বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের মামলা শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
Published : 14 Aug 2013, 04:54 PM
হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।
ট্রাইব্যুনালের বেঁধে দেয়া সময়ে বুধবার সকালে এক ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদেরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও আহসানুল হক হেনা।
এরপর উপস্থাপিত যুক্তিতর্কের জবাব দেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন, তুরিন আফরোজ ও জেয়াদ আল মালুম।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এটিএম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।
এখন যে কোনো দিন এ মামলার রায় দিতে পারে ট্রাইব্যুনাল।
যুক্তিতর্কের শেষ দিনে আসামির আইনজীবী আহসানুল হক হেনা প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্যের ‘অসঙ্গতি’ তুলে ধরেন। আর ফখরুল ইসলাম একাত্তরে সালাউদ্দিন কাদেরের পাকিস্তানে অবস্থানের বিভিন্ন ‘তথ্য ও নথি’ তুলে ধরেন।
আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীদের দেয়া জবানবন্দির বিভিন্ন ‘অসঙ্গতি’ এবং তাদের দাখিল করা নথিপত্রের ‘অপ্রাসঙ্গিকতা’ তুলে ধরে বক্তব্য দেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।
এরপর মামলার বিভিন্ন আইনি দিক এবং কয়েকটি বিদেশি মামলার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন তুরিন। জেয়াদ আল মালুম এরপর সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
আহসানুল হক হেনা বলেন, এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মূলত একটি দেশীয় আদালত। সুতরাং এই আদালতের বিচারে কোনো আন্তর্জাতিক বা বিদেশি আইন বা সংজ্ঞা ব্যবহার করা যাবে না।
“৪০ বছর পর এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনটি কোনো পরিবর্তন ছাড়াই পুরোপুরি কার্যকর করা হয়েছে মূলত আইনটির অপব্যবহার করার জন্য। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার জন্যই আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে।”
শুধু পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক কারণেই সালাউদ্দিন কাদেরকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে বারবার দাবি করেন হেনা।
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন সাফাই সাক্ষীদের বক্তব্যের অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, আসামির সাক্ষীদের কেউই অভিযোগে বর্ণিত ঘটনার দিন বা তারিখগুলোর বিপক্ষে কিছু বলেননি বা কোনো অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তাছাড়া একই ঘটনা প্রসঙ্গে তাদের একজনের বক্তব্যের সঙ্গে অন্যজনের বক্তব্যের মিল নেই।
“সালাউদ্দিন কাদের নিজের দেয়া সাফাই সাক্ষ্যে দাবি করেছেন তাকে তার কাজিন তেজগাঁ বিমানবন্দরে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি বিমানে উঠেছিলেন কি না তা কেউ দেখেছে বলে জানাননি।”
প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দ্বিধাহীনভাবে জঘন্যতম অপরাধগুলো ঘটিয়েছেন, যার মধ্যে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন রয়েছে। অপরাধ সংঘটনের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছিলেন।”
তিনি আরো বলেন, “এসব অপরাধের জন্য তার (সালাউদ্দিন কাদের) মধ্যে কখনো কোনো অনুতাপ দেখা যায়নি। তার আইনজীবীরাও এ ব্যাপারে কোনো দুঃখ প্রকাশ করেননি। এসব অপরাধে তিনি জড়িত ছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছে, তাই সর্বোচ্চ শাস্তি তার প্রাপ্য।”
২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর গত বছরের ৪ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে একাত্তরে রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতার পর এ নিয়ে মামলাও হয়। এছাড়া ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।
২০১০ সালের ২৬ জুলাই তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। গাড়ি পুড়িয়ে যাত্রী হত্যার এক মামলায় ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এ সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ১৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এরপর গত বছর এপ্রিলে আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলে সাক্ষাগ্রহণ শুরু হয়।
এ মামলায় সালাউদ্দিন কাদেরের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি নিজেসহ মোট চারজন। অন্য তিনজন হলেন তার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু নিজাম আহমেদ, এশিয়া-প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য কাইয়ুম রেজা চৌধুরী এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন চৌধুরী।
আর সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলামসহ প্রসিকিউশনের মোট ৪১ জন সাক্ষী। আর চারজন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল।