somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গানের জীবন-৩: সামার অভ সিক্সটি-নাইন

১১ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এরকমই কোন অলস দুপুরে এই গানের সূত্রপাত, অন্তত আমার কাছে। তখনো স্কুল পালানো শিখিনি, তবে "ব্যাচে পড়া" নামের একটা জঘন্য জিনিসের পাল্লায় পড়েছিলাম ক্লাস নাইনে উঠে, অন্তত একজনের কাছে না পড়লে বাপ-মা মনে শান্তি পান
না, কাজেই দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে গেলাম কিছুদিন। পুরো ব্যাপারটায় আমার কোন উপকার হয়নি, তবে ভিডিও গেমের দোকানিদের ভালো ব্যবসা হয়েছিল, কোনমতে শিক্ষক মশাই পড়াটা শেষ করলেই উঠে দৌড় দিতাম পাশের দোকানে। তখনকার ব্যাপক জনপ্রিয় গেম হলো "মোস্তফা", আসল নাম জেনেছি অনেক পরে, সেখানে কে কত বড় নায়ক তা নিয়ে মহা হইচই, মাত্রই আসা এই জিনিসের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। অন্য বন্ধুরা ভাল খেলে, অন্য সবকিছুর মতই এই ব্যাপারেও আমার প্রতিভা শূন্যের কাছাকাছি, পকেটে পয়সাও বিশেষ থাকেনা, রিকশাভাড়া বাঁচিয়ে যা পাই তার সবটাই চলে যায় তিন গোয়েন্দা আর কিশোর ক্লাসিক কিনতে। ২-৪ টাকা যা থাকে তা দিয়ে ২-১টা কয়েন কিনতে পারি, এবং খুব তাড়াতাড়ি
"কসাই বস" এর কোপে অক্কা পেয়ে বিরস বদনে পরের জনকে জায়গা ছেড়ে দিই।

বন্ধুদের মাঝে কানা'র গেমের হাত ভাল, মেহরাব আর দিপু খেলে মোটামুটি, দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখি, দুধের সাধ ঘোলে মোটামুটি মিটে যায়। ১০টার আগেই পড়া শেষ, ১২টা পর্যন্ত গেমের দোকানে দাঁড়িয়ে ছুটতে ছুটতে কোনমতে স্কুলের গেটে পৌঁছাই, ততক্ষণে "অ্যাসেম্বলি" নামের আরেকটা মহা অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে, স্কুলের প্রধান ফটকও বন্ধ, বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি গ্রীষ্মকালের কাবাব করা রোদে
দাঁড়িয়ে লাইন ধরে ছেলেরা শপথবাক্য পড়ছে-- "আমি ওয়াদা করছি যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে---" ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে শিক্ষকদের হুংকার, আরামে দাঁড়াও (ঐ গরমে আরামে কিভাবে দাঁড়ায় কে জানে!), সোজা হও, সামনে দু'হাত তুলে জায়গা নাও। এরপর জাতীয় সঙ্গীত, সে আরেক মজা, বাজাবে না, কাউকে গিয়ে গাইতে হবে। নিয়মিত কিছু গায়ক ছিল, তারা সামনের সিমেন্টের মন্ঞ্চে গিয়ে গাইবে, বাকিদের গলা মিলাতে হবে। পুরো ব্যাপারটাকে শ্রদ্ধা দেখানোর
চিন্তা ঐ বয়সের ছেলেদের মাথায় আসার কথা না, কাজেই গলা মিলানোর বদলে বেশিরভাগই হাসি চাপতে হিমসিম খেত, অবশ্য শিক্ষকদের বেতের বাড়ি পশ্চাদ্দেশে পড়লে সেই হাসি এমনিতেই মিলিয়ে যেত।

তবে বেতের বাড়ির সাথেই মনে করিয়ে দেয়া দরকার, এই অধম তখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। সাথের ছেলেরা অনেকেই তখন পাশের গেট দিয়ে বের হওয়া কন্যাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময়ে ব্যস্ত, কিন্তু সাধ থাকলেও নিজের চেহারাখানার দিকে তাকিয়ে ঐ সাধ্য কখনো হয়নি, কাজেই বান্দা ভাবছে আজকে কতক্ষণ বারান্দায় কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে। জাতীয় সঙ্গীতের শেষে সারি বেঁধে অপরাধী লেট লতিফদের ভেতরে ঢোকানো হলো, তারপরে ঐ আগুনে সূর্যের নিচে ১০ মিনিট দাঁড় করিয়ে ক্লাসে ফেরত। ততক্ষণে নাম ডাকা হয়ে গেছে, শিক্ষক মশাই তার নিয়মিত লেট লতিফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকতে বললেন, শেষ দিকে ভদ্রলোক মেনেই নিয়েছিলেন যে এই ছোকরা কোনদিনই সময়মত ট্রেন ধরতে পারবে না।

