আম্মা তখন পিটিআই তে পড়তো।অনেক মহিলা মানে ম্যাডাম রা আসতো।আমাদের বাসা থেকে পিটিআই ছিল অনেকটা দূরে।তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেত।আমি তখন ক্লাস ২ তে পড়ি।বিশাল বড় পিটিআই ক্যাম্পাস।আম্মার মত আরো অনেক ম্যাডাম উনাদের ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসতো।আমি অল্পতেই ওদের সাথে মিশে খেলা শুরু করে দিতাম।
এরই মাঝে রবীন নামে একটা ছেলে আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল।ও আমাকে ভুনভনি কিনে দিত।আবার আমি ওকে কুকি বিস্কিট কিনে দিতাম।শুরু হল আমার -আর রবিনের পুরু পিটিআই জুড়ে বিচরণ।
দুজনে একসাথে থাকার কারণে দুজনের আম্মাই একটু টেনশন ফ্রী থাকতো।অকৃতিম বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমরা দুজন।
সময়ের সাথে একদিন আম্মার পিটিআই ট্রেনিং শেষ হয়।বিদায় নেবার দিন আমরা দুজনেই কেঁদেছিলাম।কিছুতেই ওকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না।আমার এবং ওর আম্মা দুজনেই বলছিল আমাদের আবার দেখা হবে।কিন্তু আমার তখনই মনে হয়েছিল।এটাই আমাদের শেষ দেখা।
বাড়ীতে কিছুতেই আর সময় কাটে না।শুধু ওর কথা মনে পড়ে।এর কয়েকদিন পর আমাদের ছাগলটা একটা বাচ্চা দেয়।বাচ্চাটাকে দেখেই আমি ওর নাম ঠিক করে ফেলি রবিন।আমার ঐ বয়সে এর চেয়ে ভাল কিছু করে আমার বন্ধুকে সরণীয় করে রাখার চিন্তা করতে পারিনি।এক রবিনকে হারিয়ে আর এক রবিন কে পেলাম।
শুরু হল আমার আর রবিনের নতুন বন্ধুত্ব নতুন করে। ওকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানো।গলায় মালা পড়ানো। কাউকে ধরতে পর্যন্ত দিতাম না।
দেখতে দেখতে আমার রবিন বড় হয়ে উঠলো।সারা গ্রাম জেনে গেল এটা আমার ছাগল।তাই কেউ কিছু বলত না।সারাদিন ওর সাথে লেগে থাকতাম।চটের বস্তা কেটে ওর জন্য জামা বানিয়েছিলাম।যেতে ওর শীত না লাগে।
স্কুল থেকে এসে শুধু এখবার ডাক দিতাম রবিন বলে।ডাক দেবার সাথে সাথেই ও এসে হাজির হত।মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম বিকেল বেলা।আমি ঘুড়ি উড়াতাম আর ও আমার আসে-পাশে ঘুরে ঘুরে গাস খেত।অল্পদিনের মধ্যই আমার বন্ধু রবিন সকলের চোখে পড়ার মত হয়ে গেল।কালোমিচমিচে তেল তেলে শরীর।
সে বার কুরবানীর ঈদ ঘনিয়ে এলো।আমরা নতুন টিনের ঘর তুলছি।আব্বা নাকি অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছে।তাই এবার নাকি কুরবানি দিবে না।আমার খুব মন খারাপ।আপা ও অনেক কান্নাকাটি করল।সারাদিন মনে হত ক্যান আব্বার অনেক টাকা নেই।
