somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার হাত

২১ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সন্ধ্যা থেকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে চামেলী। এই দরজা খোলা জীবনে এমন করে তার মন খারাপ হয়নি কোনোদিন। জোৎস্না মাসির হাত ধরে সে অনেকগুলো গলিঘুপচি পেড়িয়ে এই ঘরে প্রবেশ করেছিলো। তারপর থেকে তার ঘরের দরজা খোলা, যে আসে তাকেই সে সাদরে বরণ করে নেয়। কারও জন্যই নিষিদ্ধ নয় চামেলীর সুবাস-রঙ-রস। উজ্জ্বল বরণ, গড়ন আর বয়স কম বলে তার ঘরের দিকেই সবার নজর। চব্বিশ ঘন্টায় কতজনকে যে তার ঘরে নিতে হয় সেই হিসেব সে করেনি কোনোদিন। মন খারাপ করার একটুকরো অবসরও তার ছিলো না। আজকের অসহায় সন্ধ্যা তাকে ঠেলে দিয়েছে একাকিত্বের শামুক-খোলসে। চোখ জুড়ে এতো চাপ-চাপ অন্ধকার আর বুকের ভেতর ভারী নিশ্বাস জমেছিলো- তাকে ফাঁকি দিতে দিতে এই আঁধার সন্ধ্যার আগে কখনই বুঝতে পারেনি চামেলী। বালিশে মুখ গুজে চামেলী ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কান্না ও সন্ধ্যা একাকার।
চামেলীর ঘর ছেড়ে যাবার আগে মাতাল লোকটা পকেট হাতড়ে একশ টাকার দুটি নোট চামেলির ব্লাউজে গুজে দিতে দিতে বলেছিলো ‘তুই হিন্দু না মুসলমান এইটাই কইতে পারলি না বাপের নাম ঠিকানা কইবি কেমনে?’ মাতালটাকে চামেলী খুব ভালোভাবে চেনে। এমভি দিলবর শাহ লঞ্চের সারেং খয়বর আলী। ঘরে স্ত্রী, চার-পাঁচটা ছেলে-মেয়ে রেখে খয়বর আসে চামেলীর কাছে। দেশি মদের নেশায় চুর খয়বর আলী লঞ্চ চালানোর ভঙ্গি করে হাটলেও ঠিক ঠিক নানা বাঁক ঘুরে চামেলীর খুপরিতে এসে হাজির হয়। কোনো ঝামেলা না করে খাণিকক্ষণ চামেলীকে ওলটপালট করে মুখ বুজে চলে যায়। আজ সন্ধ্যায় খয়বরের মুখে বাবার কথা শুনে চামেলী আর বের হয়নি। অন্য যারা এখনও দরজা বন্ধ করার লোক পায়নি তারা মুখে কমদামি স্নো-পাউডার মেখে ব্লাউজের একপাশ তুলে দিয়ে অনুজ্জ্বল আলোয় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় তাদের দলে নাম লেখানোর কথা চামেলীরও। খয়বর আলী চলে যাবার পর চামেলীর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুন্য ঘর। ঘরবদ্ধ হাওয়ার ভেতর কেমন যেন হাহাকার ভর করে আছে- হাহাকার না গোঙানী? পরিচ্ছন্ন ফুল বিছানায় অগোছালো চামেলী, একা। মরিচা পড়া টিনের বেড়ার কোণে অলস টিকটিকি, কেনো যে তার লেজ নড়ছে! আর ঘরের ভেতর কাকে যেন, কি যেন খুঁজছে মেয়েটি- চামেলী। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় জানালার মাথায় কমদামী আঠায় সেঁটে থাকা ফটোগ্রাফে- ফটোগ্রাফটি রবীন্দ্রনাথ। ভেতরে হিন্দি-বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকার ছবির নর্দন-কুর্দন ভঙ্গীমার মাঝে শ্বেতশুভ্র রবীন্দ্রনাথের এই ছবি কি একটু বেমানান ঠেকছে? আচ্ছা, এখানে রবীন্দ্রনাথকে কে টেনে এনেছে? চামেলী হয়তো রবীন্দ্রনাথকে চেনে না। দরকারও নেই। তার বোধের পাটাতনে এখন কেবল খেলা করছে একটি শব্দÑ বা...বা...বাবা।
