রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুল জলিল মিয়া। তাঁর ভাই মাহবুবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিসাব সহকারী। মেয়ে রোমানা ফেরদৌস জুনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা। হিসাব শাখার আরেক কর্মকর্তা রেজাউল উপাচার্যের ভায়রার ছোট ভাই।
সব মিলিয়ে উপাচার্যের অন্তত আটজন আত্মীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। তবে এখানেই শেষ নয়, তাঁর বাসার কর্মচারী, পাচক ও ড্রাইভার পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্যের নিজের এলাকা রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে চাকরি পেয়েছেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের অর্ধেক।
এ ছাড়া সহকারী রেজিস্ট্রারসহ কয়েকটি পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
চাকরি পাওয়া উপাচার্যের পাঁচ আত্মীয় হচ্ছেন দূর সম্পর্কের ভাগনি কম্পিউটার অপারেটর মনিরা খাতুন, ভাইঝির দেবর পিয়ন মান্নান মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী, বন্ধুর মেয়ে কম্পিউটার অপারেটর সুভিনির, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক একটি প্রকল্পের অফিস সহকারী দূর সম্পর্কের শ্যালক ওবায়দুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ৪৩ জন কর্মচারীর (৯ অক্টোবর পর্যন্ত) অন্তত ২২ জনের বাড়ি পীরগঞ্জে।
উপাচার্যের মেয়ে, ভাই, ভায়রার ভাইসহ অনেককেই প্রথমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক)। পরে তাঁদের চাকরি স্থায়ী করা হয়।
পীরগঞ্জের এ আধিক্যের কারণে স্থানীয়দের অনেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বলেন ‘পীরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়’।
উপাচার্যের আত্মীয়স্বজনের নিয়োগের বিষয়টি শিক্ষক, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও জানেন। তবে ওই নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি উপাচার্য আব্দুল জলিল মিয়া।
প্রথম আলো এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, উপপরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সঙ্গে তো আপনার কথা হয়েছে। এ সম্পর্কে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। পরে হয়তো বলব।’
উপাচার্য এ প্রতিবেদকের ‘সহযোগিতা’ কামনা করেন।
উপাচার্য নিজে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নিয়োগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেজিস্ট্রার আর এম হাফিজুর রহমান এসব সম্পর্কের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তাঁর দাবি, যোগ্যতার ভিত্তিতেই সবাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগে পীরগঞ্জের কথিত আধিপত্য বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, ‘এটি সঠিক নয়। আর তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ধরে লাভ আছে? ...কিছু ব্যত্যয় ঘটতেই পারে। মাইনর বিষয়গুলো নেগেটিভভাবে দেখা ঠিক হবে না। চাঁদেরও নাকি কিছু কলঙ্ক আছে। আমাদেরও সে রকম।’
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথম উপাচার্যের বাড়িও পীরগঞ্জে। তখনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজ কিছুই হয়নি। এখানে তাই কেউ কাজ করতে চাইত না। বাধ্য হয়ে তিনি নিজের এলাকার কিছু লোকজন নিয়ে এসেছিলেন।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এ টি জি এম গোলাম ফিরোজ বলেন, ‘মাত্র পাঁচজন কর্মকর্তার বাড়ি পীরগঞ্জে। কর্মচারীর সংখ্যা একটু বেশি হবে।...তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে ওই এলাকা থেকে নির্বাচন করেছেন। সুতরাং ওই এলাকার লোকজন একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।’
আরও কিছু অভিযোগ
বাংলা বিভাগে অ্যাডহকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছেন ঋষিকেশ পরিমল। তাঁর স্ত্রী শরিফা সালোয়া বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন।
জানা গেছে, ঋষিকেশ পরিমল বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় ওই পদে নিয়োগ পাননি। তখন তাঁকে সহকারী অধ্যাপক পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন পরিমলই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া একমাত্র শিক্ষক।
রেজিস্ট্রার হাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তাঁকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে আরও অ্যাডহক নিয়োগ দেওয়ারও চিন্তা আছে বলে জানান তিনি।
সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মোরশেদুল আলম। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। মোরশেদুল আলমের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলেও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি এসএসসিই পাস করেছেন ১৯৯৮ সালে। একইভাবে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন শাফিয়া শবনম।
মোরশেদুল আলম ও শাফিয়া শবনমের নিয়োগ বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, এ নিয়োগ তিনি আসার আগে হয়েছে, তাই এ সম্পর্কে কিছু জানেন না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর নাম পরিবর্তন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের এপ্রিলে। এর প্রথম উপাচার্য ছিলেন লুৎফর রহমান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল জলিল মিয়াকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
Click This Link