somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ভবঘুরে দুপুরবেলা

০১ লা নভেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেলুনটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি মিনিট পাঁচেক ধরে। বাঁহাতে একটা সিগারেটের দোমড়ানো প্যাকেট, খালি। কাঁচের দেয়ালের ওপাশে তিনজোড়া কাঁচির কচকচানি শুনছি তন্ময় হয়ে মোহাবিষ্টের মতো। ধারালো ধাতব শব্দগুলো এই তপ্ত দুপুরের রোদে বেশ সুরেলা শোনাচ্ছে আমার কানে। তবে ঠিক চুল কাটাতে এসেছি বলাটা ভুল হবে। যদিও চুলগুলো বেশ লম্বা হয়ে গেছে, একরকম বিদ্রোহ ঘোষণা করেই ঘাড়ের উপর, চোখের উপর এলিয়ে পড়ে; ঘামে লেপ্টে যায় কুৎসিতভাবে।

হঠাৎ আমার এই ভরদুপুরের ধ্যানমগ্নতায় ছেদ পড়ল। নাপিতদের একজন বলে উঠল,
"চুল কাটাবেন?"
"ওহ্‌..." আমি হুট করেই কথা হারিয়ে ফেলি। ওয়ালেটটা যে খুব একটা সম্পদশালী নয় সেটা মনে পড়ল তখনই।
"নাহ, পরে কাটাবো।" অপ্রস্তুত আমি সরে আসি সেলুনটার সামনে থেকে।

"একটু পরেই ফাঁকা হবে..." পেছনে মিলিয়ে যায় সেই নাপিতের গলা।

ক্যান্টনমেন্ট বরাবর চওড়া রাস্তাটা ধরে হাঁটতে থাকি। মাথায় একটা কবিতার নাম ঘোরা শুরু করেছে ইতোমধ্যেই, "সেলুনে যাবার আগে"। কে লিখেছিল? বিখ্যাত কোন কবি নিশ্চয়ই! অথচ একটা লাইনও মনে পড়ছে না। আনমনেই চুলে হাত চালালাম, হাতের তালুর সাথে একরাশ ঘাম আর বেশ কয়টা চুল উঠে এল; বিরক্ত হয়ে উঠি হঠাৎ করেই। বাঁহাতে ধরা খালি সিগারেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেই পাশের দেয়ালে...

দেয়ালে অনেকগুলো দাগ, রঙ উঠে ছিঁড়ে যাওয়া বেশ কয়টা পোষ্টার। একটা পোষ্টার দৃষ্টি কাড়ল, বেশ কিছু তরুণ তরুণী তর্জনী আর মধ্যমা উঁচিয়ে আছে হাসিমুখে। নিচে বড়বড় অক্ষরে লেখা,
"তুমিও পারবে।"

হেসে উঠি আপনমনে। আমার হাসির শব্দে সতর্কচোখে এদিক ওদিক তাকানো শুরু করল চার পা মেলে শুয়ে থাকা মেটে রঙের কুকুরটা। জিন্সের পকেট থেকে টেনে বার করি ওয়ালেটটা, স্ফীত হয়ে আছে যতসব অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র, মেমো আর কার্ডে। না, মার একটা চিঠিও আছে। প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকার সময় চিঠিটা পেয়েছিলাম। এখনও খুলে দেখা হয় নাই, কিন্তু কেন জানি রেখে দিয়েছি।

এইতো পেয়েছি! দশ টাকার নোটটা লুকিয়েছিল এককোণায়,শালা ধড়িবাজ! নাহয় মাঝখানে ছেঁড়া আছে খানিক, তাই বলে হাতবদল হতে এতো অনীহা ব্যাটার। আমি আঁক কষা শুরু করি, তিনটে গোল্ডলীফ হল তিন গুণন সাড়ে তিন...ধুর শালা! আটআনা শর্ট পড়ে গেছে। আচ্ছা, তাহলে দুটো গোল্ডলীফ আর একটা ম্যাচ নাহয়...

জটিল এই হিসেবনিকেশ শেষে খুশিমনে এগিয়ে গেলাম পানবিড়ির দোকানটার দিকে। বুড়ো একজন বসে আছে।
"দুইটা গোল্ডলিফ আর একটা ম্যাচ দেন।" বলে নিপুণ হাতে ছেঁড়া নোটটা আলগোছে এগিয়ে দেই। ব্যাটা খেয়ালই করল না! কিন্তু সিগারেট আর ম্যাচের সাথে দেখি একটা চকলেটও দিয়ে দিল।
"এটা ক্যান দিলেন মুরুব্বী?"
"খুচরা পায়সা নাই মামা, চকলেট লিয়ে যান।" নির্বিকার মুখে বলে উঠল দোকানদার। পানের পাতা ধুতে শুরু করল এরপর।

চকলেটটা বুকপকেটে পুরে দ্বিধান্বিত আমি পা বাড়াই। ওটা কি কাজে আসবে বুঝে উঠতে পারছি না। এমন নয় যে এক টাকার মূল্য খুব বেশি; এমনকী আমার মতোন কপর্দকহীনের কাছেও নয়। এসব চিন্তা করতে করতে আমি আরো ঘেমে উঠি, ঘাড়ের পেছনে চুলগুলো আরো বেশি লেপ্টে যায়।

হুট করে খেয়াল হল, আমি পাশের গলিতে ঢুকে পড়েছি। এই আবাসিক এলাকাগুলো আমার মোটেও পছন্দ নয়। অবশ্য যারা এরকম জুতোর তলা ক্ষয় করে একেকটা দিন টিকে আছে তাদের কারো এইসব এলাকা ভালো লাগবে না। হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড়ের মুখে সে পড়েছি, দুটো শিশুকে দৌড়ে আসতে দেখলাম। উৎফুল্ল, আনন্দিত..খুশি, ভীষণ খুশি! বয়েসে অপেক্ষাকৃত বড় শিশুটা পাশ কাটিয়ে গেল আমাকে। তবে পেছনের ছোট্ট মেয়েটা আমাকে দেখামাত্রই ব্রেক কষল। লাল রঙের একটা ফ্রক পরে আছে, হাতে নীল রঙের একটা বল। আমাকে অবাক করে দিয়ে ফোকলা দাঁত বের করে হেসে দিল! আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। সিগারেটটা ফেলে এগিয়ে গেলাম শিশুটার দিকে। আশ্চর্য! তাও দাঁড়িয়েই রয়েছে।

মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল। শার্টের হাতায় ডানহাত মুছে নিলাম। সাহস করে এগিয়ে গিয়ে নাক টিপে দিলাম বাচ্চাটার; ভয় পেল না, চমকালো না। উলটো হাসিটা আরো খানিক বিস্তৃত করে বলে উঠলো,
"কাকু তুমি কেমন আছ?"

আরে! এবার চূড়ান্তরকম আশ্চর্য হবার পালা, মোড়ের মাথায় উদয় হলেন একজন নারী। ব্যস্ত পা ফেলে এগিয়ে এলেন,
"উফ! কয়বার বলেছি এই বাচ্চাটাকে...রাস্তাঘাটে যার তার সাথে কথা বলবা না।" আমার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলেন খানিক।

"আরে তুমি! কবে আসলা?" উনার চেহারায় অকৃত্রিম বিস্ময়ের ছাপ।
"এইতো বেশ কয়দিন ধরেই আছি এখানে।"
"কোথায় যাচ্ছো, বাসায় নাকি?"
"হ্যাঁ..." নির্জলা মিথ্যাটা বলি আমি।

ইদানীং পরিচিতদের সাথে রাস্তাঘাটে হঠাৎ দেখা হলে এমনটাই ঘটছে। অন্যদের মতোই কথোপকথনের এই পর্যায়ে বলার মত কিছু খুঁজে পেলেন না ভাবী। আমি পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
"আমি ওকে চিনতে পারি নাই, ও কিন্তু ঠিকই চিনছে আমারে।"
ভাবী শুনে হাসে, স্নেহের চোখে মেয়েটার দিকে রাকায়। আমি বুক পকেট হাতড়াতে থাকি। বছর পাঁচেক আগে এরকম দেখা হলে ভাবী এরপর বলতো "তাহলে বাসায় ঘুরে যাও একদিন, কেমন!"

এখন সেই সময়টা নেই আর। কথোপকথনের শেষ বাক্যটা বলবার দ্বায়িত্ব এখন আমার ঘাড়ে। আমি চকলেটটা বের করে ছোট মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দেই, একবার মার দিকে চেয়ে হাত পেতে নিয়ে নিল সেটা। ভাবীর দিকে চেয়ে বলি,
"তাহলে যাই, পরে দেখা হবে।" ভাবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়েন। আমি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। পেছন ঘুরে দেখি শিশুটা হাত নাড়ছে আমার দিকে, প্রত্যুত্তরে একবার হাত তুলি।

তখনই মনে পড়ল, কবিতাটা শহীদ কাদরীর লেখা।

এক পশলা বৃষ্টির আশায় উপরে তাকাই। নেই, মেঘের কোন ছিটেফোঁটাও নেই। সমস্যা নেই ওতে, শেষপর্যন্ত হিসেবটা মেলানো গেল। জুতোর বাঁ পাটির এককোণা ছিঁড়ে গেছে। বুড়ো আঙুলটা কুঁচকে হাঁটতে হাঁটতে ফোস্কা পড়ে গেছে, ব্যাথা করছে ভীষণ। তবে এসব পাত্তা দেবার সময় নেই।

আরেকটা চওড়া রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে, পকেটে একটা সিগারেট আর একটা প্রায় আনকোরা ম্যাচ। ঘণ্টাদুয়েক বেঁচে থাকবার রসদ মজুত আছে।
আমি হাঁটতে থাকি...




(শেষ)

-riz
৩১ শে অক্টোবর, ২০১০

৬০টি মন্তব্য ৬০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×