somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অর্বাচীন বিজয়মাল্য ( The lame gift )

১৬ ই নভেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হ্যাঁ ; তিনি রাস্তায় থাকেন।



এক ছেলে পোষ্টঅফিসের কেরানী। সেখানেই থাকতেন। ছেলের সামান্য আয়। নিজেরই সংসার চলে না। তার উপর পিতার ভার বহন করা। বৃদ্ধ বাবা আশা করেছিলো হয়তোবা ছেলে একসময় তাকে কোনো বৃদ্ধাশ্রম-এ দিয়ে আসবে। অথবা আর কিছু না পারুক নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলবে। কিন্তু চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে আসতে হবে তা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু তাই হয়েছিলো।



বয়স হয়েছে ইদ্রিস সাহেবের। অবশ্য একজন রাস্তার শতচ্ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত মানুষকে সাহেব বলা যাবে কিনা এ ব্যাপারে অনেকের অনেক আপত্তি থাকবে। তারপরও তার অতীত বংশগৌরব তাকে এখনো পদপিষ্ট হতে দেয়নি সমাজের ধন্যাট্য মানুষগুলোর।



সবকিছু তিনি মনে করতে পারছেননা। যতদূর মনে পড়ে – তিনি সেদিন ছেলের বাড়ির বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলেন। শীতের রাত। হঠাত তার ছেলের বউ এসে তার ঘুম ভাঙ্গালো। এরপর আরো কি কি ঘটেছিলো মনে পড়ছে না – শুধু মনে পড়ছে বৌমার সোনার বালা হারিয়েছিল – ঘরে আর কেউ না থাকায় সন্দেহটা ওই বৃদ্ধ-বাপটার উপরই পড়ে। তাকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছিলো সেদিন। তবে সবচেয়ে যেটা তাকে বেশী আঘাত করে; তা হলো নিজের ছেলে যখন বউটার কথা শুনে তাকে চোর বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলে সে সময়টা; তখন মনে হচ্ছিলো যদি তাকে তার ছেলে লাথি দিয়েও বলত- বাবা তুমি চোর নও; তাও ভালো ছিলো।



সবই ছিলো তার। মেঘনার পাড়ে বিঘা-বিঘা জমি আর বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। ঠিক কত বিঘা জমি তিনি পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন তা ঠিক মনে করতে পারছেন না। ঘরে ছিলো প্রেমময়ী স্ত্রী। দু’জনের ভালোবাসার সংসারে ছিলো পাঁচটি সন্তান। চার ছেলে আর ছোট একটা মেয়ে। আর্থিক সমৃদ্ধি যেমন ছিলো- তেমনি ছিলো মনের অনাবিল প্রশান্তি।



এরপরে কি হয়েছিলো তা ভুলবার নয়। মাঝে মাঝে ভুলে যান; তবে দুই হাতের কবজি অবধি পোড়া দাগ তাকে মনে করিয়ে দেয় বারেবার- তিনি এই দু’হাত দিয়ে নয় মাস স্টেনগান চালিয়েছেন।



হ্যাঁ- মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হারিয়েছেন তার স্ত্রীকে; বড় তিন ছেলের সারিবদ্ধ লাশ তিনি নিজের হাতে কবর দেন মেঘনার পাড়ে। যে মাটিতে নিজ হাতে ফসলের বীজ পুতেছেন- সেখানে সেদিন তাকে চাপা দিতে হয়েছিল আদরের সন্তানদের ছিন্নভিন্ন লাশ। হানাদারদের কবল থেকে রক্ষা পায় তার তিন বছরের ছোট ছেলেটা আর দুই মাসের মেয়েটা। সন্তানদের নিয়ে তিনি চলে যান বর্ডার পার হয়ে শরনার্থী শিবিরে। দেশে ফিরে এসে শুরু করেন যুদ্ধ। না- দেশপ্রেম কি জিনিস তিনি যানতেন না। তার মধ্যে ছিলো কেবল স্বজন হারানোর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা।

