somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেতে যেতে সুন্দরবন (একটি ভ্রমণ বিষয়ক লেখা)

২৮ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভ্রমণ করাটা যত না আনন্দের, তা লিখে প্রকাশ করাটা তার চেয়ে ঢের কষ্টের। লিখতে বসে সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ট্রাভেল গাইডের মত গৎবাধা যাত্রা বিবরণ লিখব, নাকি “গহীন জঙ্গলে কয়েকদিন” নামক কোন উপন্যাস লিখে ফেলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। এমনিতেই লেখক হিসেবে আমার হাত অনেকটা বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমের টপ অর্ডার ব্যাটিং এর মত, লিখতে বসেই মনে হয় এখনই একটা বেস্ট সেলার উপন্যাস লিখে ফেলব কিন্তু দশ মিনিট পরই সেটা গরু রচনা টাইপ কোন লেখা হয়ে যায় (তবে আশা করি বাংলাদেশের টপ অর্ডার আর আমার লেখা খুব শীঘ্রই ভালো হবে)। আমার ঘুরাঘুরির যাত্রাটা খুব বেশি দিনের নয়, গত দেড় বছরেই বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে ফেলে মনে হল এবার লিখা যেতে পারে আমার ভ্রমণ বিষয়ক অভিজ্ঞতা গুলো। সেই ধারাবাহিকতায় এটা আমার ভ্রমণ বিষয়ক দ্বিতীয় লেখা, প্রথম লেখাটা কুষ্টিয়া ভ্রমণ নিয়ে View this link । ঘুরতে আমি বরাব্রই খুব ভালোবাসি, কিন্তু উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে জীবনের অধিকাংশ সময় ঘরের কোণে কেটে গেছে। তারপর হঠাৎ করেই এক ভ্রমণ গুরুর আবির্ভাব ঘটে আমার জীবনে আর সেই গুরুর হাত ধরেই ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি ট্যুর দিয়ে আমার ভ্রমণ জীবনের শুরু। মাঝে অনেক গুলো ট্যুর দিয়ে ফেলেছি, গুরুও দিয়েছেন কিন্তু আমি ও গুরু একসাথে আর কোন ট্যুর দিতে পারিনি। এক সপ্তাহ আগেই (২ নভেম্বর-৬ নভেম্বর, ২০১০) কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন ট্যুর দিয়ে ঝামা ঘষে গায়ের রঙ বদলানোর চেষ্টা করছি আর সামনের ঈদ ও মাসটা কিভাবে কাটাবো সেই চিন্তা করছি, তখনই গুরুর মেসেজ ঈদের পরদিন সুন্দরবন যাচ্ছি, যাবি নাকি? সামনে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা, হাতে টাকা-পয়সার টানাটানি, ট্যুর দিয়ে গায়ের রঙ পাতিলের তলা না হলেও তার কাছাকাছি কিন্তু সুন্দরবন আর গুরুর সাথে ট্যুর এই দুইয়ে মিলিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। পাতিলের তলায় আরেকটু প্রলেপ না হয় পড়লই, এইবারের পরীক্ষায় না হয় পরীক্ষার দুইদিন আগে থেকেই পড়াশুনা শুরু করব অন্য সময় তো একদিন আগেই করি। বন্ধুদের কাছে টাকা-পয়সা ধার চাইতে হবে কিনা সেই ভেবেই গুরুকে ফোন দিলাম, চার দিন-চার রাতের ট্যুর, মনে মনে পাঁচ হাজার টাকা হিসাব করে বসে আছি কিন্তু গুরু আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালেন ট্যুর হবে আড়াই হাজার টাকায়, এই অবস্থায় তো না রাজি হয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। ট্যুরের ক্ষেত্রে গুরুর দর্শন- দেখতে এসেছ, খেতে কিংবা আরাম করতে নয়, টাকা উড়াতে নয়। এটা আমারও দর্শন। ফলে গুরুর সাথে আমার ট্যুরটা ভালোই জমে।

ঈদের পরদিন সকাল ৯টায় ঢাকার শ্যামলী থেকে ‘সায়রা পরিবহন’ বাসে সোজা সাতক্ষীরা জেলায় পৌছে যাই বেলা সাড়ে চারটায়। ঈদে গরু কোপাকোপির পর সারা গায়ে ব্যাথা, বিশ্রাম নেয়ারও কোন উপায় নেই কারণ ট্রলারে করে সুন্দরবনের দুবলার চরে যেতেই লাগে দুইদিন। আর দুবলার চরে রাস মেলাটা হবে দুইদিন পরই সুতরাং পরে গেলে সুন্দরবন দেখা হবে কিন্তু রাসমেলাটা আর দেখা হবেনা। ঝামেলা আছে অন্যখানেও, সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে জলদস্যুর ভয়। একটু সচেতন থাকলে বাঘের হাত থেকে রেহাই পাবেন কিন্তু বন্দুক-রামদা সজ্জিত গহীণ জঙ্গলের জলদস্যু থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন। অন্য সময় সুন্দরবন যেতে চাইলে প্রতি বোটে কমপক্ষে দুইজন বন্দুকবাহী গার্ড নিতে হবে কোস্টগার্ড থেকে, তাছাড়া অনুমতি নেয়া, জঙ্গলের ঢোকার পাশ নেয়া আরো হাজারো ঝক্কি ঝামেলা। কিন্তু মেলা উপলক্ষ্যে হাজারো নৌকা একসাথে চলে বিধায় সেইসব ঝামেলা করা লাগে না আর মেলার সময়টায় জলদস্যুর উৎপাতও খুব একটা থাকেনা। এইসব মিলিয়ে ঈদের পরদিনই যাত্রা শুরু করে দিলাম, তাছাড়া চাকরীজিবী সফরসঙ্গীদের অফিসও খুলে যায় ঈদের পরপর। ঢাকা থেকে বিশজন, সাতক্ষীরায় গুরুর বন্ধু-বান্ধব আর মাঝি-মাল্লা, বাবুর্চি মিলিয়ে মোট পয়তাল্লিশ জনের একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে সাতক্ষীরার বিনারপোতার বেত্রাবতী নদী থেকে রাত দশটায় শুরু হল আমাদের “মিশন সুন্দরবন”।

সুন্দরবনে যাবার জন্য পয়তাল্লিশ জনকে বিশাল বলার কোন কারণ নেই কিন্তু মালবাহী মাঝারি আকৃতির ট্রলারে যখন পয়তাল্লিশ জনের থাকা, রান্না, খাওয়া এমনকি ছোট-বড় দুই ধরণের প্রাকৃতিক কর্মও করতে হয় তখন সেটাকে বিশাল না বলে আর উপায় থাকেনা। তাই বলে যে থাকা-খাওয়ার খুব একটা কষ্ট হয়েছে তা কিন্তু নয়। ট্রলারের সামনে মাটির চুলায় রান্নাবান্না হচ্ছে বাজার থেকে নিয়ে আসা মুরগি, মাছ, চাল, ডাল, মসলায়। একটা খাসীও সঙ্গী ছিল খাবারের উপাদান হিসেবে। তবে কষ্টটা বেশি করতে হয় পানির জন্যই, সারাটা সময় পানির উপরই আছি কিন্তু সে পানি খেতে পারছিনা; প্রথম কারণ পানি বিশুদ্ধ নয়, দ্বিতীয় কারণ পানি লবনাক্ত। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট হ্যালোটেব সাথেই ছিল কিন্তু লবনাক্ততা তো আর সেটা দিয়ে দূর হবেনা। তাই ট্রলারে উঠার সময় সবাই পাঁচ লিটারের পানির বোতল নিয়ে উঠি আর টুকটাক কিছু শুকনো খাবার কারণ সামনের দিন গুলোতে লোকালয় পেলেও খাবার কিনতে পারব সেই নিশ্চয়তা নেই, ছিলোও না। খাবার পানির কষ্টটা শুধু আমরাই নই ওই এলাকার সকল মানুষকেই করতে হয়। নৌকা করে অনেক দূরদুরান্তে থেকে তারা মিষ্টি পানি যোগাড় করে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধও এইসব ট্যুরে সঙ্গে রাখা দরকার কারণ ঢাকার আরাম আয়েশের জীবন থেকে নতুন একটা পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে গেলে শরীর তো বিদ্রোহ করতেই পারে। একবার ভাবুন তো আড়াই বাই আড়াই ফিটের একটা বাক্সে ঢুকে আপনি বড় ইয়ে করছেন, জানি বিশ্বাস হবেনা, চোখের সামনে এই টয়লেট দেখে তো আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি কিভাবে এখানে ইয়ে করা সম্ভব কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে আমার ভ্রমণ গুরু ৬.২ ফিটের জাওয়াদ ভাইও সেখানে প্রাকৃতিক কর্ম সেরেছেন অবলীলায়। নদীর পানি দূষিত হবার এটাও একটা কারণ কিন্তু কিছু করার নেই। দুই ধারে লোকালয়ের চিহ্ন নেই আর হাটু কাদা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে একসাথে তো আর সবার পক্ষে ইয়ে করা সম্ভব নয়। আসলে প্রয়োজনই মানুষকে সবকিছুতে অভ্যস্ত করে ফেলে। টানা চার রাত ইঞ্জিনের ঘটঘট শব্দে বাঁশের মাঁচা কিংবা ট্রলারের খোলা ছাদে চাদর মুড়িয়ে গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন অপরিচিত লোকজনের সাথে; খুব একটা সহজ কাজ নয় কিন্তু আমার সফর সঙ্গীরা ছিলেন অত্যধিক ভালো, চার-পাঁচ জনের সাথে আগে থেকে পরিচয় থাকলেও বাকিরা আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন না কিন্তু এই কয়েক দিনে মনেই হয়নি তাদের সাথে আমার এই ট্যুরেই পরিচয়। হাসি-তামাশা-ফাজলামি-বাদরামি যা কিছু করা যায় তার সবকিছুই করছি, বয়সে প্রায় অনেকেই আমার বড় কিন্তু বয়সের কোন বাধা ছিলনা এই ট্যুরে। সবাই খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া এর জন্যই জাওয়াদ ভাইয়ের সাথে ট্যুর দিয়ে খুব মজা পাই।

বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ এটা বুঝতে হলে আপনাকে একবার হলেও সুন্দরবন যেতে হবে। তিন-চার নদীর মিলনস্থল, শাখা-প্রশাখা, নদী-সাগরের মোহনা, নদীর এমন হাজারো উদাহরণ যেন সুন্দরবন। আর প্রতিটি নদীর নামই যেন বাংলা সাহিত্যের একেকটা অলংকার। এক নিশ্বাসে বাংলাদেশের দশটা নদীর নাম বলুনতো দেখি? জানি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এই বলেই মাথা চুলকাতে শুরু করেছেন (আরো কয়েকটা হয়তো বলতে পারবেন তবে দশটা নদীর নাম বলতে পারার লোক সংখ্যা খুব একটা বেশি হবে না)। সুন্দরবনের কিছু নদীর নাম শুনুন- বেত্রাবতী, খোলপটুয়া, মরগান, মাথাভাঙ্গা, আড়পাঙ্গাসি, কাসিঘাটা, খেজুরদানা, নয়াবেকি, আঠারোবেকি, রায়মঙ্গল, গাড়াল, মেঠিরমুখ, বুড়োমজদার, বেয়ালাকোয়ালা, মান্দারবেরি, কালিন্দিয়া, চুনকোড়ি, দাইরগাং, লেবুবুনি, পায়রাটোলি, শিপসা, ডুমুরিয়া, ঘড়িলাল, কয়রা, বেনীখালি, আমাদি, চরামুখো, বোয়ালমারি, পাখিমারি। নদী আরো অনেক আছে আর খালের তো কোন শেষই নেই, মাঝি নিজেও সব নদীর নাম বলতে পারলেন না।

