somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: কবি ও সুলতান

২১ শে অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘করযোড়ে বন্দিলাম ঠাকুর কৃত্তিবাস
যাঁহা হৈতে রামায়ণ হইল প্রকাশ।’
(কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী )

১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসের এক গুমোট রাত্রিতে সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর ঘুম আসছিল না। তিনি বাংলার প্রতাপশালী সুলতান, তবুও ঘুম জিনিসটা তাঁর এখতিয়ারের বাইরে। বৈশাখের শুরু থেকেই তীব্র খরা চলছে । লখনৌতি প্রাসাদের রাজকীয় শয়নকক্ষের বিশাল জানালাটি দিয়ে ঘিয়ে রঙের ফুটফুটে জোছনা ঢুকছে বটে- তবে সেই জোছনায় বাতাসের চিহ্নমাত্র নেই; সুলতানের সারা শরীর ঘেমে উঠেছে, গলার কাছে মৃদু তৃষ্ণা; তথাপি সুলতান মোটেও বিরক্ত বোধ করছেন না, বরং গুমোট ভাবটি তিনি বেশ উপভোগ করছেন ।
বিশাল পালঙ্কটির একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছেন গুলশান বেগম । গুলশান বেগম বেশ শান্তিতেই ঘুমোচ্ছেন মনে হল। আধো-অন্ধকারে মুচকি হাসলেন সুলতান । ঘুমাক, বিবি গুলশান ঘুমাক। আর আমি এখন গঙ্গার ধারে যাই। লখনৌতি রাজকীয় শয়ন কক্ষ বাতাসশূন্য হতে পারে, নির্জন নদীপাড় কখনও বাতাসশূন্য থাকে না। কথাটা ভেবে কী কারণে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুলতান। মাঝে-মাঝে রাত্রিকালে গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়ান সুলতান, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। কখনও পূর্বপুরুষ আব্বাসীয় খলিফাদের মতো রাত্রির লখনৌতি নগর পরিভ্রমন করেন । তিনি বাঙ্গালার সুলতান, বাঙ্গালার সবচে উদ্বিগ্ন মানুষ; একজন সুলতানের দায়িত্ব সম্বন্ধে সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর এ রকম ধারণাই পোষণ করেন।
সুলতান পালঙ্ক থেকে নেমে গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে আর পায়ে নাগরা গলিয়ে ধীরেসুস্থে শয়নকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
দীর্ঘ প্রশস্ত আলোছায়াময় অলিন্দ পেরিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে এসে আবার দীর্ঘ প্রশস্ত আলোছায়াময় অলিন্দ পেরিয়ে নারায়ণ দাস এর কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালেন সুলতান। নারায়ণ দাস অপেক্ষা করেই ছিলেন। মধ্যবয়েসী নারায়ণ দাস সুলতানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহচর। নগর পরিভ্রমনে সময় নারায়ণ দাস সুলতানের সঙ্গী হন। সঙ্গী হিসেবে নারায়ণ দাস অত্যন্ত চমৎকার এবং বৈদিক শাস্ত্রে সুপন্ডিত । রাত্রি ভ্রমনের সময় নারায়ণ দাস উপনিষদ থেকে সুলতানকে শ্লোক আবৃত্তি করে শোনান, তারপর মানে বলে দেন। এভাবে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে সুলতানের জ্ঞানের পরিধী বেড়ে চলেছে।
সুলতানের পরনে সাধারণ পোশাক। সিংহদুয়ারে পৌঁছে কোনও ধরনের বাধা সম্মূখীন হলেন না। আটত্রিশ বছর বয়েসি উদার-হৃদয় খেয়ালি সুলতান প্রাসাদ-রক্ষীদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও এমন বিরল সৌভাগ্য অনেক বাদশার ভাগ্যেও জোটে না। সুলতানকে দেখেই প্রহরীরা সতর্ক হয়ে উঠল। নারায়ন দাস প্রহরীদের ইঙ্গিত করেন। অবিলম্বে রাত্রির লখনৌতি নগরে গুপ্তচর ও সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়বে এবং তৈরি করবে সুলতানের জন্য নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় ...
