somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৭৫-এর ১৫ আগস্টঃ যা ঘটেছিল সেদিন

১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফজরের নামাজ শেষে পাঞ্জাবিটা খুলে রেখে প্রতিদিনের মত তিন তলার জানালার পাশে বসেছেন বঙ্গবন্ধু। পাশে এসে দাঁড়ি-য়েছেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা। পূবের আকাশটা লাল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। দুজনেই নীরবে তাকিয়ে সেদিকে। হঠাত্ করেই বেপরোয়া গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটা। খানখান হয়ে গেল শান্ত প্রত্যুষের নীরবতা।

জীবনে অনেক ইতিহাস, অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেগম মুজিবের অন্তর সেদিন হয়তো কেঁপে উঠেছিল অজানা আশঙ্কায়। উত্কণ্ঠিতভাবে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, কারা যেন গুলি করছে! বেগম মুজিব জানতেন না বাংলার ইতিহাসের সবচে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা হয়েছে যে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে; সে বাড়িতেই ইতিহাসের সবচে কলঙ্কজনক, সবচে বেদনাদায়ক অধ্যায়ের জন্ম দিতে ঢুকে পড়েছে এক দল জল্লাদ। হাতে তাদের উদ্ধত মারণাস্ত্র। মৃত্যু ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের গুলিতে ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন বাড়ির কয়েকজন রক্ষী। বঙ্গবন্ধু ব্যাপারটা জানার জন্য টেলিফোন তুলে নিয়ে প্রথমেই ডায়াল করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি। এনগেজড! তাকে না পেয়ে তিনি ফোন করলেন জীবনের সবচে বিশ্বস্ত সঙ্গী তাজউদ্দিনকে। তার ফোন ডেড! এরপর তিনি ফোন করলেন কর্নেল জামিলকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, জামিল, আর্মিরা আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। আমি কাউকেই ফোনে পাচ্ছি না। জামিল বললেন, স্যার, আমি এক্ষুণি আসছি!

ততক্ষণে গুলির আওয়াজ বেড়েই চলেছে। কি ঘটছে জানবার জন্য বঙ্গবন্ধু নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির নিচে জল্লাদ মহিউদ্দিন আর জল্লাদ বজলুল হুদা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, কি হচ্ছে এখানে? কি চাও তোমরা? তারা বলল, স্যার আপনাকে নিতে এসেছি! আমাদের সঙ্গে চলুন, প্লিজ! বঙ্গবন্ধু বললেন, কোথায় যাব? ঘাতকরা বলল, ক্যান্টনমেন্টে। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমাদের কথায় আমি যেতে পারি না। দরকার হলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পার। বজলুল হুদা বলে, আপনি না গেলে আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা কি ভেবেছিস? তোদের কথায় আমি কোথায় যাব! আমি ক্ষমতা চাই না; তবে এভাবে দেশকে ধ্বংসও হতে দেব না। আর্মিরা যদি দেশ চালাতে পারে, ক্ষমতা নিক! জেনারেলরা কোথায়? মেজর মহিউদ্দিন বলে, তারাই আমাদের পাঠিয়েছে। আপনি চলুন, সেখানে গেলেই দেখতে পাবেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, বেশ, কামাল আমার সঙ্গে যাবে। এই বলে তিনি উপরে উঠে গেলেন। কিশোরগঞ্জের ধসুদল গ্রামের কিশোর আবুল কালাম ভুঁইয়ার কাছ থেকে পাঞ্জাবিটা নিয়ে পরে নিলেন। কয়েকটা জায়গায় ফোন করলেন। জানালেন, তার বাড়ি আক্রান্ত। এসময় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লার ফোন পেলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। জলদি ফোর্স পাঠাও। সেনাপ্রধান বললেন, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট দ্যা হাউস? পাইপটা হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলেন নামার জন্য। ততক্ষণে মেজর ফারুক, মেজর রশিদ তাদের দলবল নিয়ে চলে এসেছে ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু আবার নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন—ঘাতকরা সব দাঁড়িয়ে সিঁড়ির নিচে। মেজর শরিফুল হক সেখানে এসে চিত্কার করে বলল, এতো দেরি হচ্ছে কেন? শেখ মুজিব আর পাঁচ মিনিট বেঁচে থাকলে সব শেষ হয়ে যাবে। এক্ষুণি শেষ কর তাকে। বলার সঙ্গে সঙ্গে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, নায়েব রিসালদার সারোয়ার হোসেন স্টেনগান দিয়ে ৬৪টি গুলি ছোঁড়ে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৫টা বেজে ৪০ মিনিট। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল সিঁড়িতে। নিজে বাঙালি বলে চিরকাল যিনি গর্ব করেছেন, পাকিস্তানিদের খোঁড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যিনি গর্বভরে বলেছেন, 'ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার আগে বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা....', এ বাংলাকে যিনি প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতেন—সেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল এ বাংলার জল-হাওয়ায় পুষ্ট কিছু ঘৃণ্য নরপশু। যিনি না জন্মালে বাংলা নামে দেশটির কখনো জন্ম হতো না, বাংলার আপামর মানুষ যার নির্দেশে বুকের রক্ত ঢেলে এ দেশকে মুক্ত করেছে, সেই প্রিয় নেতাকে এভাবে হত্যা করা হতে পারে—তা ছিল কল্পনারও অতীত।

ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, সেদিন তারা হত্যা করেছিল বেগম মুজিবকে, ছোট্ট রাসেলসহ তিন সন্তানকে, ভাই শেখ নাসেরকে, দুই পুত্রবধূকে। একজন পুলিশ অফিসার রাসেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন বলে তাকেও হত্যা করে জল্লাদরা। সন্তানদের মধ্যে শুধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন দেশে ছিলেন না বলে। ঘাতকরা শেখ মনির বাড়িতে গিয়ে শেখ মনি ও তার স্ত্রী বেগম মনিকে হত্যা করে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গিয়ে জল্লাদরা হত্যা করে সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বাবু সেরনিয়াবাত, নান্টু ও কয়েকজন কর্মচারীকে। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ৩২ নম্বর বাড়িতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলকেও হত্যা করেছিল তারা।

পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়েছে। কেউ কেউ শাস্তি পেয়েছে, পালিয়ে আছে কেউ কেউ। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে, বাঙালি জাতিকে কয়েকশ' বছর পশ্চাতে ঠেলে দেয়ার এ ষড়যন্ত্রের পেছনে শুধু এ কয়েকজন খুনিই জড়িত ছিল না। ছিল আরো অনেক বড় ক্ষমতাধররা—যাদের কথা হয়তো জানা যাবে না কোনদিন। সু্ত্র
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×