স্বাধীনতার পর তিনি চলে যান শরনার্থী শিবিরে পুত্র কন্যার খোঁজে। পাবেননা ভেবেই গিয়েছিলেন; কিন্তু স্রষ্টার অপার করুণায় তিনি ফিরে পেলেন তার জীবিত দু’সন্তানকে। ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে কন্যার নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে তাকে রেখে এলেন পশ্চিম-বাংলার এক ভারতীয় পরিবারের কাছে। ইচ্ছা ছিলো দেশে এসে যদি সব ঠিক করতে পারেন তবে নিয়ে আসবেন তার কন্যাকে।



দেশে আসার পর গুছিয়ে নিচ্ছিলেন আবার নিজের জীবনটাকে। ছেলেটাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আবার তার ক্ষেতে বুনলেন ফসলের বীজ। কিন্তু আরেকটি ঘটনা আবার তার জীবনকে এলোমেলো করে দিলো। পঁচাত্তরের আগষ্ট।



সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কাপুরুষগুলো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। যুদ্ধে পরাজিত রাজাকারেরা আবার এক হয়ে এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকলো। ইদ্রিস সাহেবকেও সেদিন স্বাধীন বাংলার বুক থেকে নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিলো। সেটা দখল করে নিয়েছিলো ঐ এলাকার আল-বদরের চীফ।



এখন অবশ্য ইদ্রিস সাহেবের এখন এসব নিয়ে তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। যেখানে নিজের সন্তান পিতাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়- সেখানে দেশের সাথে বেঈমানী তার কাছে আর কিএমন বিবেচ্য বিষয়?



বয়স তার এখন সত্তর’র কোঠায়। বসে থাকেন ছয়নম্বর জা’মে মসজিদের কিনারে। প্রতি শুক্রবারে জুম’আ শেষে নামাযীদের দেয়া অর্থ দিয়েই সপ্তাহ চালাতে হয় এখন তার। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ এখন আর নেই। বেঁচে থাকার তেমন কোনো ইচ্ছাও নেই। যেটা আছে তা হলো জীবনের জন্য সংগ্রাম করে অবশিষ্ট সময়গুলো কাটানো।



অতীতের কথা মাঝে মাঝে তার মনের পর্দাগুলো নাড়িয়ে দেয়। মেয়েটাকে তিনি আর দেশে আনতে পারেননি। স্বাধীনতার তিন বছর পর যখন আনতে গিয়েছিলেন মেয়ে তাকে দেখে চিনতে পারেনি; আসা তো দূরের কথা কোলেই উঠেনি। অশ্রুস্বজল চোখ নিয়েই সেদিন তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন দেশে। অবশ্য আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কেননা এর কয়েক বছর পরে তাকে ভিটেছাড়া হতে হয়েছিলো।



আর তেমন কিছু তার মনে পড়েনা আজকাল। রাস্তায় ঘুমান। রাস্তার কুকুর গুলোর সাথে ভালো সখ্য হয়ে গেছে তার। তার সামান্য খাবারের কিছু অংশ তারা বরাদ্দ পায়। তার ছেলেও সপ্তাহান্তে এই মসজিদে নামায পড়তে আসে। তিনি মাঝে মাঝে দেখেন। কখনো দেখেননা। দেখলেও আর দশটা লোকের মতই তার দিকে থালা বাড়িয়ে দেন। আর দশটা লোকের মত তাকেও বলেন-“ বা’জান- দুইডা পয়সা দিবেন?”

তবে হয়ত সেই “বা’জান” ডাকটা অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা হয়।



ইদ্রিস সাহেব ভিটেবাড়ি হারিয়ে তার এই একমাত্র সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন এই শহরে। সর্বস্ব দিয়ে যিনি বড় করেছেন তার এই সন্তানকে। বড় হয়েছে তার সন্তান; মানুষ হয়নি।



ইদ্রিস সাহেবের মেঘনার পাড়ে ফসলের মাঠ ছিলো; যেই মাঠের কাকতাড়ুয়া গুলো এখন কুর্নিশ করে সেই রাজাকারটিকে। স্বাধীন বাংলার ক্ষেতের ফসলগুলো এখনো ভোগ করে স্বাধীনতাবিরোধী লোকগুলো। তাদের মাথাগুলো নিশ্চিন্তে ঠাঁয় পায় স্বাধীন দেশের আলীসান বাড়ীগুলোর পরিষ্কার বিছানায়।



আর ইদ্রিস সাহেব রাস্তায় পড়ে থাকেন। তার স্বাধীন দেশের ধুলো পড়া রাস্তায়।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×