somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহীনের ঘোড়াগুলি – আমার প্রিয় ব্যাণ্ড……………

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পশ্চিমবঙ্গের গতানুগতিক সঙ্গীতের ধারার মোড় পাল্টে দেবার ইতিহাস যদি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তাহলে মহীনের ঘোড়াগুলির নাম সবার আগে উচ্চারিত হবে। সঙ্গীত জগতে ভিন্ন ধারার পসরা নিয়ে ছুটে চলা কলকাতার এক সাড়া জাগানো ব্যান্ডদল মহীনের ঘোড়াগুলি।

দলটির নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল সপ্তর্ষী। পরবর্তীতে ব্যান্ডের সদস্য রাজন ঘোষালের অনুরোধে দলটির নাম রাখা হয় মহীনের ঘোড়াগুলি। এই অদ্ভুত নামকরণটি করা হয়েছে জীবনানন্দ দাসের কবিতা ‘ঘোড়া’র দ্বিতীয় লাইন-‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। জীবনানন্দ তার সময়ের প্রচলিত সাহিত্যের ধারাকে ভেঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং বাংলা কবিতার ভাষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি রবীন্দ্র সাহিত্যের বলয় থেকে বের হয়ে এসে কবিতা রচনা করেছিলেন। মূলত তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতা পেয়েছিল নতুন এক ধারা। অনেকটা একইরকম উদ্দ্যেশ্য নিয়ে অর্থাৎ বাংলা মিউজিকে নতুন একটি ধারা প্রবর্তনের লক্ষ্যে দলটির নাম রাখা হয় মহীনের ঘোড়াগুলি। দলটির অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘ভালোবাসি জোৎস্নায়’ এর মাধ্যমে বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে বন্দনা করা হয়েছে। পুরো গানজুড়ে জীবনানন্দের পল্লী জীবন নিয়ে রচিত কবিতার স্পষ্ট একটি প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

কোনো নির্দিষ্ট ছকে তাদের সঙ্গীতকে বেঁধে রাখার অবকাশ নেই। বরং অসংখ্য প্রভাবিত অনুভূতির বর্ণিল সমন্বয় দেখা যায় তাদের গানগুলোতে। তাদের অনেক গানেই দৃঢ়ভাবে বাংলা ফোক সঙ্গীতের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাদের কিছু গানে মার্কিন শহুরে ফোক সঙ্গীতের প্রভাবও পাওয়া যায়। বাউল গান, লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে রক, পপ, জ্যাজ- প্রায় সব ধরনের গানই রয়েছে তাদের ভাণ্ডারে। এই বৈচিত্র্যই তাদের গানের মূল বৈশিষ্ট্য। আর শুরু থেকেই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শকদের জীবনমুখী গান উপহার দেওয়া।

এই ব্যতিক্রম নামধারী ব্যান্ডটির যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৭৪ সালের শেষদিকে কলকাতায়। সে সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্রের আধুনিক গানই ছিল শ্রোতাদের কাছে মূল আকর্ষণ। এছাড়াও ছিল রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতের আধিপত্য। আর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের গান। বাংলা পপ গানের এমন গতিহীন একটি সময়ে মহীনের ঘোড়াগুলির ব্যতিক্রমী পদচারণা দর্শক জনপ্রিয়তা অর্জনে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হলেও, তাদের অভিযাত্রা থেমে থাকেনি।

ব্যান্ডটির স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায় গীতিকার হিসেবে ছিলেন একদমই নতুন মুখ। তবে তার সমাজ ভাবনা ছিল বেশ আলাদা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। অনেকটা ষাটের দশকের বব ডিলানের মতো। মূলত সে সময় গৌতম একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা ছিলেন যার প্রতিফলন তাদের অধিকাংশ গানেই পাওয়া যায়। রাজনীতি, দারিদ্র, অর্থনীতি, অন্যায়-অবিচার, বিপ্লব, ভালোবাসা, একাকীত্ব, স্বাধীনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, যৌনপেশাসহ আরো বহুমুখী বিষয় নিয়ে গান করেছে মহীনের ঘোড়াগুলি। বর্তমানে কবির সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তের মতো শিল্পীরা জীবনমুখী গান করলেও, তাদের পূর্বসূরী এখনও মহীনের ঘোড়াগুলিই।

মহীনের ঘোড়াগুলির মূল লাইনআপে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন পিয়ানো ও বেহালাতে আব্রাহাম মজুমদার, বেইজ গিটার ও বাঁশিতে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বা বুলা দা, ড্রামসে বিশু দা বা বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়। দলটির সদস্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তিনি সবার কাছে মনি দা নামেই বেশি পরিচিত। ডাক নাম ‘মানিক’ থেকেই মূলত তার এই নামকরণ। তিনি ছিলেন একাধারে দলের গীতিকার, গায়ক, লিড গিটারিস্ট এবং স্যাক্সোফোন বাদক। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কণ্ঠ ও গিটারে ছিলেন তপেশ বন্দোপাধ্যায় বা ভানু দা। পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত হন রাজা ব্যানার্জি। রাজন ঘোষাল ছিলেন দলের আরেক গীতিকার। তিনি দলের হয়ে মিডিয়া রিলেশনের দিকটিও দেখতেন।
১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম অ্যালবাম ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক’। ১৯৭৮ সালে বাজারে আসে তাদের ২য় অ্যালবাম ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব’। একই বছর তাদের তৃতীয় অ্যালবাম ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’ বাজারে আসে।