কিন্তু ছিলাম তো গানের কথায়, গ্রীষ্মের দুপুরে ক্লাস করার কথায় নয়। বলা যায়, গ্রীষ্ম তো গায়কের একার নয়, আমার গ্রীষ্ম তো অন্যরকম, তারপরেও যেন খুব বেশিই একরকম। সেই ক্লাস নাইনে থাকতেই শাহান, আমাদের বন্ধু, কম্পিউটার কিনে ফেললো, উইন্ডোজ ৯৮ অপারেটিং সিস্টেমে চলে,সেটায় আবার গান শোনা যায় যা খুশি,গেম তো খেলাই যায়। আমাদের স্থায়ী আস্তানা হয়ে গেল তার বাসা, শাহানের মা চাকরি করেন,কাজেই ওখানে গিয়ে জ্বালাতে সমস্যা নেই। স্কুলের খুব কাছেই
তার বাসা, কাজেই ১২টার আগের সময়টা, আর বৃহস্পতিবারের হাফ স্কুলের পরের সময়টা সেখানেই কাটতে লাগলো আমাদের।

এর আগ পর্যন্ত গান বলতে আমার কাছে বাবার রবীন্দ্র আর নজরুল আর এদিকে আইয়ুব বাচ্চু। শিপলু ভাই আর শাহানের গানের সংগ্রহে আমরাও ভাগ বসালাম, গানস এন রোজেস, ঈগলস, স্করপিয়নস, জন ডেনভার, ফিল কলিন্সের সাথে চেনা হয়ে গেল ব্রায়ান অ্যাডামসকে, আর চিরকালের জন্য চেনা হলো "সামার অভ সিক্সটি-নাইন" কে।

গিটারের ৬-তারের প্রথম ঝংকারের সাথে সাথেই গানটা রক্তে কেমন যেন ওলোট-পালোট করে দিল, মনে হলো ঠিক এটাই আমাদের গান, "রক" গানকে কেন "রক" বলা হয় সেটার জন্য এরচেয়ে ভাল কোন নমুনা সম্ভবত হয় না। গানের কথা
কি সেটা পরে বোঝা যাবে, অতসব না বুঝেই আমরা মাথা নাড়াই, পায়ে তাল ঠুকি, বেসুরো গলায় তাল মিলিয়ে মাঝেমাঝেই অহেতুক হাত-পা ছুঁড়ি। কিছু একটা করে ফেলতে ইচ্ছা হয়, রকের তালে তালে জীবনটাকে তখন অনেক বেশি
গতিময় মনে হয়, আর ক্লাসরুমে গিয়ে ঝিম ধরা দুপুরে যখন গানটা মাথায় ঘুরঘুর করে তখন সবকিছু ছেড়ে ঘুমঘুম দুপুরটাকে ভেঙেচুরে কাঁপিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়।

সেই শুরু। এরপর দিন গেছে, গান শোনার পরিধি বেড়েছে, কিন্তু "সামার অভ সিক্সটি-নাইন" আরো বেশি করে মাথায় জেঁকে বসেছে। নস্টালজিক লিরিক, পাগল পাগল সুর, সব মিলিয়ে জীবনকে ঘুরে দেখা, নতুনভাবে ফিরে যাওয়া পুরানোতে।
স্কুল ছাড়িয়ে তখন নটরডেমে ভর্তি হয়েছি, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টিটি আর ভলিবল খেলি, মাঝে মাঝে বিভিন্ন ক্লাবের অনুষ্ঠান হলে বাইরের কলেজ থেকে আসা পরীদের আশপাশে নিষ্ফল ঘুরঘুর করি, সামার অভ সিক্সটি-নাইন তখন আরো অনেক বেশি
প্রাসঙ্গিক। ব্রায়ান অ্যাডামস রকস, লাইফ রকস, সব মিলে এলোমেলো অবস্থা, একেই মনে হয় বলে পাখা গজানো। পড়াশোনা কলেজে উঠেই মোটামুটি শিকেয় তুলে ফেলেছিলাম, গণিতে ২৯ পেয়ে ফেল করার পরেও বিশেষ বোধোদয় হলো না, আশপাশে আরো অনেকেরই একই অবস্থা, পরেরটা পরে দেখবো এমন একটা ভাব। সাইকেল চালিয়ে কলেজে যাই-আসি, নিজেকে বড় বড় মনে হয়, পড়াশোনাটা ঐচ্ছিক বিষয়ের মত। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে "ব্যাচে পড়তে" যাই, তখন নির্বাচনের একটা
হাওয়া, রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝেই গলা কাঁপিয়ে আমরা স্লোগান দিই বিড়াল-কুকুর যাহোক একটা মার্কা নিয়ে, সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকাই, আমাদের আনন্দ দেখে কে!

