somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুদী ইউনুস, গ্রামীন ব্যান্ক এবং স্বপ্না দাদার স্বপ্ন

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল সাতটা।
আমাদের বাড়ির উঠানে মন্টুর বিচার বসেছে। বিচারক আমার আম্মু- যিনি গ্রামের প্রাইমারির হেডমিস্ট্রেস।
মন্টু সাহেব স্বপ্না দাদার এক মাত্র ছেলে। বয়স আট বছর।
মন্টু সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং তার বাবা! মন্টু সাহেব উঠানে এক হাতে কান ধরে ধরে দাড়িয়ে আছেন আরেক হাতে এক টুকরা পাটালি গুড়!
মন্টু সাহেব যে কানে ধরে আছেন এই নিয়ে তাকে বেশি চিন্তিত মনে হলো না, উনি আয়েশ করেই একটু পর পর মুখে গুড় চালান করছেন।
স্বপ্না দাদা হিন্দু, তিনি থাকেন আমাদের বাড়ির পাশের হিন্দু বাড়িতে। পেশায় রিক্সা চালক।
স্বপ্না দাদার ফামিলিগত সব বিচার আমার আম্মুকেই করে দিতে হয়। আমার আম্মুর উপর অনার অগাধ আস্থা!
যাই হোক, আজকের বিচারের বিষয়- মন্টু সাহেব সারাদিন দুষ্টামি করেন, উনি নাকি স্বয়ং গতকাল স্কুলের নাম করে বের হয়ে কোথায় গিয়ে গোল্লা ছুট খেলে এসেছেন!
স্বপ্না দাদা আম্মুকে বললেন- "দেখেনতো চাচী, এই পোলাডারে লই আই কোনাই যাইতাম? সারাদিন শয়তানি করে, লেয়া-হড়ার কোনো নাম গন্ধ নাই। আই যে হারাদিন রিক্সা চালাই, কার লাই চালাই? এইতে যদি আর দুক্ষ না বুঝে তাইলে কেমনে অইব কনচাই চাচি? আই হেতারে কই- তর রাসেল কাক্কা, রিফাত কাক্কার (আমি ও আমার ছোট ভাই)-দিকে চা, হেতেরা কোনো শয়তানি করেনি? মাইনষে হেতাগরে কত ভালা কয়।"

আমার আম্মু সব কথা শুনে রায় দিলেন- আজকে থেকে মন্টু সাহেব সকাল বেলা আমার আম্মার সাথে স্কুলে যাবেন এবং স্কুল ছুটির পর আমার আম্মার সাথেই বাড়ি ফিরবেন।

এই হলো আমাদের স্বপ্না দাদা! গরিব মানুষ কিন্তু তার নামের মতই তার জীবন স্বপ্নময় ছিল, অভাব অনটন হয়ত ছিল কিন্তু, বউ-ছেলে নিয়ে ছিল সুখের সংসার।
আমার সাথে ছিল ওনার খুব ভালো সম্পর্ক। একদিন আমাকে বলেছিলেন- রাসেল ভাই, আফনে সবার সাথে মিশেন, ধনী গরিব বাছেন না। দোয়া করি আপনে অনেক বড় মানুষ হইবেন।

সংসারের উন্নতির জন্য গ্রামীন ব্যাঙ্কের লোন নিয়ে দোকান দিলেন- এক বেলা দোকান চালান, অন্য বেলা রিক্সা। এভাবেই পরিশ্রমের মাধ্যমে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখছিলেন স্বপ্না দাদা।

একদিন তার মনে হলো- এত কষ্ট করেও যেন গ্রামীন ব্যাঙ্কের রৃন শোধ করতে পারছেন না, সকাল বিকাল পরিশ্রম করেও যেন সুধার পাগলা ঘোড়াকে থামাতে পারছেন না! এত চড়া সুধে রৃন নিয়ে কি ভুল করেছেন এই ভাবনায় বিভোর থাকলেন কদিন।

সেই স্বপ্না দাদার সংসারেও একদিন লাগলো কালবৈশাখীর ধাক্কা।
একদিন রিক্সা চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলেন, ভিটেটা ছাড়া জায়গা জমি ছিল না তার, ছিলনা জমা কোনো টাকা।
বৌদি এর কাছে ওর কাছে ছুটলেন। আমরাও সাধ্যমত সাহায্য করেছিলাম কিন্তু এত বিপুল পরিমান টাকা যোগাড় করতে শেষ পর্যন্ত আবার গ্রামীন ব্যাঙ্কের স্বরনাপন্ন হতেই হল।

সেই টাকা এবং গ্রামের মানুষের সাহায্যের টাকায় তার চিকিত্সা হলো।
কিন্তু বিধাতা যেন তার নামের সাথে মিল রেখেই সুখ-জিনিসটাকে স্বপ্ন করেই রাখলেন।

সুস্থ হলেন কিন্তু একটা পা অবশ হয়ে গেল সেই সাথে তার ইনকামের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।
গ্রামের মানুষতো যেটা সাহায্য করেছে সেটা দিতে হবেনা কিন্তু গ্রামীন বাংক থেকে যেটা ধার নিয়েছেন তাতো ফেরত দিতেই হবে। তার উপর চড়া সুদ। প্রাথমিক অবস্থায় যে টাকা রৃন নিয়েছিলেন তা হয়ত ফেরত দেওয়া যেত কিন্তু সুদের আসলে এই এক বছরে যে টাকার পরিমান দাড়িয়েছে তা কিভাবে শোধ করবেন আমাদের স্বপ্না দাদা?

