somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফাতেমা আমার দেহের অংশ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাসূল (সা.) বলেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশ।

গুরুত্বপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যে হাদীসটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে তা হলো তাঁর পবিত্র দুহিতা ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে। আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে বিদআ বা বিজআ নামে প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় আলোচক ও বিশেষজ্ঞদের এ হাদীসটির উপর গবেষণা করা উচিত যাতে করে মুসলিম উম্মাহ্‌ তা থেকে উপকৃত হতে পারে। এ সংক্ষিপ্ত লেখনীটি এ উদ্দেশ্যেই উপস্থাপিত হচ্ছে।

হাদীসের বর্ণনা

বুখারী বর্ণনা করেছেন: আবুল ওয়ালিদ, আবু উয়াইনা থেকে, তিনি আমর ইবনে দিনার থেকে, তিনি ইবনে মুলাইকা থেকে, তিনি মাসুর ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ফাতেমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো।[1]

মুসলিম বর্ণনা করেছেন: আবু মুয়াম্মার ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম আল হাযালি, সুফিয়ান থেকে, তিনি ইবনে আবি মুলাইকা থেকে এবং আবি মুলাইকা মাসুর ইবনে মাখরামা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) বলেছেন: ফাতেমা আমার (দেহের) অংশ যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।[2]

আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী তার ফাজায়েল গ্রন্থে মাসুর ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশ যে তাকে ক্রোধান্বিত করল সে আমাকেই ক্রোধান্বিত করলো।[3]

হাকিম নিশাবুরী স্বীয় সূত্রে মাসুর থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশ। যা তাকে অসন্তুষ্ট করে আমিও তাতে অসন্তুষ্ট হই এবং যা তাকে আনন্দিত করে আমিও তাতে আনন্দিত হই।[4]

হাদীসের অর্থ এবং বিভিন্ন দিক

উল্লিখিত হাদীসগুলি বিভিন্ন শব্দ বিন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এবং তা বিশেষজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে হাদীসের দুটি বাক্যাংশকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন মনে করছি:

প্রথমটি হলো: ‘আমার অংশ’ বা ‘আমার দেহের অংশ’। হাদীসটিতে بَضعة (বাদআ) বা بِضعة (বিদআ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে কাসির বলেন: বাদআতুন অর্থ ‘মাংসের অংশ’ এবং বিদআতুন অর্থ ‘অংশ’। যেহেতু কারো দেহের মাংসের টুকরা তার দেহের বা তার অংশ[5] সেহেতু হাদীসটিকে দেহের অংশ বা অংশ অর্থ করা যায়।

ইবনে মানযুর বলেন: অমুক অমুকের দেহের অংশ এর অর্থ সে তার অনুরূপ। অতঃপর তিনি আলোচ্য হাদীসটিকে উদাহরণ হিসেবে এনেছেন।[6]

উপরিউক্ত অর্থের ভিত্তিতে ফাতেমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর অংশ। এখন হতে পারে তা রূপক অর্থে সদৃশ বুঝাতে অথবা প্রকৃতই তিনি রাসূল (সা.)-এর অংশ অর্থাৎ হয় তাঁদের দু’য়ের মধ্যে বিদ্যমান ওতপ্রোত বা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বুঝাতে তা ব্যবহৃত হয়েছে অথবা বাস্তব সম্পর্ক নির্দেশ করা হয়েছে।

উভয় ক্ষেত্রেই হাদীসের ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ’ বাক্যটির মধ্যে এ অর্থ নিহিত রয়েছে যে, মহানবী (সা.) ফাতেমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন। কিন্তু তদুপরি হাদীসটিতে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পরবর্তী বাক্যে তা উল্লেখ করে বিষয়টির উপর তাগিদ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ’ হাদীসটি আমাদের রাসূল (সা.)-এর আলী (আ.) সম্পর্কে বলা এ হাদীসটিকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন সময় তিনি বলেছেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে।’[7]

আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী তার ফাজায়েল গ্রন্থে ইমরান ইবনে হুসাইন সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: নিশ্চয় আলী আমার থেকে এবং আমি আলীর থেকে এবং সে আমার পর সমগ্র মু’মিনদের অভিভাবক।[8]

একই গ্রন্থে তিনি হাবাশী ইবনে জুনাদা আস সুল্লুলী সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে আমি ও আলী ব্যতীত কেউ কোন কাজ করবে না।’[9]

অনুরূপ হাদীস ইবনে আবি শাইবা কুফী, যাহহাক, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজা, তাবরানী, সুয়ূতী, মুত্তাকী হিন্দী ও অন্যান্যরাও বর্ণনা করেছেন।

আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন এ সকল আলেমের -যাদের গ্রন্থ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী- বর্ণনার বিপরীতে নাসিরুদ্দীন আলবানী যে, হাদীসটিকে দুর্বল প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন তার প্রতি কর্ণপাত করা যায় না। হাদীসটি দু’একটি সূত্রে দুর্বল হলেও সকল সূত্রে দুর্বল নয় বরং বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি হাদীসটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়ার সত্যতাকে প্রমাণ করে। এ কারণেই তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান (বর্ণনাকারীরা সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত কিন্তু স্মরণশক্তির ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা রয়েছে), গারিব (প্রত্যেক স্তরে শুধুমাত্র একজন বর্ণনাকারী বিদ্যমান) ও সহীহ (বর্ণনাকারীরা সকলেই সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং স্মরণশক্তির ক্ষেত্রেও তাদের দুর্বলতা নেই এবং হাদীসটি ত্রুটিযুক্ত ও বিরল বলে গণ্য নয়)।[10]

হাদীসটি ‘গারিব’ হওয়ার বিষয়টি তার সত্যতার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না। যেহেতু আহলে সুন্নাতের সংজ্ঞানুযায়ী হাদীসের বর্ণনা ধারায় কোন একটি স্তরে যদি বর্ণনাকারীর সংখ্যা এক হয়ে থাকে তাও গারিব হাদীসের অন্তুর্ভুক্ত[11] সেহেতু গারিব হাদীসকে সঠিক বলে ধরতে এবং তা গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ সহীহ ও হাসান হাদীসের ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে যেমনটি উপরিউক্ত হাদীসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তদুপরি যদি আমরা গারিব হওয়ার কারণে কোন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করি তবে সেক্ষেত্রে সুনানে আবু দাউদ ও দারে কুতনীর মত প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহের অধিকাংশ হাদীসকে গারিব হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

সুতরাং আলোচ্য হাদীসটির ক্ষেত্রে গারিব হওয়া কোন সমস্যা নয়। তাছাড়া আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি গারিব নয়।

আল্লামা মানাভী বলেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’ মহানবী (সা.)-এর এ হাদীসটির অর্থ হলো আলী বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ভালবাসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং আমিও তার সঙ্গে ঐ সকল ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত। এ কারণেই তিনি এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও সংযুক্তির কথা বলেছেন। আরবদের ভাষায় বিষয়টি এভাবে বলা হয়ে থাকে যে, অমুক অমুকের সাথে এতটা সম্পৃক্ত যে, তারা যেন একে অপরের সাথে একীভূত হয়েছে।[12]

যখন কেউ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান বৈবাহিত সম্পর্কের বিষয়টির প্রতি তাকায় তাহলে লক্ষ্য করবে যে, তাদের মধ্যে এই সম্পর্কটি সকল দিক থেকে পূর্ণ অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে মিল ও সম্পর্ক রয়েছে। যদি কেউ ‘যে আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল’ এবং ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’ বাণী দু’টির পাশে ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট ছিল’ এবং ‘ফাতেমা আমার অংশ যে তাকে ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করলো সে আমাকেই ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করলো’ বাণী দু’টিকে মিলিয়ে দেখি তবে পবিত্র কোরআনের ‘আর প্রত্যেক বস্তু আমি সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’ আয়াতটির সত্যতাই আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে। বিষয়টির ব্যাখ্যা এরূপ যে, সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ যেমন জোড়া সৃষ্টি করেছেন পূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার দৃষ্টিতেও তেমনি এরূপ জোড়া সৃষ্টি করেছেন। সকল ক্ষেত্রেই আলী ও ফাতেমা পরস্পরের জুড়ি ও সমকক্ষ ছিলেন। উপরিউক্ত হাদীসগুলির ‘আমার অংশ’ ও ‘আমার থেকে’ কথাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রকে ব্যতিক্রম করা হয়েছে তা ব্যতীত সকল ক্ষেত্রেই মহানবী (সা.) ও আলী (আ.) সমবৈশিষ্ট্য ও সম অধিকার প্রাপ্ত। তাই নবুওয়াতের বিষয়টিকে বাদ দিলে বাকী সকল বৈশিষ্ট্য ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মিল ছিল।

নবম হিজরীতে রাসূল (সা.) সূরা তওবার প্রথম কয়েক আয়াত প্রচারের জন্য হযরত আবু বকরের নেতৃত্বে হজ্জ কাফেলাকে প্রেরণ করলে জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে বলেন: এ আয়াত আপনি অথবা এমন কেউ যে আপনার থেকে, সে ছাড়া অন্য কেউ প্রচারের অধিকার রাখে না। তখন রাসূল (সা.) আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রেরণ করেন।[13]

