somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোহেমিয়ান বাউল চিত্রশিল্পীর সান্নিধ্যে

১১ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লা, মাথায় বাবরী চুল, ঋজু দৈহিক গড়নের চোখে চশমা পরিহিত একজন লোক শ্রেণী কক্ষে ঢুকলেন। উঠে দাঁড়ালাম সবাই আর সেই সাথে সকলেই বেশ ভ্যাবাচ্যাকা এবঙ ভয় পেয়ে গেলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের মাধ্যমে আগে থেকেই অবহিত ছিলাম যে আমাদের একজন নতুন অঙ্কন শিক্ষক আসছেন। তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এই লোকটিই হতে পারেন আমাদের অঙ্কন শিক্ষক। আমাদের সেই সময় মনের অবস্থা উনি বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানা যায় নি। পরস্পরের সাথে পরিচয় পর্ব শেষে উনি ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকতে শুরু করলেন। আমরাও ড্রইং খাতায় তাঁর সাথে সাথে আঁকতে লাগলাম। যতটুকু মনে পড়ে তাঁর সাথে প্রথম অঙ্কনটি ছিল একটি সহজ ফুলের ছবি। টিফিন পিরিয়ডে দেখলাম নীচু-উচু শ্রেনীর উৎসুক বালক-বালিকারা তাঁর সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। প্রথম দর্শনেই ওনার পোশাক-আশাক দেখে একটু ভীতির সঞ্চার হয়েছিল বৈকি। তবে তা ছিল ক্ষনিকের। কথাগুলো বলছি বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী শ্রদ্ধেয় এস এম সুলতান সম্পর্কে (১০ আগস্ট, ১৯২৩ – ১০ অক্টোবর, ১৯৯৪)।


ছবি কৃতজ্ঞতা: নাজমুল ভাই

সময়টা ১৯৭৩ সালের দিকে। তখন যশোর ক্যান্টনমেন্ট দাউদ পাবলিক স্কুলে পড়ি। বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে যশোরে প্রায় এক যুগ অবস্থান করেছিলাম। সুলতান স্যার আমাদের শিক্ষক হয়ে এসেছিলেন খুব স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। অতি স্বল্পসময়ের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর গোঁড়া ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। শিশু কিশোরদের সাথে তাঁর মিষ্টি মধুর চমৎকার অমায়িক ব্যবহার ছিল কল্পনাতীত। ওনার ড্রইং শেখানোর ধরনটিই ছিল একেবারে অন্যরকম। ক্লাসে শিক্ষাদানকালীন সময়ে অসম্ভব দক্ষ নিপুনতার সাথে বোঝাতেন। ব্ল্যাক বোর্ডে ছবি আঁকার সাথে সাথে তাঁর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর আঁকতাম। খুব সহনশীলতার সাথে সময় নিয়ে আঁকতেন আর বোঝাতেন। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর ডেস্ক ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কোনো সমস্যা থাকলে হাতে কলমে নির্দ্বিধায় সমাধান করে দিতেন। আমি তাঁর গ্রামীন যাপিত-জীবন এর ওপর চিত্রগুলোর (বাংলার গ্রামীন জীবনকে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু করার মূলে রয়েছে এই জীবনের প্রতি তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ, সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালবাসা।) সাথে পরিচিত হবার পূর্বেই ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকা তাঁর শান্ত নদীটির পাশে শ্যামল সবুজ গ্রামের ছবিটির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। স্মৃতি অনেকটা অন্ধকারের অগোচরে চলে গেলেও যতটুকু মনে পড়ে, ছবিটা আমাদের আঁকতে শেখাতে সময় নিয়েছিলেন প্রায় একমাস। কতটুকু ধৈর্য সহকারে তিনি শেখাতেন। কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাদের জীবনের সব সময়েই কেউ না কেউ গভীর ভালবাসায় বেঁধে ফেলতে চায়, স্যারও হয়তো সেই খুব সংখ্যালঘু ভাগ্যবানদের একজন ছিলেন! ওনার প্রেরনায় উৎসাহিত হয়ে মেট্রিক অব্দি আঁকাআঁকির অভ্যাস ছিল। কিশোর বয়সে কেউ যদি কিছু আঁকতে বলত, আমি শান্ত নদীটির পাশে গ্রামের ছবিটিই এঁকে দিতাম। ছবিটি স্মৃতির ভেতর এমন নিখুঁতভাবে এটে গিয়েছিল যে অন্য কোনো ছবি মাথায়ই আসত না বা আঁকার চেষ্টাই করতাম না। সবুজ শ্যামল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত নদীটিই হয়তবা ছিল চিত্রা। আমার কন্যা ও নাতনিকেও শিখিয়েছি আঁকতে এ ছবিটি। আমি যে শুধু একটি ছবিই আঁকতে জানি।

জীবন নিয়ে উদাসীন ছিলেন তিনি, তবে সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন একশত ভাগ মনোযোগী। শিল্পের সাথে শিল্পীর জীবনদর্শন একীভূত হয়েছে তার চিত্রে। শিল্পী সুলতানের রেখাগুলো জীবনরেখা। জীবন বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে নেয়া। শিল্পী সুলতান গ্রামবাংলার পথিকৃৎ­ যার আদল নির্মাণের ভাষা বাংলা চিত্রকলাকে উন্নীত করেছে উচ্চমার্গীয় আসনে। শিল্পী এস এম সুলতান শেষ জীবনে বলে গিয়েছেন ” আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।”


ছবি কৃতজ্ঞতা: নাজমুল ভাই

তাঁর জীবনী সম্পর্কে আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। তাই ওনার শৈশব, কৈশোর, শিক্ষা ও কর্ম জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় গেলাম না। ওনার সম্পর্কে যথেষ্ট লেখালেখি পাওয়া যাবে নেটে। শুধু স্মৃতির পটে এতদিন যাবত লুকিয়ে থাকা না বলা কথাগুলো উপস্থাপন করার প্রয়াস মাত্র। আমার প্রিয় মানুষদের একজন তিনি। কবে সেই ছেলেবেলায় তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তাতে নিজেকে অনেক ধন্য ভাবি। তাঁর জন্য হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আমাদের মধ্যে অনেকে অনেকবার তাঁর চিত্রকর্মগুলো দেখেছেন। তদুপরি আবারও তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র শেয়ার করার তৃষ্ণা সামলাতে পারলাম না বিধায়……


নিসর্গ-২, তেলরং, ১৯৫১


কাফেলা, কালি ও কলম, ১৯৫৩


প্রথম বৃক্ষরোপণ, তেলরং, ১৯৭৫


পানি ভরা-১, তেলরং, ১৯৭৯


চর দখল-২, তেলরং, ১৯৮৬


যাত্রা, তেলরং, ১৯৮৬


চুলবাঁধা, তেলরং, ১৯৮৭


মাছ-কাটা, তেলরং, ১৯৮৯


চিত্রা নদীর তীরে-৩, তেলরং, ১৯৮৯


জমি-কর্ষনে যাত্রা-২, তেলরং, ১৯৮৯

*ছবিগুলো সব গুগুল মামুর সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:০৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×