প্রাসাদের মূল ফটক পেরিয়ে বাইরে চলে এলেন সুলতান। আকাশে বৈশাখী চাঁদ। অকৃপণ শুভ্র কিরণ ঢেলে দিচ্ছে ঘুমন্ত লখনৌতি নগরের উপর । সুলতান ফুরফুরে মেজাজে হাঁটছেন। সড়কের দু’পাশের দৃশ্যাবলী কেমন নির্জন আর ছায়াছায়া। সমৃদ্ধশালী লখনৌতি নগরের যে কোনও দৃশ্যই সুলতানকে করে তোলে
আত্মবিশ্বাসী । লখনৌতি এখন সমগ্র বাঙ্গালার রাজধানী। বাঙ্গালায় এখন মুসলমানদের শাসন বহুদূর বি¯তৃত। শাসক ও সুফি দরবেশ খান আল-আজম উলুগ খান জাহান বাঙ্গালার সুদূর দক্ষিণে (খুলনা-যশোহর) জয় করেছেন। চিত্তাকর্ষক ষাটগম্বুজ মসজিদ নিমার্ণ করেছেন। এসই ঘটেছে সুলতানের পিতা সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহর জামানায়। কে না জানে সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ ছিলেন শান্তিপ্রিয়, তাঁর আমলে দিল্লি সালতানাতের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। বাঙ্গালার মানুষ আজও মসজিদ নির্মাণ, পুকুর খনন -এসব ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজের জন্য সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে । সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ শিল্প ও স্থাপত্যে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঢাকার বখন বিনত মসজিদটি তাঁরই আদেশে নির্মিত হয়েছিল। বছর দুই হল সুলতানের পিতা ইন্তেকাল করেছেন। সেই শোকার্ত স্মৃতির স্মরণে সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এই মুহূর্তে বিষন্ন হয়ে ওঠেন। মৃত্যুশয্যায় পুত্রের প্রতি পিতার নির্দেশ ছিল শিল্প ও স্থাপত্যে পৃষ্ঠপোষকতা যেন অব্যাহত থাকে। সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ অত্যন্ত উদার এবং অসা¤প্রদায়িক একজন মানুষ বলেই তাঁর পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
কাছেই কোথাও প্রাচীরের ওপাশে হয়তো আস্তাবল রয়েছে। একটি ঘোড়া ডেকে উঠতেই সম্বিৎ ফিরে পেলেন সুলতান। ধর্মশালা ও কোতোয়ালী দরওয়াজার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদূরে নগর প্রাচীর দিকে তাকালেন। প্রাচীরটি ‘বাইশগজী’ প্রাচীর নামে পরিচিত, প্রাচীরটির অটল দাঁড়িয়ে থাকা সুলতানকে তৃপ্ত করে।
গঙ্গার তীরে মধ্যরাত্রির নির্জনতা ছেয়ে আছে। আকাশে ও চরাচরে স্নিগ্ধ বৈশাখী জোছনার ঢল। এবং বাতাসে উত্তাল। সুলতান স্বস্তি পেলেন। বললেন, বল, নারায়ণ, আজ কি শ্লোক শোনাবে?