‘বাবা দেখতে কেমন। তার কি মুখ ভর্তি দাঁড়ি। পান খেয়ে খলখল করে হাসতে গেলে দাঁতগুলো তরমুজের বিচির মতো দেখায়?’ ভাবনাগুলো মনের মধ্যে নর্দমার কীট হয়ে মাথাচাড়া দিতেই খটকা লাগে। চামেলী আর এসব ভাবতে চায় না। সে চায় একবার হলেও বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতে। শুধু একবার দুই হাত দিয়ে বাবাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। কেনো? বাবার কাছ থেকে সে কি সামান্য কিছুও পেয়েছে? জন্মপ্রক্রিয়ার শেষ আনন্দ নিয়েই বোধহয় বাবা ভুলে গেছে সব। চামেলীর ভাবনা বিকেলের সোনারোদ, মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। গাঢ় অন্ধকার থেকে কারও অচিন কণ্ঠস্বর শোনে চামেলী- ‘তোর জন্ম আমাদের সকলের পাপে। আমরা তোর বাবা।’ ভাবনায় খেই হারায় আঁধার পাড়ার এই মেয়েটি। একজনের এতো বাবা কিভাবে হয় তা জানে চামেলী। তার কান্না পরিচয়ের সুতো ছেঁড়া লাটাইহীন ঘুড়ি- মেঘের সাথে খেলা করতে পাড়ি দেয় যোজন যোজন পথ।
চামেলীর ঘরের দরজা বন্ধ দেখে জোৎস্না মাসি হাসতে হাসতে বলে- ‘কিরে একটারে কি পাশে শুয়াইয়া রাইখা আরেকটারে হান্দাইছস।’ মাসির কথা চামেলির কানে পৌঁছায়না আজ। অন্যদিন হলে চামেলীর চটপটে জবাব হয়তো এমন হতে পারতো-‘যা করার চামড়া ঝুইলা পড়ার আগেই করতে হইবো মাসি, তাই আর কি করা- দুই একটারে খাটের নিচে রাইখা দেই যাতে অবসর না থাহে।’ আজ চামেলীর মুখে কোনো কথা নেই। কেবল চোখের পাতা ভেজা। চোখের জল-রঙ চুইয়ে ছবি হয়Ñ হাজার ছবি আকৃতি ভেঙে বিকৃতির সীমানায়। বাবা থাকে না তাতে।
এই পল্লীর নিস্তারী বেগমকেই মা বলে জানে চামেলী। নিস্তারী বেগমের সাথে চামেলীর সম্পর্ক খুব ভালো নয়। এই ঘরে আসার পর খুব একটা যাতায়াতও নেই নিস্তারী বেগমের ঘরে। জোৎস্না মাসি বলেছে- চামেলীর জন্মের আগে তার মাও এই পল্লীতে ছিলো না। ঢাকা শহরে এক বাড়িতে বুয়ার কাজ করতো। বয়স আর শরীর সমানতালে বেড়ে ওঠায় সেখানে নিস্তারী বেগমের নিস্তার মেলেনি। এক কণা পুরুষানন্দ দেহে ধারণ করে নিস্তারী ফিরে আসে বাবার বাড়ি। দরিদ্র বাবা নিস্তারী বেগমকে ফিরে পেয়ে আহলাদে আটখানা না হয়ে বিচলিত হয়। সময়ের হাতধরে বেড়ে ওঠে ক্ষুদ্রভ্র“ণ কণা... কানে কানে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তারীর মাতৃবার্তা। ‘মাইয়ার জামাইতো দেখাইলানা কছর মুন্সী, নাতী হইচ্ছে শুনলাম!’ কছর মুন্সী বানিয়ে বানিয়ে জামাইয়ের গল্প বলে। তবে অলীক জামাইয়ের গল্প বললেও কছরের বুক থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কেনোনা সে জানে নিস্তারীর বুকে পাপের সাগরের ঢেউ- নিস্তারী পাপের সাগরে ঢেউ।