ব্যান্ডটির অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘ভালোবাসি জ্যোৎস্নায়’ গানে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ ধারা বর্ণনা পাওয়া যায়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সুব্রত ঘোষ মনি দার বিশাল ভক্ত বনে যায় এই গানটি শোনার পর। সুব্রতর আগ্রহ দেখে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তাকে নিয়ে কাজ করেন মনি দা। কখনও নিজ ড্রইং রুমে, কখনও সল্ট লেকে, কখনও বা সল্ট লেক ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে বসে গান সৃষ্টি করেন মনি দা। এ সময়ই তার শ্রেষ্ঠ কিছু কম্পোজিশন ‘পৃথিবীটা নাকি’, ‘টেলিফোন’, ‘বাঙালি করেছে’র সৃষ্টি। মনি দা’র গান সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল পুরাতন ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নতুন কিছু করার।

মহীনের ঘোড়াগুলি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়নি। একটা পর্যায়ে ব্যান্ডের সদস্যরা ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। ১৯৮১ সালে ব্যান্ডটি পুরোপুরি ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিন্তু মনি দা হাল ছাড়েননি। মাঝে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। ১৯৯৪ সালে সুব্রত ও নীলের মানসিক সাহায্যের বদৌলতে তিনি মিউজিক ভিডিও বের করার উদ্যোগ নেন। সেটাই ছিলো প্রথম বাংলা মিউজিক ভিডিও। কলকাতা দূরদর্শনের ‘ভিডিও গান’ অনুষ্ঠানের জন্য মিউজিক ভিডিওটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মনের মধ্যে মহীনের ঘোড়াগুলিকে সবসময়ই লালন করে এসেছেন তিনি। দলটিকে আবারো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেছেন প্রতিনিয়ত।

অবশেষে ১৯৯৫ সালে তিনি আবারো মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে আবির্ভূত হন ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে। অ্যালবামের এই নামটি নেয়া হয় জীবনানন্দ দাসের একটি উদ্ধৃতি থেকে। অ্যালবামটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার বই মেলায়। অ্যালবামটি মাঝারি মানের হিট হলেও, নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত প্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয় এটি। পরবর্তী তিনটি বছরে একে একে বাজারে আসে মহীনের ঘোড়াগুলির তিনটি অ্যালবাম ‘ঝড়া সময়ের গান’ (৯৬), ‘মায়া’ (৯৭) এবং ‘ক্ষেপার গান’ (৯৮)। পশ্চিম বঙ্গ ছাড়িয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত তাদের গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যান্ডটি আর ধরে রাখতে পারেননি মনি দা। ব্যান্ডটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর মনি দা একাই তার সঙ্গীতের ভেলা ভাসিয়ে গিয়েছেন। পাশাপাশি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা, ডকুমেন্টারি তৈরিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

১৯৯৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে আকস্মাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন মনি দা। তার মৃত্যুর পর তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় অ্যালবাম ‘মনি ছাড়া শূন্য লাগে’। মনি দা’র লাইভ পারফর্মেন্স নিয়ে ‘গৌতম’ শিরোনামেও একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।

মহীনের ঘোড়াগুলির সাক্ষর সঙ্গীত ‘পৃথিবীটা নাকি’-এর কথার জন্য বেশ আলোচিত হয়েছে। টেলিভিশন সভ্যতার প্রকোপে পড়ে শহুরে মানুষগুলোর বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা গানটিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০০৬ সালে এই গানটির সুরে বলিউডি ছবি ‘গ্যাঙস্টার’ এর জন্য ‘ভিগি ভিগি’ শিরোনামে হিন্দী গান কম্পোজ করেন সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম চক্রবর্তী। বাংলাদেশের জেমসের কণ্ঠের এই গানটি পুরো ভারতজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বর্তমানে মহীনের ঘোড়াগুলির গানগুলো কভার সং হিসেবে অনেক শিল্পীই গাইছেন। তাদের মধ্যে এগিয়ে আছেন গড়ের মাঠ ব্যান্ডের সুব্রত ঘোষ। চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, লক্ষীছাড়া, ইনসমনিয়া সহ আরো বেশ কয়েকটি ব্যান্ড অহরহই মহীনের ঘোড়াগুলির গানগুলো গাইছে। এভাবেই নতুন শতাব্দীতেও নতুনধারার অভিযাত্রী হিসেবে আজও মহীনের ঘোড়াগুলির নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×