তখন ছোট ছিলাম, দেখতাম স্বপ্না দাদা পুকুর পাড়ে বসে সবসময় কি যেন ভাবছেন, মন্টু স্কুলে যায় না, সারাদিন দুষ্টামি করে- তা নিয়েও কোনো ভাবনা নেই। রৃনের চাপে যেন মানুষটার সব অনুভুতি নষ্ট করে দিয়েছে।

তার পর আমি জাহাজে চলে আসলাম। আর কোনো খবর রাখতে পারি নাই তাদের। সুধু মাঝে আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি রৃনের টাকা শোধ করার জন্য দাদার রিক্সা এবং ভিটে বিক্রি করে কুমিল্লা শহরে চলে গেছেন।

# জুন'২০০৯-এর কোন একটা দিনে-

আমার জাহাজ চট্ট্রগ্রাম বন্দরে এসেছে, দুই দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। মনটা খুব ভালো। বেশ কিছু দিন পর ছুটি পেলাম।
বাস কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে থেমেছে, বাইরে তপ্ত রোদ।
আমি বরাবরই জানালার পাসে বসি। আজও বসেছি।
অনেক দিন পর জাহাজ থেকে আসলে যা দেখি তাই ভালো লাগে! এই যে এত মানুষের ভীড়, কোলাহল- সব কিছুই ভালো লাগছে আমার!
হকাররা সমুচা বিক্রি করছে মাথায় করে, যদিও এই সমুচাগুলো স্বাস্থ্য সম্মত নয় তবু এতদিন পর জাহাজ থেকে আসলাম এই সব নীতি কথার গুল্লি মারি আমি!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা হকার ক্রাচে ভর দিয়ে চিক্কার দিচ্ছে- এই সমুচা কিনবেন সমুচা!
আমি হকার কে পিছন থেকে ডাক দিলাম-এই সমুচা, এই এদিকে শুনো।
হকার এই দিকে মুখ ঘুরাতেই আমি চিনতে পারলাম- আরে! এ তো আমাদের স্বপ্না দাদা!!
আমি ডাকলাম- স্বপ্না দাদা, আমি রাসেল, চিনতে পারচ?
স্বপ্না দাদা আমাকে দেখে তার কষ্ট ক্লিষ্ট মুখটা আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠলো।
উনি বসে উঠে এলেন।
বাস ছাড়তে এখনো দশ মিনিট আছে।
তিনি কেন গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন জানতে চাইলে বললেন- "ভাই, র্রিনের টাকা শোধ দিতে গিয়াই রিক্সা বেচছি, ভিটা বেচছি কিন্তু গেরামে থাকলেতো না খাইয়া মরতে হইব, তাই বউ বাচ্চা নিয়ে এখানে এক বস্তিতে উঠছি। আপনের বৌদি আফনের কথা, চাচীর কথা কইয়া সারাদিন কান্দে। এইখানে সমুচা বেচি। কোনরকমে দিন চৈল্লা যায়।"

বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
স্বপ্না দাদা আমাকে ৫ টা সমুচা দিয়ে বললেন- "ভাই, দুইটা আপনে খাইয়েন আর তিনটা চাচীর জন্য নিয়া যান। জীবনে আমি চাচীর রৃন শোধ করতে পারুম না। ভাই, চাচীরে কইয়েন আমরা ভালা আচি।"
বলতে বলতে স্বপ্না দাদার চোখে পানি চলে আসলো।
আমি কিছু টাকা জোর করে স্বপ্না দাদার হাতে দিয়ে বললাম- "দাদা, আমি ছোট মানুষ, জীবন শুরু করেছি মাত্র, এই অল্প কটা টাকা রাখো। বৌদিকে, মন্টুকে নিয়ে ভালো মন্দ কিছু খেয়ো। আর আমি যখন জাহাজ থেকে অনেক দিনের ছুটিতে আসব তখন তোমাদের বাসায় বেড়াতে যাব। বৌদিকে আমার কথা বলো।"
বাস আবার চলতে শুরু করেছে। আমি ফেলে আসা মানুষটার কথা ভাবছি।
স্বপ্নময় স্বপ্না দাদার চোখে আজ দুঃস্বপ্নের আধার।
আপনারা যদি কখনো কুমিল্লার পদুয়ার বাজার যান হয়ত দেখবেন আজো একজন ক্রাচে ভর দেওয়া মানুষ- যার মুখটা আজ ভাবলেশহীন, এক হাতে একটা টুকরি নিয়ে অবিরাম বলে চলেছেন- এই সমুচা কিনবেন, সমুচা..
দেখতে পাবেন একটা স্বপ্নময় জীবনের মৃত্যু হলে মানুষ কিভাবে জীবনাম্মৃত হয়ে যায়।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:২১
১৪টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×