সেবার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিস্তারী বেগম মহাপাপী হয়ে হত্যা করে ভ্র“ণ। এরপর ক্ষোভে রাগে সে চলে আসে গোয়ালন্দ ঘাটে। ঘাটের হোটেলে রান্নার কাজ নিয়ে ভালোই ছিলো দিন কয়েক। কিন্তু ভরা যৌবন আর পদ্মা নদীতে জাল ফেলবার মানুষের অভাব হয় না। হাত বদল হতে হতে তার ঠাঁই মেলে বুবলি মাসীর ঘরে।
চামেলীর আয় রোজগার ভালো বলে অন্যদের মতো নিস্তারী বেগমও তাকে হিংসা করে। নিস্তারী চামেলীকে মেয়ে বলেও মাঝে মাঝে স্বীকার করে না। এখানে অন্য যাদের জন্ম- যারা খোলা দরজা সমিতির সদস্য তাদের মাও একই ভাবে অস্বীকার করে সম্পর্ক।
সন্ধ্যার পর কেউ কারও খোঁজ নেয় না এখানে। ঘরগুলো থেকে ভেসে আসা হিন্দিগানের সুর এবং দেশি মদের উৎকটঘ্রাণ একাকার হয়ে গন্তব্য হারায়। প্রসাধনের নামে যে রঙ মুখে মেখে ওরা দরজার সামনে দাঁড়ায় সেই রঙ চেটে খাওয়া মানুষগুলোর হল্লা শোনা যায় মাঝে মাঝে। মাতালগুলোই বেশি ঝামেলা করে। একজনের ঘরে যেতে যেতে আরেকজনের হাত ধরে টান দিলে ঝগড়া বাধে প্রতিরাতেই। আজ রাতেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। শুধু একটি ঘরে আলো নেই, আলো আঁধারের খেলা নেই। চামেলী অন্ধকার রাজ্যে রানী মহারানী হতে হতে ভিখারী হয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বালিশের কোণ চুইয়ে চোখের জল বিছানার চাদরে গিয়ে মিশছে। শুষে নিচ্ছে কার্পাস তুলো কিংবা ফ্যালনা গার্মেন্টস সুতো। শোয়া থেকে উঠে বসে সে। অন্ধকার হাতড়ে খুঁজে পায় মদের বোতল। খাণিকটা এখনও বাকি। খাটের মাথার দিকে একটা ছোট্ট চারকোনা প্যাকেট। তাতে নারী ও পুরুষের গভীর আলঙ্গীন কিংবা চিতা বাঘের ছবি। আলোহীনতার মাঝেও চামেলীর বুঝতে অসুবিধে হয়না কিছুই। এই ঘরেই তার কেটেছে নয় বছর, হয়তো আরও বেশি হতে পারে। এই আয়োজন উপকরণ সব বিনোদন সামগ্রী।
বন্ধ দরজায় এবার কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায় । সে ভীত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। আবার ফিরে আসে। ‘কিডা আইছেন ফির‌্যা যান আইজ।’ আবারও কড়া নাড়তে শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে চামেলী। ‘আমার কথা কি কানে যায় না, যদি আমার বাজান হয়া থাকেন তাইলে আসেন।’ দরজা খুলে দেয় চামেলী। সাদা-কালো গোঁফ বাগিয়ে কুৎসিত হাসি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে একজন। ‘এতো দেমাগ কেনরে চামেলী’ নাহয় দুইদিন পরে আইলাম তাই বইলা ফিরায়া দিবি’ বলেই লোকটা বিছানায় লাফিয়ে ওঠে। চামেলী সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেয় ঘরে। বিদ্যুৎ ঝিলিকে লোকটার চোখে ধাঁধা লাগে। চামেলী সোজা লোকটার চোখে চোখ রাখে। কাঁপা কণ্ঠে বলে- ‘যদি আমার লগে শুইবার চান তাইলে স্বীকার করতে হইবো আপনে আমার বাপ। আইজ ট্যাহা নিয়া কাম করুম না বাপ বইলা স্বীকার করলেই....।’ চামেলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা তড়াক করে বিছানা থেকে নামে দৌড়ে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে হোঁচট খায়। চামেলী তাকে জাপটে ধরে- ‘বাজান, কই যাইতাছেন’। হতবিহ্বল লোকটা চামেলীর বুকের মধ্যে হাঁসফাঁস করে ওঠে। ‘কি কইতেছস, কেডা তোর বাজান, বাজান হইলে কি তোর কাছে আসি।’ চামেলী তাকে বিছানায় ফেলে আবারও জাপটে ধরে। ‘কাম শ্যাষ কইরা কইয়া যাইবেন তোর বাপের ঠিক নাই তা হইবো নাÑ আইজ কেডা আমার বাপ তার পরিচয় জানবার চাই।’ চামেলীর কথার উন্মত্ততায় সুযোগ পেয়ে লোকটা বলে, ‘হেইডা আমারে কেন তোর মায়েরে জিগা।’ ফেরি ঘাটের কুলি সর্দার কুন্টু মিয়া চামেলীকে কথাটি বলে মনে মনে ঘর থেকে বের হবার পথ খুঁজতে থাকে। চামেলী কুন্টু মিয়ার মুখ দুই হাতে আগলে ধরে জানতে চায়- ‘বাজান তোমার কি একটুও মায়া হয় না, আমার কাছেই আসো রাতের রাখাল হতে। তুমি এতো কেন পাষাণ বাজান। একবার দেখো- এই চামেলী তোমার মেয়ে, তোমারই তো মেয়ে।’ কুন্টু মিয়া এর কোনো জবাব না পেয়ে অনেকটা হতাশ কণ্ঠেই বলে ‘রোজ রাইতে আমিই আসি মাতাল হইয়া, তয় আইজ দেহি তুই নিজেই মাতালÑদুই মাতালে মিলতে গেলে গোল বাঁধবেরেÑ আমি যাই।’ এরপর কুন্টু মিয়া তাড়া খাওয়া কুকুর Ñ কুকুর হয়েই দৌড়ে পালায়।
মাঝরাত। চামেলী নিস্তারী বেগমের দরজায় কড়া নাড়ে। ভেতরে এক সদ্য যৌবনাগতের কণ্ঠ। স্পষ্ট শুনেও চামেলী দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ে। নিস্তারী বেগম খাকারি দিয়ে বলে ওঠে ‘দরজা বন্ধ দেইখাও বুঝেন না কিছু ,নয়া আইছেন নাকি।’ চামেলী এখন খুব শান্ত অথচ তীব্র কণ্ঠÑ ‘আমি চামেলী, বাপের পরিচয় জানবার চাই।’ ‘কি যে ঝামেলা কর না নিস্তারী, কার বাপ কে দিবে পরিচয়Ñ যত্তসব খানকির কারবার।’ ভেতরে থাকা যুবকের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শোনা যায়। নিস্তারী দরজা খুলে দিলে এক খণ্ড ঝড় হয়ে ঘরে ঢুকে চামেলী সোজা তার মাÑ মানে নিস্তারী বেগমের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ক্রুদ্ধ চোখ দুটি এক লহমায় গিলে খাবে সবÑ ‘আমার বাপের হদিশ সবাই বলে তুমিই জানো। যদি জানো তো আমারেও জানাও।’ ‘তোর বাপ কি গুপ্তধন, তারে লুকাইয়া রাহা যায়-’ এই কথায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে চামেলী। ‘তাইলে কও- কে আমার বাপ, কি নাম, কোনহানে নিবাস।’ নিস্তারী চুপ করে থাকে। মাঝরাতে মা-মেয়ের ঝগড়ায় এগিয়ে আসে জোৎস্না মাসী। ‘কিরে চামেলী, হঠাৎ বাপের কি ঠ্যাকা পড়লো। তোর বাপ কি তোরে বুকে আগলাইয়া নিবো, এই জনমে আর বাপের হদিশ কইরা লাভ নাইরে বেটি।’ চামেলীর ক্ষোভ এবার জোৎস্নার ওপর- ‘বাপ ছাড়া মানুষ আর জন্তু জানোয়ারের ফারাক নাই মাসী। মানুষের সমাজ থেইকা তোমরা আমারে জন্তুর সমাজে আইনা ফালাইছ। আমি আর মানুষ নাই মাসী। তোমরাও মানুষ না...’ বলতে বলতে নিস্তারী বেগমের ঘর থেকে সে একছুটে বেড়িয়ে আসে। তাকে অনুসরণ করে জোৎস্না মাসী। ‘বাজান তোমার দেহা চাই, জানতে চাই তোমারে- বাজান তোমার দেহা চাই, জানতে চাই তোমারে...’ চামেলী গন্তব্যহীন দৌড়াতে থাকে। জোৎস্না মাসি ছোটে পেছনে পেছনে। চামেলী- একটি ঘূর্ণী হাওয়া, হতে পারে ঝড়ই তার পরিণতি।
উচ্চকণ্ঠ চিৎকারে নিশিথ রাতের নিরব পতিতা পল্লাী মগ্নতা ভেঙে জেগে ওঠে। ‘কি হলো কি হয়েছে?’ অনেকগুলো বন্ধ দরজা খুলে যায়। কারও কারও প্রশ্নের জবাব দেয় জোৎস্না মাসী। মধ্যরাতে শুনশান মাতাল পল্লাীতে নেমে আসে মৃত্যু শোক।
একে একে অনেকেই জড়ো হয় চামেলীর ঘরের সামনের সরু পথে। সবাই নিশ্চুপ। শুধু একা থেমে থেমে চিৎকার করছে চামেলী। ‘যারা জানতে চায় আমার বাপের হদিশ, আমারে বলে খানকির ঝি তারাই আমার বাপ। দুনিয়ায় সবার বাপ থাকলে আমারও আছে, আমার বাপ সভ্য সমাজেই আছে। ঘাটের কুলি কুন্টু মিয়া, সারেং খয়বর শাহ, দোকানদার হরিপদ দাশ, মন্টু মহাজন কেউই বাদ নাইÑ সবাই আমার বাপ.... আমারে বলে খানকির ঝি...দুনিয়ায় সবার বাপ থাকলে আমারও আছে....।’ এসময় জোৎস্না মাসী ধমকের সুরে জড়ো হওয়া সকলকে তাড়িয়ে দিতে দিতে বলে- ‘মাগিরা তামশা দেখতে আইছো, তোমাগো মনে লয় বাপের ঠিক আছে- এইহানকার কারও বাপের ঠিক নাই- চল চামেলী, মা- ঘরে চল।’ পাগলপ্রায় মেয়েটিকে কোনোভাবে টেনে হেঁচড়ে ঘরে নিয়ে আসে জোৎস্না মাসী। চামেলীর কণ্ঠ থেকে তখন আর আওয়াজ বেরুচ্ছে না। বুকের চাপা কান্না গলা দিয়ে নিঃশব্দে বেরুতে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে মাত্র। জোৎস্না মাসী তাকে আদর করতে করতে বলে- ‘এই পল্লীতেই তোর জন্ম, তোর মা চার বছর বয়সে তোরে পাটুরিয়া ঘাটে ফালাইয়া আসছিলো- যদি কেউ মানুষ করে সন্তান মনে করে; তা হয়নাইরে চামেলী। ঘাটের নজু মুন্সী তোরে দিয়া কাম করাইছে বছর কয়েক। পরে শরীল বাড়লে মুন্সী হাত দিছে, দিছে আরও অনেকেই। মাগনা মাগনা শরীলডারে শ্যাষ করতেছিলি বইলা আমিই তোরে এইহানে আনি। আমারই দোষ... পদ্মা নদীর পাড়ে বড় হইছস। এহন তুই নিজেই পদ্মা- পদ্মার ঘাট। সক্কলেই খালি পারপার হইতে আসে... জাইলা নাও আর ফেরি সবই তুই ভাসায়া নিবি, পদ্মার কি আর বাপ থাহে?...’


সন্ধ্যায় এখনও চামেলীর (কার্ড নং ০৯৫৪) ঘরে আলো জ্বলে। একই রকম ফুল বিছানা। দেশি মদের গন্ধে হিন্দিগানের চটুল সুর ভাসে। তবে ঘরের সেই রবীন্দ্রনাথের ছবিটি ঢেকে গেছে কোনো হিন্দি নায়িকার বক্ষপিঞ্জরে। এখন যারা যারা ওর ঘরে সওয়ার হয়, প্রত্যেককেই চামেলী বাবা বলতে চায়, বাবা বলে ভুল করে। কিন্তু বাবার হাতটি যে তার দিকেই এগিয়ে আসছে...।

৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×