এবার চলতি যাত্রা বিবরণীতে আসি, আমরা ট্রলারে উঠি ১৮-১১-২০১০ বৃহস্পতিবার রাত ১০ টায়। পরেরদিন শুক্রবার বেলা ১ টায় কদমতলী পয়েন্ট থেকে আমাদের জঙ্গলে ঢোকার পাশ নিই। পাশ মানে আমাদের বোটে কয়জন আছে, কোথায় যাবে এইসব তথ্য দিয়ে গভীর বনে ঢোকার অনুমতি। এমনিতেই হরিণ শিকারী, কাঠ পাচারকারীর কারণে জঙ্গলে নিরাপত্তা নেই আর উপরি হিসেবে জলদস্যুর ভয় তো আছেই তাই একটু সাবধানতা। সারাদিন কানের কাছে ঘটঘটানি ইঞ্জিনের শব্দ, রান্নার লাকড়ির ধোঁয়ায় চোখে জলুনি, টয়লেটে যাবার ভয়ে পেট চেপে বসে থাকা, প্রথম রাতে ঠিক্মত না ঘুমাতে পারার কষ্ট সব মিলিয়ে গোসল করার জন্য তার চেয়েও বড় কথা ডাঙ্গায় নামার জন্য সবার মধ্যে ছটফটানি কাজ করছে। অবশেষে দোবাকিয়া ফরেস্ট স্টেশনে হাটু কাদা মাড়িয়ে মিঠা পানির পুকুরে গোসল করে শরীরের ক্লান্তি দূর করলাম। ভাটার কারণে আপনাকে কোথাও নামতে হলে হাটু কাদা মাড়াতে হবেই। সেখান থেকে পুকুরের মিঠা পানি সংগ্রহ করে আবার বোটে উঠলাম। রাতে চাঁদের আলোয় বিশাল নদীতে দুই ধারের বনানী দেখতে যেন কোন ক্লান্তিই কাজ করেনা। আপনি কবি গোছের কেউ হয়ে থাকলে কমপক্ষে ডজন খানেক কবিতার বই লিখে ফেলতে পারবেন এই পরিবেশে। এই সারাদিনের যাত্রায় ক্যামেরার শাটার খুব একটা টেপা হয়নি, তোলার মত অনেক দৃশ্য থাকলেও অভিজ্ঞ সহযাত্রীরা বললেন ছবি তোলার জন্য আগামী দিন বরাদ্দ রাখুন কারন আপনার ক্যামেরায় চার্জ দেবার কোন ব্যবস্থা নেই যেহেতু বিদ্যুৎ নেই আর সুন্দরবন ক্ষনে ক্ষনে তার দৃশ্যপট পাল্টায়না। বিশাল সমুদ্রের মত একি রকম এই বিশাল বন। মাঝে মাঝে খাল চলে গেছে বনের ভিতর আর দুই ধারে কেওড়া, বাইন, সুন্দরী, গোলপাতার ছড়াছড়ি এই একই দৃশ্য, বোনাস হিসেবে বক, হরিণ, বানর, হরেক রঙের পাখি। তবে এই বিশাল বনে পাখি যত বেশি আশা করেছিলাম ততটা পাখি আসলে দেখিনি, গোলপাতাও দেখিনি খুব একটা। রাতে কাকাতুয়া পয়েন্টে অনেক ট্রলারের সাথে আমাদের ট্রলারও যাত্রা বিরতি দেয়, এটাই নাকি নিয়ম।

পরদিন মানে ২০-১১-২০১০ শনিবার ভোর চারটায় অন্য সব ট্রলারের সাথে আমাদের ট্রলার পুনরায় যাত্রা শুরু করে। গন্তব্য মংলা হিরণ পয়েন্ট এবং আমাদের আসল ভ্রমণ শুরু হয় এখান থেকেই। সকাল নয়টার ভেতরেই পৌছে যাই নীলকমল হিরণ পয়েন্ট যা কিনা ৭৯৮ তম বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান। ৬০১২ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল সুন্দরবনের ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার বিশ্ব ঐতিহ্য এর একটি অংশ যে বিশাল বনে আছে ৩৩০ প্রজাতির বৃক্ষ, ৪০০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী আর বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণ। হিরন পয়েন্টে নেমেই শুরু হয়ে যায় ছবি তোলার হিড়িক। সময় দেয়া হয়েছে এক ঘন্টা, দেরি হলে ভাটায় চরে আটকা পড়তে হবে তার মানে সারাদিন সেখানে বন্দী। নামার পর ওসব আর মনে থাকে নাকি, দৌড়ে দৌড়ে আশেপাশের ছবি তুলতে তুলতে, সরু রাস্তা ধরে হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে জঙ্গলের দিকে এগুতে লাগলাম। দুইদিন হয়ে গেল আর এতদিন পর কিনা জঙ্গলে পা দিলাম। মনে