর,
খোকার সংগে আছে কি
খাবার জন্য চিড়া-গুড়?
বুকটা আমার উঠলো কেঁপে
একি আমি করলাম শেষে,
খোকা কি তবে খালি হাতে
চলে গেলো গ্রাম পেড়িয়ে?

খোকা বলে চিৎকার দিয়ে
গেলাম ছুটে খোকার পথে,
একটু গিয়েই গেলাম থেমে
থাক, ডাকবো না আজ পেছন থেকে।
খোকা যাচ্ছে শুভ কাজে
যদি কোনো বিপদ ঘটে!
তাই তো আমি আসলাম ফিরে
খোকার সেই ছোট্ট ঘরে।

বিছানা-বালিশ সবকিছু এলামেলো
টেবিলেতে বই-খাতা ছড়ানো ছিটানো
আলনাতে জামা-কাপড় আছে ঝোলানো
দেয়ালেতে খোকার একটা ছবি টাঙানো।
সবকিছু দেখতে দেখতে ঠিক যখন পড়লো মনে
খোকা তো আজ যুদ্ধে গেলো সবকিছু ফেলে
বুকটা আমার তখনি উঠলো হুঁ, হুঁ করে
কান্নাটাকে চেপে রাখা গেলো না আর কিছুতে।

২.
একদিন একদিন করে বহুদিন গেলো কেটে
আমি আর খোকার বাবা আছি অপেক্ষাতে।
কবে যে এই দেশটা স্বাধীন হবে!
আমার খোকা আমার কোলে আসবে আবার ফিরে।
প্রতিদিনের মতো যখন যাই খোকার ঘরে
বুকের ভেতর কেমন যেনো চিন চিন করে ওঠে।
মনে হয় যেনো খোকা ছাড়া বেঁচে থাকাই মিছে
চোখের পানি আর কিছুতে পারি না আটকাতে।

একদিন, সকালবেলা, ছুটে এলো খোকার বাবা
বললো, ‘কোথায় গেলে খোকার মা, খবর আছে তাজা।’

আমি তখন চুলোর পাড়ে, ছুটে এলাম জলদি
‘কি খবর শুনি, খোকা ফিরছে নাকি?’

দেখলাম চেয়ে খোকার বাবার মুখে কেমন যেনো হাসি।

‘আর কোনো ভয় নেই, খোকা ফিরবে শিগ্গিরি
আর নাকি উঠছে না পেরে হানাদার বাহিনী।
কোনো মতো নাকি জীবন নিয়ে ছুটছে দিকে দিকে
আর দুদিন বাদেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।’

‘সত্যি বলছো তুমি শুনছি না তো ভুল!
স্বাধীন হবে দেশ, ফিরে পাবো কূল!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যি বলছি, স্বাধীন হচ্ছে দেশ
প্রতিক্ষার এই পালা এবার হবে শেষ।’

৩.
খুব সকালে খোকার বাবা রেডিওটা নিয়ে
মাদুর পেতে উঠোন মাঝে বসলো আরাম করে।
আমিও উৎসুক হয়ে বসলাম তাঁর পাশে
আজ মনে হয় দেশের খবর বলবে কিছু এতে।
খোকার বাবা অনেকক্ষণ ঘোঁচাঘুঁচি করে
কিছু একটা পেলো বুঝি অবশেষে।
সেখান থেকে কে যেনো উঠলো কথা বলে,
‘স্বাধীর বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে
আনন্দের এক খবর দিচ্ছি সকলকে
পাকিস্তানী মিলিটারি করেছে আত্মসমর্পণ
সেই সুবাদে বাংলাদেশ স্বাধীন এখন।’

খোকার বাবা লাফিয়ে উঠে চিৎকার দিয়ে বললো,
‘শুনলে খোকার মা, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’
‘তার মানে কি খোকা আজ ফিরে আসছে?’
‘আজ না এলেও কাল নিশ্চয় আসবে।’

‘এতোদিন ধরে না জানি কি কচু-ঘেচু খেয়েছে!
পাটিশাপটা খোকার খুব পছন্দের,
ওগো, যাও না কিনে আনো নারকেল।’
‘যচ্ছি’ বলে খোকার বাবা ছুটে গেলো হাটে,
মস্ত দুটো নারকেল হাতে ফিরলো খানিক বাদে।

৪.
খুব যতন করে পাটিশাপটা বানিয়ে
আমি আর খোকার বাবা আছি বারান্দায় বসে,
এই বুঝি খোকা আসছে ফিরে
স্বাধীন বাংলার একটা পতাকা হাতে নিয়ে।
পথের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে নেমে এলো রাত
তবুও খোকা আমার ফিরলো না আর।
স্বান্তনা দিয়ে খোকার বাবা বললো,
‘অস্থির হয়ো না খোকার মা, এখনো আছে সময়
হয়তো বা খোকা অনেক দূরে আছে
তাই বোধহয় ফিরলো না আজ, কাল ফিরবে নিশ্চয়।