নারায়ণ দাস এই মুহূর্তে অত্যন্ত সুললিত কন্ঠে উপনিষদ থেকে আবৃত্তি করলেন: ঈশাবাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ/ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম।
হুমম। কি এর মানে? সুলতান চারিদিকে তাকিয়ে বললেন।
নারায়ণ দাস বললেন, এই চলমান পৃথিবীতে যা চলছে তা ঈশ্বর দ্বারা আবৃত বলে জানবে এবং সম্পদের লোভ নয়, ত্যাগের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাবে।
সুলতান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নদীর দিকে তাকালেন । ধবল জোছনার আলোয় নদীর পানি চিকচিক করছে; নদীতে একখানি পাল তোলা নৌকা। কোথায় ভেসে চলেছে কে জানে। বাল্যকালে সুলতান পিতার সঙ্গে নদীপথে দক্ষিণ বাঙ্গলায় গিয়েছিলেন। দক্ষিণ বাঙ্গলা সে সময় খান জাহান আলীর নিয়ন্ত্রনে ছিল। তিনি ষাটটি গম্বুজ বিশিস্ট একটি মনোরম মসজিদ নির্মান করেছেন। সেই মসজিদের ব্যাতিক্রমী নকশা দেখে পিতা-পুত্র বিস্মিত। দক্ষিণ বাঙ্গলা থেকে ফেরার আগে সুফি খান জাহান আলীকে কে পিতা বললেন, আপনি আল্লাহর ওলি, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। খান জাহান আলী বললেন, সর্বদা আল্লাকে স্মরণ করবেন। যেন তিনি আপনাকে দেখছেন। আর নিয়মিত গরীব দুঃখীর খোঁজখবর নেবেন। তারা ভুখা থাকলে সুলতানী হালাল হয় না।
সুলতান শ্বাস টানলেন। হিন্দুস্তানের প্রাচীন সুফিরা যেন কি বলেছেন, এই চলমান পৃথিবীতে যা চলছে তা ঈশ্বর দ্বারা আবৃত বলে জানবে এবং সম্পদের লোভ নয়, ত্যাগের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাবে।
হুমম।



বৈশাখের এই রাত্রে গৌড় নগরের একটি ধর্মশালার ভিতরে প্রবল গুমোট তার শুস্ক নখর ছড়িয়েছে যেন। মৃদু তাপদাহে ঘুম আসছিল না কৃত্তিবাস-এর। এখন কত রাত? এত রাত্রে ধর্মশালাটি কেমন নিথর নিঃশব্দ হয়ে রয়েছে। কৃত্তিবাসের শরীরে ঘাম, গলার কাছে তৃষ্ণা। না, শুয়ে থেকে সেদ্ধ না হয়ে বরং ধর্মশালার বাইরে কোনও খোলা জায়গায় দাঁড়ানো যাক।
কৃত্তিবাস উঠে দাঁড়ালেন। এবং ধর্মশালার বাইরে চলে এলেন।
ধর্মশালার বাইরে থইথই করছিল বৈশাখী জোছনার সমুদ্র ; কৃত্তিবাস কবি বলেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
এত রাত্রে গৌড় নগরটিও কেমন স্তব্দ নির্জন হয়ে রয়েছে। ধর্মশালাটি নগরের কোতোয়ালী দরওয়াজার ঠিক উলটো দিকে । পুরনো দালানটির বিশাল খিলান ও সচ্ছিদ্র প্রাচীর আর অর্ধবৃত্তাকার বুরুজটি সড়কের উপর কেমন এক ভৌতিক ছায়া ফেলেছে। সেদিকে তাকিয়ে কৃত্তিবাসের নম্র স্নায়ূতন্ত্রে এক ধরণের ভীতিকর অনুভূতি হয়। এসই নগরের অনুষঙ্গ। সচরাচর তিনি নগর এড়িয়ে চলেন। তবে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি গৌড় নগরে এসেছেন।
গঙ্গার দিক থেকে শীতল বাতাস ধেয়ে আসছিল। কৃত্তিবাসের পরনে ধুতি এবং উত্তরীয়; উত্তরীয়টি দূরন্ত বাতাসে উড়ছিল। কৃত্তিবাস কী মনে করে গঙ্গার দিকে হাঁটতে থাকেন । সহসা ফাঁকা সড়কে ক্ষুরধ্বনি তুলে একটি ঘোড়াগাড়ি চলে যায়। বাঁ পাশে একটি পুরনো দালানের প্রাচীর ঘেঁষে একটি মাতাল জড়ানো কন্ঠে বিকৃত সুরে কী সব বলছে। গৌড় নগরের গণিকালয়টি এদিকেই কোথাও হবে। গণিকারা পুরুষের ক্ষণকালের সঙ্গিনী। গণিকার ঘেমে যাওয়া শরীরের সান্নিধ্যে মাতালটির কি সুখলাভ হল? কৃত্তিবাস কবি। কবিরা এ সমস্ত নিষিদ্ধ ভাবনার অনুসঙ্গে আলোড়িত হন।
একবার পিছন ফিরে কোতোয়ালী দরওয়াজার দিকে তাকালেন কৃত্তিবাস। দরওয়াজাটি নির্মিত হয়েছিল গৌড়েশ্বর সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ এর আমলে। ইনি আর জীবিত নেই, সুলতানপুত্র সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এখন বাংলার সুলতান। সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর সঙ্গে দেখা করতে চান কৃত্তিবাস । তার কারণ আছে ...
নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান কৃত্তিবাস । পিতা বনমালী ওঝা, পিতামহ মুরারি ওঝা। পূর্বে ওঝা পরিবারটির নিবাস ছিল পদ্মার পাড়ে, পরে পরিবারটি গঙার পাড়ে চলে আসে। এই ঘটনা নিয়ে কৃত্তিবাস আত্মকথায় লিখেছেন :

পূর্ব্বেতে আছিল বেদানুজ মহারাজা
তাঁহার পাত্র আছিল নারসিংহ ওঝা।
বঙ্গদেশে প্রমাদ হইল সকলে অস্থির
বঙ্গদেশ ছাড়িয়া ওঝা আইলা গঙ্গাতীর।।

বাল্যকাল থেকেই কৃত্তিবাস অত্যন্ত মেধাবী এবং কৌতূহলী। শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছেন পিতামহ মুরারি ওঝার কাছে । পিতামহের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল। কত যে কথা হত পিতামহের সঙ্গে। এই যেমন বালক কৃত্তিবাস জিজ্ঞেস করত, পদ্মাপাড়ে তোমার বাড়ি কই ছিল দাদু ?
মানিকগঞ্জ।
বড় সুন্দর জায়গা, তাই না?
বড়ই সোন্দর, সেই সৌন্দর্যের কথা আর কী কমু ক। তয় গঙ্গাপাড়ের ফুলিয়া গ্রামও বড় সুন্দর।
পিতামহের অনুপ্রেরণায় বাল্মীকি রামায়ণ কন্ঠস্থ করেছেন কৃত্তিবাস । মৃত্যুর আগে একদিন পিতামহ মুরারি ওঝা বললেন, দেখিস কিত্তি, একদিন তুই অনেক নাম করবি । লোকে তোরে কইব কীর্তিবাস।
কৃত্তিবাস হাসে।
শোন কিত্তি, আমরা হইলাম গিয়া বাঙালি আর বাল্মীকি রামায়ণ লিখছে সংস্কৃত ভাষায়। বাঙালি সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ পড়ব ক্যান? আজইও বাংলায় রামায়ণ কেউ অনুবাদ করে নাই। তুই কর কিত্তি।
পিতামহের কথায় কিশোর কৃত্তিবাসের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় ।
পিতামহ আরও বললেন, আর শোন কিত্তি, আমরা হইলাম গিয়া বাঙালি। রাম, লক্ষ্মণ সীতা-এই সবেরে বাঙালির মতো কইরাই দেখাইবি। বুঝলি।
আচ্ছা।
সেই থেকে কিশোর কৃত্তিবাসের মনে পয়ারে বাল্মীকি রামায়ণের একখানা সুললিত পদ্যানুবাদ করার সংকল্প করে। তরুণ বয়েসে পৌঁছে কয়েক ছত্র বাংলা রামায়ণ লিখেও ফেলে। কৃত্তিবাসের তরুণ বয়েসে রাজা গনেশ কিছু সময়ের জন্য গৌড়েশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। রাজা গনেশ সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজাকে কিছু শ্লোক শুনিয়েছেন কৃত্তিবাস।

রাজ্যচ্যুত যদ্যপি হয়েছি আমি বটে
রাজলক্ষ্মী আমার ছিলেন সন্নিকটে।
আমার সে রাজলক্ষ্মী হারালাম বনে
কৈকেয়ীর মনোভীষ্ট সিদ্ধ এত দিনে।

রাজা গনেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠে কৃত্তিবাসকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দান করতে চেয়েছেন। কবি তা অগ্রাহ্য করেছেন।
এতে অবশ্য কবিস্ত্রী গৌড়ীর সাংঘাতিক মন খারাপ হয়েছিল। সবই বোঝেন কৃত্তিবাস। দু’টি সন্তানের জননী গৌড়ী, স্বামী সারাদিন কাব্যচিন্তায় আচ্ছন্ন থাকলে সংসার কি করে চলে। ভাগ্যিস ফুলিয়া গ্রামে পৈত্রিক ভিটেমাটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন কৃত্তিবাস।
সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহকে কবিতা শোনাতে চান কবি কৃত্তিবাস ; এ কারণেই গৌড় নগরে এসেছেন। এখন সুলতানের সাক্ষাৎ লাভ করতে চান। কেননা, তিনিই এখন প্রকৃত গৌড়েশ্বর । শুধু তাই নয়, সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ অত্যন্ত উদার এবং শিল্পরসিক একজন মানুষ। সুলতানের যদি কবিতা ভালো লাগে তো কৃত্তিবাস এর জীবন ধন্য হয়। কিন্তু সমস্যা সুলতানের সঙ্গে দেখা করা যাচ্ছে না। হুট করে তো আর রাজদরবারে ঢোকা যায় না। সিংহদরওয়াজার দৌবারিক নানা প্রশ্ন করে । কৃত্তিবাস কবি। গৌড় নগরে কত কবি। তাই বলে সুলতান কি সকলেই সঙ্গেই দেখা করবেন?
গঙ্গার ধারে চলে এসেছেন কৃত্তিবাস। পাড়টি উঁচু করে বাঁধানো। একপাশে প্রশস্ত রাজপথ। পাড়ে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছের সারি । নদীর ঘাটটি বেশ প্রশস্ত আর পাকা। সিঁড়ি নেমে গেছে জলের কিনারায়।
ঘাটে দু’জনকে দেখলেন কৃত্তিবাস। তিনি মুচকি হাসলেন। নগরে সবাই ঘুমায় না। জগতের প্রতিটি নগরে তার মতন ছন্নছাড়া কিছু লোক থাকে। যারা মধ্যরাতে জেগে থেকে জোছনা পান করতে ভালোবাসে কিংবা নদীর নোনা গন্ধ নেয়। লোকদুটির পোশাকআশাক পরিপাটি। কৃত্তিবাস ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে থাকেন।
একজন প্রশ্ন করেন, আপনি?
আমার নাম কৃত্তিবাস, কৃত্তিবাস ওঝা। জাতে ব্রাহ্মণ।
হুমম। বুঝলাম। বাড়ি?
নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামে।
নদীয়া তো অনেক দূর। তা লখনৌতি নগরে কেন এসেছেন?
কৃত্তিবাস ইতস্থত করে বললেন, সে কথা কি আপনাদের বলা সমীচীন হবে?
নারায়ণ দাস বললেন, নির্ভয়ে বলুন। আমরা ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ।
কৃত্তিবাস বললেন, আমি গৌড়েশ্বর সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর সঙ্গে দেখা করতে গৌড় নগরে এসেছি।
কেন? মুহূর্তেই নারায়ণ দাস সতর্ক হয়ে ওঠেন। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। এই লোক সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন ? এ লোক উড়িষ্যা কিংবা কামরূপের গুপ্তচর নয়তো? তিনি সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকান, কাছেই ছদ্মবেশধারী সশস্ত্র প্রহরীর থাকার কথা।
কৃত্তিবাস বললেন, আমি কবি। আমি সুলতানকে কবিতা শোনাতে চাই।
ওহ্ । নারায়ণ দাস আশ্বস্ত হলেন।
সুলতান মুচকি হেসে বললেন। কবিতা শোনাবেন? শোনান।
কৃত্তিবাসও হাসলেন। বললেন, কি আশ্চর্য! কবিতা আপনাকে শোনাব কেন? আপনি কি বাংলার সুলতান?
হ্যাঁ। আমিই বাঙ্গালার সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ। আমার পিতা সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ। আমার পিতার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?