একইরূপ ঘটনা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে যখন আবু লুবাবা তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় অনুশোচিত হয়ে তওবার উদ্দেশ্যে নিজেকে খুঁটির সাথে বেঁধে আল্লাহ্‌র শপথ করে বলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) যদি এসে তাকে মুক্ত না করেন তিনি ঐ অবস্থায়ই থাকবেন, তার তওবা গৃহীত হলে হযরত ফাতেমা তাকে বন্ধনমুক্ত করতে গেলে তিনি আপত্তি জানান। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেন: ‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার মাংসপিণ্ড।’ অতঃপর ফাতেমা তার বাঁধন খুলে দেন।[14]

দ্বিতীয়টি হলো যে ফাতেমাকে ক্রোধান্বিত করে সে রাসূলকেই ক্রোধান্বিত করে অর্থাৎ ফাতেমার ক্রোধে রাসূল (সা.)ক্রোধান্বিত হন।

প্রথমে আমরা বাক্যাংশের অর্থ ও অনুরূপ বর্ণনা থেকে তার মধ্যে যে মূল্যবান সম্পদ লুকায়িত রয়েছে তা উদঘাটনের চেষ্টা করব। তিনটি শিরোনামে আমরা আলোচনাটি উপস্থাপন করব।

প্রথমত ফাতেমার ক্রোধে রাসূলের ক্রোধান্বিত হওয়ার বিষয়টি অসংখ্য গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আমরা মাসুর ইবনে মাখরামা সূত্রে এরূপ চারটি হাদীস এ প্রবন্ধের শুরুতে বর্ণনা করেছি। কিন্তু মাসুর ছাড়া অন্যান্য সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো তাতে ফাতেমার ক্রোধে এমনকি স্বয়ং আল্লাহ্‌ ক্রোধান্বিত হন বলে বলা হয়েছে। আমরা এরূপ কয়েকটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করছি।

হাকিম নিশাবুরী তার ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব, হাসান ইবনে আলী ইবনে আফফান আল আমেরী থেকে, তিনি কুফার অধিবাসী মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে দুহাইম থেকে, তিনি আহমাদ ইবনে হাতিম থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন থেকে এবং তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.) ফাতেমাকে বলেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।[15]

হাকিম এ হাদীসটির টীকাতে বলেন: হাদীসটি সহীহ সূত্রে বর্ণিত কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি। উল্লেখ্য যে, বুখারী ও মুসলিম তাদের সহীহ গ্রন্থদ্বয় সকল সহীহ হাদীস বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে রচনা করেন নি। এ কারণেই বুখারী তার ‘তারিখুল কাবির’ গ্রন্থে অসংখ্য হাদীসকে সহীহ বলেছেন কিন্তু তার সহীহ গ্রন্থে তা অন্তুর্ভুক্ত করেন নি।

যাহহাক বর্ণনা করেছেন: আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সালিম আল মাফলুয যিনি সর্বজন প্রশংসিত এক ব্যক্তি ছিলেন হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে, তিনি উমর ইবনে আলী থেকে, তিনি জাফর ইবনে মুহাম্মাদ থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী থেকে, তিনি আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) ফাতেমাকে বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।[16]

তাবরানী বর্ণনা করেন: মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্‌ আল হাদরামী, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালিম আল কাযযাজ হতে, তিনি হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী হতে, তিনি আলী ইবনে উমর ইবনে আলী হতে, তিনি জাফর ইবনে মুহাম্মাদ হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি আলী ইবনে হুসাইন হতে, তিনি হুসাইন ইবনে আলী (রা.) হতে, তিনি আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ ফাতেমাকে বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।[17]

হাইসামী বলেন: হাদীসটি তাবরানী হাসান সূত্রে বর্ণনা করেছেন।[18]

সালিহী আশ শামীও হাদীসটির সনদকে হাসান বলেছেন।[19]

অনেক হাদীসবেত্তার দৃষ্টিতেই হাদীসটি মুস্তাফিজ (বর্ণনাকারীদের প্রতিটি স্তরে তিন অথবা তার অধিক সংখ্যক বর্ণনাকারী রয়েছে) সূত্রে বর্ণিত এবং তার বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়ত হাদীসের এ অংশটি থেকে প্রমাণিত হয় হযরত ফাতেমাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করা হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ এবং তাকে সন্তুষ্ট করা অপরিহার্য। এমন কি তাঁকে কষ্ট দান ও ক্রোধান্বিত করা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্‌কে ক্রোধান্বিত করার শামিল যেমনভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করা মহান প্রতিপালকের রহমতের অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার কারণ।