একদিন আম্মা বলল রবিনে বিক্রি করে দিতে।কোরবানির সময় দাম বেশি পাওয়া যাবে।আব্বা আমাকে বলল চল আমরা হাটে যাই।অন্য সময় আব্বার সাথে হাটে যাবার জন্য কত কান্না কাটি করি কিন্তু আজ আমার একদম হাটে যেতে ইচ্ছা হল না।মনে হল আমার রবিন কে বেচে দিবে।
পরে হঠাৎ আব্বা বলল থাক রবিন কে বেচা লাগবে না।
ঈদের আগের দিন রাতে আপা আমাকে জানালো রবিনকে কুরবানী দেয়া হবে।শুনে তো আমার মাথায় আগুন ধরে গেল।হঠাৎ এক বুক অভীমানে মনটা ভারী হয়ে গেল।রাতে কিছু খেলাম না।আম্মা আমাকে কাছে টেনে খাইয়ে দিত লাগলো আর ইব্রাহীম (আ: ) নবীর ইসমাইলকে কুরবানী দেয়ার কাহীনি বলতে লাগলো।আপা এসে বলল ...আমরা যদি এইবার কুরবানী না দেই তাহলে আমাকে পলিথিন ব্যাগ নিয়ে মানুষে বাসায় বাসায় গিয়ে কুরবানী মাংস নিয়ে আসতে হবে।কুরবানী যারা দেয় না তাদের অন্যর বাসার থেকে যেয়ে নাকি মাংস আনতে হয়।
রাতে কোনমতে দ্বীধাযুক্ত মন নিয়ে শুতে গেলাম।সকালে উঠে নামাজ পড়তে গেলাম।মাথায় সারাক্ষন শুধু রবিনের চিন্তা ঘুরতে লাগলো।একবার মনে হলো দৌড়ে বাড়ী গিয়ে রবিনের গলার রশিটা ছেড়ে দিয়ে আসি।আবার হুজুরের করুন কন্ঠে ইসমাইলের (আ: ) এর ঘটনা শুনে মাথা স্থির করতে পারছিলাম না।ভাবলাম নামাজ পড়ে আর বাসায় যাবো না।আমাদের বাসায় হুজুর আসে একটু দেরীতে।
আব্বা আমাকে সাথে করে নিয়ে আসলো।আর আসল হাফেজ সাফ হুজুর।আর বুকের মাঝে সারাক্ষণ ধুপধুপ করছিল।কি হবে কি হবে।আমার শিশু মনে সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে রবিনকে বাচানোর সাহায্য চাইছিলাম।কিন্তু সাহায্য এসে পৌছানোর আগেই একটা ধারালো ছুরি দিয়ে আমার রবিন আমার বন্ধু রবিনকে কুরবানী করা হল।আমার ছোট্র পৃথিবীটা অকারণে অনেক ভারী হয়ে উঠল।আমার নিশ্বাস বারে বার বন্ধ হয়ে আসছিল।দু চোখ দিয়ে শুধু ঝরছিল প্রিয় বন্ধুকে হারানো শোক।
হঠাৎ করে আমার সব রাগ এক সাথে পড়ল গিয়ে হাফেজসাহেবের উপর।একটা দা নিয়ে উনার দিকে দৌড়ে গেলাম।ওনাকে খুন করবো বলে।আমাকে আমার চাচাতো ভাই..আমার আব্বা জাপটে ধরলো।
একটা সময় আমি আল্লাহকেও দোষ দেয়া শুরু করলাম।কেন সে রবিনকে বাচাল না।আমি সেবার কোন মাংস খাবো না।আম্মা আপা সবাই মিলে আমাকে অনেক বুজানোর চেষ্টা করলো...কুরবানী মাংস খেতে হয়।কিন্তু আমি আমার বন্ধুর মাংস খাই কি করে।
আমি জীবনে এত্ত পাপ করেছি।বেহেশত যাওয়া না যাওয়া এখন পুরোপুরি আল্লাহর মর্জি।আজ শুধু একটাই দোয়া করি।আমার রবিনের কুরবানীর বিনিময়ে হলেও আমার বন্ধু
রবিন (মানুষ)যেখানেই আছে, ওকে আল্লাহ তুমি ভাল রেখ।ওর জন্য আমি দুবার কষ্ট পেয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ২:১০