কৃত্তিবাস নিথর হয়ে গেলেন। আমার সামনে পরম পূজনীয় গৌড়েশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন। যাকে আর এখন কী সহজে পেয়ে গেলাম। কৃত্তিবাস পরমেশ্বরকে প্রণাম করে। তবে স্বয়ং সুলতান চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন- এ সত্যটি মেনে নিতে কষ্ট হল।
কি হল-কবিতা শোনান।
কৃত্তিবাস আবৃত্তি করতে শুরু করেন। গোদাবরী নীরে আছে কমল কানন/ তথা কি কমলমুখী করেন ভ্রমন/পদ্মালয়া পদ্মমুখী সীতারে পাইয়া/ রাখিলেন বুঝি পদ্মবনে লুকাইয়া।
সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর মাতৃভাষা বাংলা নয়। নারায়ণ দাস ফিসফিস করে কিছু বললেন। সুলতান মাথা নাড়লেন। চারটি পঙতির প্রশংসা করলেন।
কৃত্তিবাস বললেন, পরম পূজনীয় গৌড়েশ্বর। আমি বাংলায় বাল্মীকি রামায়ণের একখানা সুললিত পদ্যানুবাদ করার সংকল্প করেছি।
আচ্ছা। বেশ বেশ। সুলতান মাথা নাড়লেন। তিনি আগেই নারায়ণ দাস-এর কাছে রামায়ণের কাহিনী শুনেছেন এবং যথারীতি ভারতীয় প্রতিভার গভীরতা উপলব্দি করেছেন । তবে এ মুহূর্তে সুলতান সামান্য বিচলিত বোধ করলেন। সুলতান নারায়ণ দাস কে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার নারায়ণ, আজও বাঙ্গালায় রামায়ণের অনুবাদ হয়নি?
না। সুলতান।
বল কি! আফসোস। আফসোস। এমন মহৎ সাহিত্য। কবি আপনি আপনার অনুবাদ শেষ করুন। এর জন্য যা যা লাগে আমি ব্যবস্থা করব। আপনাকে আমি শত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা দেব ।
কবির গৌড়ীর অভাবক্লিস্ট মুখখানা মনে পড়ল। তা সত্ত্বেও কৃত্তিবাস অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, গৌড়েশ্বর আমি শত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা চাইনা ।
তা হলে? সুলতান বিস্মিত হলেন। এ কেমন মানুষ-যার শত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রার লোভ নেই।
কৃত্তিবাস বললেন, আমার অনুবাদ বাঙালির ভালো লাগলেই আমার জীবন ধন্য মনে করব।
এ কথায় সুলতান অভিভূত হলেন। সংসারে সৎ মানুষের দেখা সহজে মেলে না। কবিকে বন্ধুর মতন জড়িয়ে ধরলেন সুলতান। বৈশাখি পূর্ণিমার নির্মল আলোয় গঙ্গা তীরের এই মানবিক দৃশ্যে কি যে ছিল- নারায়ণ দাস এর চোখে জল এসে যায়।

পুনশ্চ:

(১) এ গল্পে কবি ও সুলতানকে যেভাবে দেখানো হয়েছে বাস্তবে সেভাবে ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। ডক্টর হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাসকে প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহায্য দিয়েছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৪)’। (দ্র: লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। পৃষ্ঠা; ৬৩) এই বাক্যটিই এই গল্পের প্রেরণা। অবশ্য দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন ... কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের পৃষ্টপোষকতা লাভ করেছিলেন তিনি হলেন রাজা গণেশ। এ কারণে এই গল্পে রাজা গণেশের কথাও উল্লেখ করেছি। ‘লাল নীল দীপাবলী’ বইতে ডক্টর হুমায়ুন আজাদ আরও লিখেছেন, ‘বাঙলা রামায়ণ মানেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ। এ-বই কয়েক শো বছর ধরে বাঙলার হিন্দুদের ঘরে ঘরে পরম ভক্তিতে পঠিত হচ্ছে।’ (দ্র: ঐ, পৃষ্ঠা; ৬৪) শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান পাদ্রিরা সর্বপ্রথম ১৮০২ কিংবা ১৮০৩ সালে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ছাপেন । পরবর্তী কালে ১৮৩০ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার নতুন করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ মুদ্রিত করেন। বাংলা সাহিত্যের এসব ঘটনার পিছনে পঞ্চদশ শতকের একজন মুসলিম শাসকের মুখ জ্বলজ্বল করে ... তিনি হলেন সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহ ...
(২) কৃত্তিবাস-এর আত্মকথা ও রামায়ণের চরণগুলি দীনেশচন্দ্র সেন রচিত “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” থেকে নেওয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্র: (১) ডক্টর হুমায়ুন আজাদ; লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। (২) দীনেশচন্দ্র সেন; বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)

উৎসর্গ: অন্ধ আগন্তুক
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×