মনে একটা বাঘ মামা দেখার আশা করছি আর ভয়ে ভয়ে সবাই একসাথে হই-হুল্লোড় করতে করতে সামনে যাচ্ছি, এরই মধ্যে আমাদের সতর্ক করা হল গতদিনও এখানে বাঘ এসেছে তাই সাবধান থাকুন। তার একটু পরই সামনে দেখি বাঘমামার পায়ের তাজা ছাপ, বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষন আগেই মামা তার শরীর দুলিয়ে এই জায়গাটা পরখ করে গেছেন। সপাং সপাং মামার পায়ের ছাপের ছবি তুলে নিলাম আর সাথে আশপাশের ছবিও (কোন বিশেষ কারণে সুন্দরবনের মানুষজন বাঘকে সরাসরি বাঘ না বলে মামা বলেন)। সময় কম, দৌড়ে দৌড়ে চারপাশ দেখছি; মোবাইলের নেটওয়ার্ক তো নেই বহু আগে থেকেই, হারিয়ে গেলে যোগাযোগ করার কোন পথই নেই সুতরাং একসাথে থাকো। ঝটপট পুকুরে গোসল করে বোটে দৌড়ালাম, ইতিমধ্যে দু ঘন্টা শেষ করে ফেলেছি, আমাদের খোঁজ পড়ে গেছে, ভাটা নাকি শুরু হয়ে গেছে। কোনমতে বোটে উঠতেই হাজারো প্রশ্ন মাঝি্র। ধুর ঘুরতে এসে যদি বোটেই সারাদিন বসে থাকি তবে তো ঢাকার বুড়িগংগাতেই নৌকা নিয়ে বসে থাকতে পারি, তার জন্য সুন্দরবন আসার কি দরকার? আল্লাহর রহমতে ভাটায় আটকা পড়িনি, দূরে একটা ট্রলার ঠিকই আটকা পড়ে ছিল।

বেলা ১১.৩০ টায় যাত্রা শুরু করি আলারকোল দুবলার চরের দিকে তবে সরাসরি দুবলার চরে নয় পাশেই আরেক চর মেহের আলিতে। ওখানে সুন্দরবনের অনেক প্রভাবশালী ব্যাক্তি মেজর জিয়াউদ্দিন (অবঃ) সাহেবের বাড়ি আছে একটা আর কিছু দোকানপাট। মোবাইল ফোন করার ব্যবস্থাও আছে, পাঁচ টাকা মিনিট। জায়গাটা ছোট কিন্তু চমৎকার, বড়সড় পুকুরের মাঝে একটা দ্বীপের মত করে কিছু গাছপালা লাগিয়ে নাম দেয়া হয়েছে দারুচিনি দ্বীপ। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয়। মানুষের বসতি আছে, শুটকি মাছের বাজার আছে আর আছে একটা সাইক্লোন সেন্টার। বেলা ৩ টায় রওনা দিই দুব্লার চরের দিকে, মেলা উপলক্ষ্যে রাতে কীর্তন ও নৃত্যের অনুষ্ঠান আর কেনাকাটার অবাধ সুযোগ; মেলা উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান মেজর জিয়াউদ্দিন পোস্টারের মাধ্যমে সবাইকে এভাবেই মেলায় আসার আমন্ত্রণ জানান। আলারকোল দুবলার চরে মাছ ধরার জেলে আর শুটকি চাষীরা বাদে কোন লোকালয় নেই। তিন দিনের মেলা উপলক্ষ্যে সেখানে বছরের সেই পূর্ণিমাতেই প্রচুর হিন্দু ধর্মালম্বী সহ বহু পর্যটকের আগমন ঘটে। খুব ভোরে সমুদ্রের জলে স্নান করে রোগ ও পাপ মুক্তির প্রার্থনা করেন হিন্দু ধর্মালম্বীরা আর অবস্থাপন্ন হিন্দুগণ হাতে ফল-ফলাদির প্রসাদ নিয়ে সাগরের ঢেউয়ে বসে থাকেন, সাগরের ঢেউয়ে আস্তে আস্তে তাদের প্রসাদ ভেসে গেলেই তারা পূণ্যস্নান করে শুদ্ধ হন।