তৃতীয়ত বর্ণিত অংশটি থেকে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর নিষ্পাপত্ব ও ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে হওয়ার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। কারণ হাদীসের এ অংশে মহান আল্লাহর ক্রোধ ও সন্তুষ্টিকে শর্তহীনভাবে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর ক্রোধ ও সন্তুষ্টির অনুবর্তী বলা হয়েছে। যেহেতু মহান সৃষ্টিকর্তা কখনই অন্যায় বিষয়ে সন্তুষ্ট ও অন্যায়ভাবে ক্রোধান্বিত হন না সেহেতু কেউ অন্যায় বিষয়ে সন্তুষ্ট বা ক্রোধান্বিত হলে তিনি তার সন্তুষ্টি ও ক্রোধে সন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হবেন না অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মানদণ্ড হলো সত্য ও ন্যায় তাই ফাতেমারও সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মানদণ্ড হলো সত্য ও ন্যায় এবং তিনি কখনোই এ দু’টি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। আর এর অর্থই হচ্ছে নিষ্পাপত্ব।

সুতরাং আল্লাহ্‌ নিঃশর্তভাবে ফাতেমা (আ.)-এর সন্তুষ্টি ও ক্রোধে সন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হওয়া থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় হযরত ফাতেমার ক্রোধ, সন্তুষ্টি, আনন্দ ও বিষন্নতা সব সময়ই আল্লাহ্‌র ক্রোধ ও সন্তুষ্টির অনুগত। তিনি কখনই পার্থিব ও বৈষয়িক কারণে কারো উপর ক্রোধান্বিত বা অন্যায়ভাবে কারো প্রতি সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হন নাই।

এ কারণেই আস সুহাইল আল মালিকী[20] তার ‘আর রাউজুল আনিফ’ গ্রন্থে আবু লুবাবার পূর্বোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেছেন: এ হাদীসটি প্রমাণ করে, যে হযরত ফাতেমাকে গালমন্দ করে সে কাফের (কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে) এবং যে তাঁর জন্য দোয়া করে ও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ করে সে তাঁর পিতা রাসুল (সা.)-এর জন্যই দোয়া করেছে এবং তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেছে।[21]

উপরিউক্ত সহীহ হাদীসের আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়:

1. হযরত ফাতেমা (আ.) যখন কোন ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হন তখন মহান আল্লাহ্‌ও ঐ ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হন।

2. যখন মহান আল্লাহ্‌ কোন ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হন তখন নিঃসন্দেহে সে জাহান্নামে পতিত হবে স্বয়ং আল্লাহ্‌ এ সম্পর্কে বলেন: যার উপর আমার ক্রোধ বর্ষিত হয় নিশ্চয় সে জাহান্নামে পতিত হয়। (সূরা তাহা: ৮১)।

3. উক্ত আয়াতে ‘জাহান্নাম’ ইঙ্গিত করতে ‘হাওয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাওয়া হলো ঐ স্থান যেখানে উত্তপ্ত অগ্নি রয়েছে। যেমন- আল্লাহ্‌ সূরা আল কারিআতে বলেছেন: তার (পাপী ব্যক্তির) স্থান হবে ‘হাভিয়া’। এবং কি তোমাকে অবহিত করেছে যে, এটা কি? এটি অতি উত্তপ্ত অগ্নি। (আয়াত: ৯-১১)

সুতরাং যে হযরত ফাতেমাকে যে কোনভাবেই ক্রোধান্বিত করবে সে অতি উত্তপ্ত অগ্নিতে প্রবেশ করবে। এখন এই ক্রোধান্বিত করা তাঁর অধিকার হরণ করার মাধ্যমেই হোক (যেমনটি রাসূলের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ঘটেছে) অথবা তাঁর সন্তানদের হত্যা করার মাধ্যমেই হোক (যেমনটি কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর সন্তানদের ক্ষেত্রে ঘটেছে)।

উক্ত হাদীস থেকে অন্য যে সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হলো:

প্রথমত যখন হযরত ফাতেমা (আ.) কোন ব্যক্তির উপর সন্তুষ্ট হবেন মহান আল্লাহ্‌ও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হবেন।

দ্বিতীয়ত যে (হযরত ফাতেমাকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে) মহান আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করবে সে এ আয়াতের ভিত্তিতে ‘তাদের প্রতি আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহ্‌র প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহ্‌র দল। জেনে রাখ, আল্লাহ্‌র দলই সফলকাম হবে (সূরা মুজাদিলা : ২২) আল্লাহ্‌র দলে অন্তুর্ভুক্ত হবে এবং কিয়ামতের দিন ফেরেশতারা তাদের জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) করবেন কেননা আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্‌ বলেন : ‘তারা (ফেরেশতাগণ) ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যার প্রতি তিনি (আল্লাহ্‌) সন্তুষ্ট, অন্য কারো জন্য সুপারিশ করবে না।’ (সূরা আন্বিয়া : ২৮)

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূলের দেহের অংশ হযরত ফাতেমা যাদের প্রতি সন্তুষ্ট আমাদেরকে তাদের অন্তুর্ভুক্ত করুন।
তথ্যসূত্র
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×