ভার্সিটিতে আসার পরে জীবনে বড় রকমের একটা পরিবর্তন এসে গেল, চেনা মানুষজন থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। নতুন ক্লাস, নতুন মানুষ, কোন কিছুর সাথেই আর মানাতে পারি না। পড়াশোনা কাজকর্ম সবই অর্থহীন লাগে। কষ্টেসৃষ্টে টিউশনির
টাকা জমিয়ে কিস্তিতে একটা কম্পিউটার কিনে ফেলেছি, সেটাই দিনরাতের সঙ্গী, সেখানে সারাদিন সামার অভ সিক্সটি-নাইন বাজিয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি--"দোজ ওয়্যার দ্য বেস্ট ডেজ অভ মাই লাইফ।" সময় থামে না, আস্তে
আস্তে এখানেও বন্ধুবান্ধব জুটে যায়,যতটুকু পড়াশোনা না করলেই নয় ততটুকু করি, বাকি সময় ক্যাফেতে বসে রাজা-উজির মারা আর অডিটরিয়ামের সামনে বসে পরী দেখা। সুযোগ পেলেই ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে কেটে পড়ে হলে গিয়ে ঘুম, রাতে হলে আড্ডা মেরে ২টা ৩টার সময় চানখাঁর পুলের পরোটা, ধীরে ধীরে আবারো মনে হতে থাকে, বেঁচে থাকাটা খারাপ না।

একসময় এখান থেকেও বিদায়ের দিন চলে আসে, র‌্যাগের পরদিন শূন্য ক্যাফেটেরিয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার বুঝতে পারি আবারো একলা চলার সময় হয়ে এল। একসময়ের সারাদিনরাতের বন্ধুরা বেশিরভাগই দেশের বাইরে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্ধানে, দেশে যারা আছে তাদেরো কালেভদ্রে দেখা পাই। মাসে-দু'মাসে একবার ভার্সিটিতে যাই,আমরা বের হয়ে যাবার পরে সেখানে আরো ৩টা নতুন ব্যাচ চলে এসেছে, নিজেকে বুড়ো দাদু মনে হয়। মাঝে মাঝে চেনা কিছু মুখের সাথে দেখা হয়ে যায়, হই-হুল্লোড়, হাত মেলানো, টেবিল চাপড়ে বিস্বাদ চা দিয়ে গল্পগুজব। অডিটরিয়ামের সামনে বসে র‌্যাগ কর্নারের দিকে তাকালে
দেখা যায় ছেলেপেলেদের জমায়েত, হল্লা আর গান, মুখগুলো বদলে যায়, দূরে বহুদূরে থাকা আবছা অতীতের মানুষগুলোকে নতুন করে দেখি এলোমেলো চুল আর ছেঁড়াফাটা জিন্সে, স্কুলের আরামে দাঁড়াও, টিটি টেবিলের ঠকাঠক, সাইকেলের ছুটে যাওয়া, ক্যাফের সামনে রঙ নিয়ে ছোটাছুটি, আর শেষবেলার কান্না। গনগনে গ্রীষ্মের দুপুরে হঠাৎ করেই ওদের কোরাস বদলে গিয়ে হয়ে যায় প্রবল সবুজ নস্টালজিয়ার "সামার অভ সিক্সটি-নাইন", ঝাপসা হয়ে আসা চোখে আমি ধুলিকণা খুঁজি।

[কাছের, দূরের, যারা ছিল, আছে,থাকবে, যাদের জন্য আমার থাকা আর না-থাকা, আমার সব বন্ধুদের জন্য]

http://www.youtube.com/watch?v=9f06QZCVUHg
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪৩
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×