দুবলার সমুদ্র তীরটা খুবই সুন্দর, একপাশে সাগর অন্যপাশে গহীন জংগল। আশেপাশে কোন বসতি নেই, নেই কোন হট্টগোল। মাছ ধরার জেলেরা একটু পরপর ঝাকা ভরে সাগর থেকে মাছ ধরে আনছে, কিছু মাছ বিক্রির জন্য রেখে বাকি গুলো চলে যাচ্ছে শুটকির ঘেরে। মেলার কারণে হাজার হাজার নৌকা, জাহাজ সাগরের তীরে ভেড়ানো। আর মানুষ তো তার চেয়েও বেশি। রাতে দুবলার চরে থেকে আগামী দিন ভোরে পূণ্যস্নান দেখে ফিরব সুতরাং প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা নিয়ে বোট থেকে নেমে পড়লাম। মেলা দেখতে যেতে হলে সমুদ্রতীর ধরে পাঁচ-ছয় কিলো হেটে যেতে হবে, এমনিতেই হাজারো মানুষের ভীড়ে নিজেদের বিশজন একসাথে থাকা মুশকিল তবে আমাদের খুব একটা সমস্যা হয়নি। তালগাছ জাওয়াদ ভাইয়ের মাথা দেখেই আমাদের দিক-নির্দেশনা ঠিক রাখি। তবে আসল সমস্যা ছিল বোটের হদিস রাখা, হাজারো বোটের ভীড়ে নিজেদের বোট কোনটা হবে সেটা চেনাই মুশকিল। কেউ কেউ পতাকা, মাটির হাড়ি-কলস, লুঙ্গি-গামছা দিয়ে নিশানা দিচ্ছে; আমরা দিলাম পানির বোতল দিয়ে। নিচে নেমেই আবার হই-হুল্লোড় করে, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখে, দেশী-বিদেশী-স্থানীয় মানুষজন দেখে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সামনে এগিয়ে যাছি। একটা ডলফিন মাছকে মরে পড়ে থাকতে দেখলাম বীচে, বেচারা হয়তো কোন জেলের জালে ধরা পড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। অনেকক্ষণ হাটার পর মেলার আলোকসজ্জা দেখতে পেলাম। চরে বিদ্যুৎ নেই তাই জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলা থেকে নেয়ার মত কিছু পাওয়া গেলনা, সবই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। উপভোগ্য বলে যেটা ছিল তা হল রাতের বেলায় ফানুস উড়ানোর দৃশ্য দেখা, বড় বড় কাগজের ফানুস গুলো আগুনের ধোঁয়ায় শূণ্যে উড়ে যাচ্ছে দেখতে বেশ লাগে। মেলার একটা অংশে দোকান-পাট এবং অন্য অংশে মঞ্ছ প্যান্ডেল বানিয়ে নৃত্য দেখানো হচ্ছে আর সবচেয়ে ভীড় সেইখানেই; হওয়াটাই স্বাভাবিক, বিশাল বক্ষের স্বল্প বসনা নারী যখন তার দেহ দুলিয়ে উদ্দাম শব্দে উদ্দাম নৃত্য করে তখন তো ভীড় সেখানে হবেই। র্যাব-পুলিশ সজ্জিত ওই জায়গায় ভীড় ঠেলে খুব বেশি এগুতে পারিনি, দূর থেকেই দেখলাম গ্রাম-বাংলায় বিনোদনের নামে অশ্লীলতার প্রদর্শনী। একটু রাতেই শুরু হল কীর্তন সংগীত আর শেষে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বাংলা সিনেমার গান দেখানো। মেলা ভেঙ্গে যায় দ্রুতই, রাতে আবার বাঘের ভয় আছে। বাকি রাতটা কিভাবে কাটাবো বুঝে উঠতে পারিনা, সাগর তীরে বারবি-কিউ করে রাতের খাবার শেষ করে এগুতে থাকি বোটের দিকে; ঠান্ডাও পড়েছে বেশ আর আকাশের অবস্থাও ভালো না, বৃষ্টি হলে মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই নেই। গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ক্লান্ত শরীরে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই বোটের দিকে। ইতিমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন সঙ্গী বোটে চলে গেছেন, আমরা গিয়ে আর বোট খুজে পাইনা। তীরে যখন নেমেছিলাম তখন ছিল জোয়ার আর এখন ভাটায় নৌকা যে কোথায় চলে গেছে বুঝা যাছে না। মেঘে চাঁদ ঢেকে পুরো জায়গা অন্ধকার, অবশেষে অনেক খোজাখুজি-ডাকাডাকির পর বোটের দেখা