পরদিন আবার পাটিশাপটা বানিয়ে,
বসে রইলাম বারান্দায় মাদুর পেতে।
এই বুঝি আসছে, এই বুঝি আসছে ফিরে খোকা,
মাঝে মাঝে চোখের কোণা দিয়ে পড়ে যায় জলের ফোঁটা।
তবুও খোকা ফিরে আসে না, ফিরে আসে না,
একে একে পেড়িয়ে গেলো সবকটা বেলা।
খোকার বাবা আবার স্বান্তনা দিয়ে বললো,
‘এতো চিন্তে করো না তো, নিশ্চয় ফিরবে খোকা।’

৫.
একদিন নয়, একমাস নয়, চলে গেলো বছর
তবুও খোকা আমার ফিরলো না আর।
আজও আমি খুব সকালে পাটিশাপটা বানিয়ে,
অপেক্ষা করতে থাকি খোকার জন্যে।
খোকার বাবা এদিক-ওদিক কতো খোঁজ নেয়,
কেউ জানে না আমার কোকা আছে কোথায়!
আমাদের এই পথ চাওয়া কবে হবে শেষ,
খোকার প্রাণ কি তবে যুদ্ধে হয়েছে নিঃশেষ?

খোকাই ছিলো আমাদের একমাত্র সন্তান
সেই যদি চলে যায়, কেমন করে বাঁচে প্রাণ?
খোকার বোন পরি মাত্র সাতদিনের মাথায়
হঠাৎ করেই চলে গেলো জানি না কেনো হায়!
এতোদিন তো পরির কথা পড়ে নি কারো মনে
আজ মনে পড়ে গেলো খোকা নেই বলে।
এসব ভেবে যখন আমি উঠি কেঁদে জোরে,
খোকার বাবা বলে, ‘কেঁদো না, ওরা কষ্ট পাবে যে!’
তারপর আবার স্বান্তনা দিয়ে বলে,
‘তুমি কেমন করে ভাবলে খোকা মরে গেছে!
খোকা ফিরবে, নিশ্চয় ফিরবে, আমি বলছি ফিরবে।’

কেমন করে মিথ্যে স্বান্তনা নিয়ে বসে থাকি!
একদিন নয়, একটা বছর যে চলে গেছে!
সবাই উল্লাসে উঠলো মেতে ১৬ ই ডিসেম্বরে,
শুধু আমার বুকটা আজও রইলো পড়ে খালি।
খোকার বাবা তবুও স্বান্তনা দিয়ে বলে,
‘খোকার মা, তুমি এতো ভাবছো কেনো মিছে?
খোকা ফিরে আসবে, আমি বলছি ফিরে আসবে।’

৬. (আরও বহুদিন পর)
গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠলাম আমি জেগে,
মনে হলো দূর থেকে কে যেনো আজ ডাকে।
আমি উঠে দরজা খুলে গেলাম বাহিরে
নিকষ কালো অন্ধকারে চোখে পড়লো না কাউকে।
খোকার বাবা উঠে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
‘কি হলো থোকার মা, বাইরে কেনো বের হলে?’
‘মনে হলো দূর থেকে ডাকলো কে যেনো!’
একটু থেমে পাশে ফিরে বললাম,
‘ওগো, এতোদিন হয়ে গেলো,
খোকা ফিরে এলো না তো!’

২৯ নভেম্বর, ২০০৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধে নিহত মনোজ দা’র বাবা

লিখেছেন প্রামানিক, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিয়ে থেতে ভাল্লাগে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৯

আমার বিয়ে বাড়ির খাবার খেতে ভালো লাগে। আমাকে কেউ বিয়ের দাওয়াত দিলে আমার খুসি লাগে। বিয়ের দিন আমি সেজে গুজে বিয়ে বাড়িতে আয়োজন করা খাবার থেতে যাই। আমাদের এলাকায় বর্তমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুর সামনের পাতার ৯টি পোষ্টে শুন্য (০ ) মন্তব্য।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০



আজকে সকালে একটু দেরীতে ( নিউইয়র্ক সময়, সকাল ৮:২১ ) সামুতে লগিন করলাম; লগিন করে আজকাল প্রথমে নিজের লগিন স্ট্যাটাস পরীক্ষা করি: এখনো সেমিব্যানে আছি। মোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

উসমানীয় সাম্রাজ্যের উসমান এখন বাংলাদেশে

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০



জনপ্রিয় ''কুরুলুস উসমান'' সিরিজের নায়ক Burak Ozcivit এখন বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছর ধরে তার্কির অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুলতানদের নিয়ে নির্মিত সিরিজগুলো বিশ্বব্যপী বেশ সারা ফেলেছে। মুসলিমদের মাঝেতো বটেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×