পাই। বোটে উঠে শুনি আমাদের আগে আর কেউ বোটে উঠেনি। আবার শুরু হলো দুশ্চিন্তা আর বৃষ্টিও। বৃষ্টির কারণে বাইরে বের হওয়া যাচ্ছেনা আবার বাকি সঙ্গীরা কোথায় আছে তাও জানিনা, কোন বোট আশ্রয় দেবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ চুরির ভয় আর প্রতি বোটে জায়গা স্বল্পতা তো আছেই। খুব ভোরে বৃষ্টি শেষ হলে তীরে নামার মত আর অবস্থা থাকেনা, সাগরে ঝড় হয়েছে এবং যে কোন মুহুর্তে আবার বৃষ্টি আসতে পারে তাই তাড়াতাড়ি বোট ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের হারানো সঙ্গীরা ইতিমধ্যে কাকভেজা হয়ে ফিরে এসেছেন, কোন একটা হিন্দু পরিবারের ছোট্ট নৌকায় আশ্রয় পেয়েছিলেন এবং তারা এসেই ঘোষণা দিলেন এই বোটে আর নয়, ব্যাগ গুছিয়ে তারা চলে গেলেন মংলার ভাড়া যাওয়া জাহাজ ধরতে, শরীরের উপর তো আর কম অত্যাচার হয়নি। কি আর করা বোটের ছাদে দাড়িয়েই দেখলাম সঙ্গীদের বিদায় আর পূণ্যস্নানের দৃশ্য, ছবি আর তোলা হলোনা।

এবার ফেরার পালা, আসার সময় স্রোতের প্রতিকূলে ছিলাম বিধায় সময় বেশি লেগেছে। তাছাড়া জংগলের অনেক কিছু দেখার জন্য অনেক পথ ঘুরে গেছে ট্রলার। ফিরতি পথে তো আর সেই ঝামেলা নেই তাই অনেক সোজা পথে স্রোতের সাহায্য নিয়ে রাত ২ টার ভিতর পৌছে যাই আমাদের যাত্রা শুরুর সেই স্থানে। মাঝে খাসীটা উদরপূর্তি ও গোসল করার জন্য খুলনার হড্ডা নামক স্থানে যাত্রা বিরতি দিই শুধুমাত্র।

পরদিন অর্থাৎ ২২-১১-২০১০ সোমবার বেলা ২.৩০ টায় সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার বাসের ফিরতি টিকিট করা। সকালের সময়টা বসে না থেকে নসিমন করে চলে গেলাম যশোরের সাগড়দাড়িতে কবি মাইকেল মধুসদন এর বাড়ি, সাতক্ষীরা সদর থেকে দুরত্ব ১৬ কিলো তবে আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে ৯ কিলো দূরে। মরা কপোতাক্ষ নদে কবির বাড়ির স্মৃতি খুব বেশি আলোড়িত করেনা, তবে জায়গাটা বেশ গোছানো সরকারি তত্ত্বাবধানে আছে বলে এখনো টিকে আছে কবির কিছু স্মৃতি কিন্তু কবির স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন, কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে পুরো নদীটা যেন এক নর্দমা; বছর খানেক পর এই নদীর কোন অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

লিখে কিংবা ছবি তুলে কোন ভ্রমণের বিস্তারিত দেয়া সম্ভব নয়। এমন অনেক ব্যপার আছে যেটা শুধু নিজে উপস্থিত থেকেই দেখতে হয়। তবে যাই বলুন না কেন বাংলাদেশ এবং এই দেশের মানুষজন অত্যাধিক ভালো, দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমি কোন ট্যুরেই কারো অসহযোগিতা পাইনি। মানুষ গুলো এত আপনজন হয়ে যায় যে ভ্রমণের ক্লান্তি বা কষ্ট কোনোটাই আর মনে থাকে না, ইচ্ছে হয় বারবার ছুটে যাই সেই জায়গায়।

ইমরানুল হক রিতুল
২৫ নভেম্বর ২০১০, বৃহস্পতিবার
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:২৭
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×